X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

আত্মগোপনে ব্যবসায়ীরা, তবুও থেমে নেই মাদক ব্যবসা

দুলাল আব্দুল্লাহ, রাজশাহী
২৫ মে ২০১৮, ০৭:৫২আপডেট : ২৫ মে ২০১৮, ১৯:১৭

আসলাম সরকারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে রাজশাহীর মাদক ব্যবসায়ীরা। তবুও থেমে নেই মাদকের কারবার। মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে থেকে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

র‌্যাব-৫ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহাবুবর রহমান বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কৌশল বদলে এখনও মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে।’

জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা তালিকায় রাজশাহীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে নাম রয়েছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রবিউল ইসলাম রবি, নওশাদ আলী, মো. সেলিম, মো. হযরত আলী, নাজিবুর, তোফাজ্জল, হায়দার আলী, সোহেল, সেতাবুর রহমান বাবু ও টিপু, চারঘাট উপজেলার মো. আশরাফ আলী, দুর্গাপুর উপজেলার মো. সেলিম, খুকু রানি ও মো. সিদ্দিক এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের কোদালকাটি গ্রামের জব্বার আলী।

তাদের অনেকের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযান শুরুর পর তারা বাড়িতেও থাকছে না। তাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধে মাদক ও চোরাচালানের মামলা রয়েছে।

তাদের অনেকে মাদক ব্যবসার পাশাপাশি নগরীতে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। সেসব প্রতিষ্ঠানে অভিযানের আগে তাদের আনাগোনা থাকলেও এখন তারা আসে না। কর্মচারী দিয়ে তাদের দোকান পরিচালনা করে থাকে। কর্মচারীরাও তাদের মালিকদের ব্যাপারে মুখ খুলছেন না।

বুধবার (২৩ মে) কক্সবাজারে শুটিং শেষে ফেরার পথে এক লাখ আট হাজার ইয়াবাসহ রাজশাহীর প্রতিষ্ঠান ‘সরকার প্রোডাকশন হাউস’ নামের একটি শুটিং টিমের ১০ সদস্যকে  আটক করেছিল র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের সদস্যরা। অন্যদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলেও রাজশাহীর দুজনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তারা হলো  একসময়ের টেলিভিশন দোকানের কর্মচারী থেকে মাদক সম্রাটে পরিণত হওয়া রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া থানার ডিঙ্গাডোবা এলাকার আজিজুর রহমানের ছেলে আসলাম সরকার (৪০) ও চারঘাট থানার মিয়াপুর গ্রামের মৃত আব্দুস ছাত্তারের ছেলে মাইক্রোবাস চালক মাসুদ রানা (৩২)।

আসলাম সরকারকে সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, একসময়ের দরিদ্র পরিবারের সন্তান আসলাম সরকার মাদকের পাশাপাশি নানা অপকর্মে জড়িত রয়েছে। শুধু তাই নয়, শুটিংসহ বিভিন্ন ব্যানারে সে  মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে। নগরীতে তার একটি প্রোডাকশন হাউস ও ব্ল্যাক ক্যাফে নামের একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট রয়েছে।

এর আগে আসলাম নগরীর গণকপাড়া মোড়ে ঠিকানা ফ্যাশন নামের একটি দোকানও দিয়েছিল। এতে তার সঙ্গে নগরীর অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির সখ্যতা গড়ে ওঠে।

ভৌগলিকভাবে রাজশাহী সীমান্তবর্তী জেলা। মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকেরই পদ্মা ও মহানন্দা নদীর চরে বাড়ি রয়েছে। আবার নদীর এপারে ও শহরেও বাড়ি রয়েছে তাদের। এভাবে একেক এসময় একেক বাড়িতে অবস্থান করে তারা পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে যায়।

এ ব্যাপারে র‌্যাব-৫ এর উপ-অধিনায়ক মেজর এএম আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহী অঞ্চলের মাদক ব্যবসায়ীদের একাধিক বাড়ি থাকে। কারও কারও একটি বাড়ি আছে সীমান্ত লাগোয়া গ্রামে, একটি নদীর এপারের গ্রামে এবং আরও একটি বাড়ি আছে শহরে। তারা কখন কোথায় থাকে, তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আবার কাছে মাদক না থাকলে তাকে গ্রেফতারও করা যাবে না। অনেক সময় দেখা যায়, যে বাড়িতে মাদক ব্যবসায়ী যখন অবস্থান করে না, তখন সে বাড়িতে মাদক মজুত রাখা হয়।’

রাজশাহীর যে কয়টি এলাকা সবচেয়ে বেশি মাদকপ্রবণ, তার একটি পবা উপজেলার সোনাইকান্দী গ্রাম। এ এলাকার প্রায় শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী ভারত থেকে হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল পাচার করে আনে। তাদেরই একজন আবুল হাসান ওরফে হাসান ঘাটিয়াল (৪৫)।

গত ১৬ মে রাজশাহী নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানার পশ্চিম নবগঙ্গা এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হাসান নিহত হয়। তার বিরুদ্ধে মামলা ছিল ১৬টি। হাসান নিহত হওয়ার পর ওই এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে যায়।

এরপরই গত ২০ মে রাজশাহীতে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আরেক মাদক ব্যবসায়ী ও যুবলীগ নেতা লিয়াকত আলী মণ্ডল (৪১) নিহত হয়। সে পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। নিহত লিয়াকত এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে একটি নাশকতাসহ মাদক, চাঁদাবাজি, চোরাচালান ও হত্যাচেষ্টার ১১টি মামলা রয়েছে।

জানা গেছে, গত বছরের ৪ মার্চ পবা উপজেলার হরিপুর, সোনাইকান্দী, কসবা, মুরারিপুরসহ আশপাশের এলাকার ১১৯ জন মাদক ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারা মাদক ব্যবসা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অঙ্গীকার করে। পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের মিষ্টিমুখ করানো হয়। কিন্তু মাদক ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করা ওই ১১৯ জন কথা রাখেনি। নানা কায়দায় তারা মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের একজন মুরারিপুর এলাকার জাহাঙ্গীর আলম। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৬টি। পলাতক হরিপুর সেন্টু মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তিনটি। হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য সেলিম রেজার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা রয়েছে চারটি।

পবায় মাদক ব্যবসায়ীদের গডফাদার হিসেবে প্রথমেই জাঙ্গালপাড়া এলাকার মাসুম ওরফে পা ফাটা মাসুