X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন আছে বজ্রাঘাতে নিহতদের পরিবার

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র, সুনামগঞ্জ
২৩ মে ২০১৮, ০৮:০০আপডেট : ২৩ মে ২০১৮, ২১:২০


বজ্রাঘাতে নিহত এলকাছ মিয়ার বসত-ভিটা (ছবি- প্রতিনিধি) দুঃখ-কষ্ট-শোকের কি কোনও দৃষ্টিগ্রাহ্য অবয়ব আছে? গলার কাছে, বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে ওঠা যন্ত্রণা কেমন করে ছায়া ফেলে স্বজনহারা ছেলেমেয়ের মুখে? বজ্রাঘাতে বাবা হারানো আব্দুল আউয়াল ও শুভা আক্তারকে দেখার পর এ প্রশ্ন দু’টি কেন জানি মনের ভেতর ঝলক দিয়ে ওঠতে থাকে বারবার। কী এক গভীর বিষাদ ভর করে আছে আব্দুল আউয়াল ও শুভা আক্তারের চেহারায়। ভাগ্যবিড়ম্বিত এই দুই জনকে পলকের দেখাতেই কেমন যেন ধাক্কার মতো লাগে বুকে।

গত ৫ এপ্রিল সাকুয়ার হাওরে বজ্রাঘাতে মারা যান মো. এলকাছ মিয়া। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের সাফেলা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। আশায় বসতি মানুষের। সংসারে সুদিন আসবে ভেবে চার সন্তানের মধ্যে দুই জনকে কষ্টে-সৃষ্টে পড়াশুনা করাচ্ছিলেন এলকাছ মিয়া। তার এ দুই সন্তানের লেখাপড়ার প্রতি ছিল তুমুল আগ্রহ। কিন্তু বজ্রাঘাতে এলকাছ মিয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার এই দুই সন্তানের পড়াশুনার তুমুল আগ্রহেরও যেনো মৃত্য হতে চলেছে। আব্দুল আউয়াল ও শুভা আক্তারের উষ্কখুষ্ক চুল, চোখের নিচে পড়া কালি আর কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠার কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠা দীর্ঘশ্বাস সেকথাই যেন আলাদা করে জানালো।

আব্দুল আউয়াল ও শুভা আক্তার জানান, পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তাদের বাবা এলকাছ মিয়া। বাড়ির পাশে ধান মাড়াইয়ের খলায় কাজ করার সময় তিনি বজ্রাঘাতে মারা যান। আব্দুল আউয়াল ও শুভা আক্তারের আরও দুই ভাই আছেন, কামাল হোসেন ও জামাল হোসেন। বাবার মৃত্যুর পর কামাল ও জামাল এখন সিলেটের জাফলংয়ে বালি উত্তোলনের কাজ শুরু করেছেন। এ কাজ করে যা উপার্জন হয় তা দিয়ে সংসারের সব খরচ চলে।

এলকাছ মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাটির বেড়া আর শতছিদ্র টিনের চালার বসতঘরে ভাঙাচুরা কিছু আসবাবপত্র রয়েছে। এই বসতবাড়ি ছাড়া এলকাছ মিয়ার আর কোনও সহায়-সম্পদ নেই। এ বছর ধার-দেনা করে কামাল ও জামালকে সঙ্গে নিয়ে বর্গা নেওয়া জমিতে ধান আবাদ করেছিলেন এলকাছ মিয়া। খলা থেকে সেই ধান তুলতে গিয়ে বজ্রাঘাতে মারা যান তিনি।

আব্দুল আউয়াল জানান, তিনি ইসলামগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আর তার একমাত্র বোন শুভা আক্তার স্থানীয় ইয়াকুব উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

বজ্রাঘাতে নিহত একা রানী দাসের বসত-ভিটা (ছবি- প্রতিনিধি) কিছুটা থেমে ধরে আসা গলায় আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর বড় দুই ভাইয়ের টাকায় কোনোরকমে খাওনের খরচ চলে। তবে ট্যাকার অভাবে আমরার (তার ও তার বোন) লেখাপড়া বন্ধ কইরা দিতে অইবো।’ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও কোনও সাহায্য-সহযোগিতা পাননি বলেও জানান আউয়াল।

এলকাছ মিয়ার স্ত্রী হানিফা বেগম বলেন, ‘বান-তুফাইনা (বন্যা-তুফান) দিন ধানের মায়ায় তাইন (তিনি) খলাত (ধান মাড়াইয়ের খলা) গেছলাইন (গিয়েছিলেন)। আমিও সাথে আছলাম (ছিলাম)। আত্কা (হঠাৎ) দেখি, আসমান কালা কইরা হাজ (সাজ) করছে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে ঝড়-বৃষ্টি শুরু অইগেল (হয়ে গেলো)। তাইন আর আমি একটা গাছের আউলি (নিচে) আইয়া খাড়াইছি (দাঁড়ালাম)। পরে দুনিয়া ফর (ফর্সা) কইরা একটা ঝিলকি (ঝলক) দিছে। তাই খাড়া (দাঁড়ানো অবস্থা) থাকি (থেকে) তাইন মাডিত (মাটিতে) পইরা (পড়ে) গেছইন (যান)। তার শইলে (শরীরে) চাইয়া (তাকিয়ে) দেখি, সারা শইল কালা অইয়া গ্যাছে। নাক দিয়ে কোনও দম (শ্বাস-প্রশ্বাস) নাই। পরে আমার চিৎকার হুনিয়া (শুনে) গাওয়ের (গ্রামের) মানুষ তাইনে (তাকে) উদ্ধার করে সুনামগঞ্জ হাসপাতাল লইয়া (নিয়ে) যায়। হিখানো (সেখানে) ডক্তার তাইনে দেইখা, মরা কইছে।’

এলকাছ মিয়ার প্রতিবেশী গুলনাহার বেগম বলেন, ‘হুরুতাডির (ছেলেমেয়ে) আব্বা বাইচা (বেঁচে) থাকতে সংসার ভালোই চলছিল। পোলাপানের লেখাপড়া, প্রাইভেট মাস্টারের খরচ তার বাবাই দিতো। এখন সে পথ বন্ধ হয়ে গেলো।’

এলকাছ মিয়ার ভাতিজা মো. আরশ আলী বলেন, ‘আমার চাচাতো ভাই-বোন খুবই মেধাবী। এ দু’জনকে কেউ যদি লেখাপড়ার খরচ দেয়, তাহলে তারা লেখাপড়া শিখে দেশের কাজে লাগতে পারবে।’

৫ এপ্রিল বজ্রাঘাতে মারা যান একই গ্রামের শিক্ষার্থী একা রানী দাস (১৭)। তিনি ইসলামগঞ্জ কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। মায়ের সঙ্গে তিনি ধানের খলায় কাজ করতে গিয়ে মারা যান। তাদের পরিবারটি স্বচ্ছল হওয়ার কারণে আর্থিক দৈন্যদশা নেই। তবে সন্তান হারানোর শোকে ওই পরিবারের প্রত্যেক সদস্য মর্মাহত।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের মেরুয়াখলা গ্রামের মনিরুল আলম খরচার হাওরে ধান কাটকে গিয়ে বজ্রাঘাতে মারা যান। তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা।

মনিরুল আলমের স্ত্রী আনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। পেটের দায়ে বান-তুফান মাথায় লইয়া হাওরে ধান কাটতে গেছিল তাইন। এরপর ঠাডা পইরা মারা গেছে। সংসারের রোজগারি মানুষ মারা গেলে পুরা সংসারই তো অচল হইয়া পড়ে।’

মনিরুল আলমের প্রতিবেশী আব্দুর রহমান বলেন, ‘মানুষ কি তামাশার জন্য ক্ষেতে ধান কাটতে যায়। যায় তো পেডের তাগিদে। গরিব মানুষ জমি-জিরাত কিছুই নাই। পরিবার নিয়ে ক্যামনে চলবো, খাইবো কি? ঠাডা পইরা মইরা তো পরিবারডারে পথে বসাইয়া গেলো।’ 

মনিরুল আলমের ছেলে মো. হারিছ মিয়া বলেন, ‘আমার আব্বা ক্ষেতে ধান কাটতে গিয়া ঠাডা পইরা মরছইন (মারা গেছেন)। হুনছিলাম, সরকার সাহায্য করবো। অখন পর্যন্ত সরকারি সাহায্যের কোনও খবর নাই। আমরা দ্রুত সরকারি সাহায্য দেওয়ার দাবি জানাই।’

বজ্রাঘাতে নিহত মনিরুল আলমের ছেলেমেয়ে-নাতিনাতনীরা (ছবি- প্রতিনিধি) জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ অফিস সূত্র জানায়, গত ২০ মার্চ থেকে এপর্যন্ত সদরের সফিক মিয়া, লিটন মিয়া, আব্দুর রশিদ, একা রানি দাস ও এলকাছ মিয়া, বিশ্বম্ভরপুরের মঞ্জুরুল আলম, সাহারা বানু ও সুরমা আক্তার, জামালগঞ্জের কমলা কান্ত তালুকদার ও হিরন মিয়া, তাহিরপুরের জাফর আলী ও মোহাম্মদ নূর হোসেন, দিরাইয়ের মুসলিম উদ্দিন ও স্বপন দাস, জগন্নাথপুরের সোহেল মিয়া, শাল্লার নবকুমার দাস, দোয়ারাবাজারের ফেরদৌস মিয়া, শাল্লার মো. আলমগীর হোসেন, ধর্মপাশার জুয়েল মিয়াসহ ২১ জন মানুষ বজ্রাঘাতে মারা গেছেন। বজ্রাঘাতে আহত  হয়েছেন আরও অন্তত ৩০ জন। এর মধ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বজ্রাঘাতে নিহত তিন জনের পরিবারকে সামান্য সরকারি সাহায্য দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমীর বিশ্বাস বলেন, ‘সুনামগঞ্জ দেশের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় গত মাসে বজ্রাঘাতে পাঁচ জন মারা গেছেন; আহত হয়েছেন আরও ৬-৭ জন। বজ্রাঘাতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দুর্যোগ এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে একটি বরাদ্দ থাকে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা একটি প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। এ ছাড়া, উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে অপ্রত্যাশিত খাতে ব্যয় করার কিছু সুযোগ রয়েছে। উপজেলা পরিষদে গত মাসিক সভায় আমরা একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর তা হলো বজ্রাঘাতে উপজেলায় যারা আহত-নিহত হয়েছেন তাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করা।’

জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা মো. ফরিদুল হক বলেন, ‘বজ্রাঘাতে নিহতের মধ্যে তিন জনের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এই সপ্তাহে আরও সাত জনের পরিবারকে একলাখ ৪০ হাজার টাকা  সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দিয়ে আরও ১০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। দুই দিন আগে-পরে বজ্রাঘাতে নিহত সবার পরিবার টাকা পাবে। এতে চিন্তার কোনও কারণ নেই।’

 

 



 



/এমএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা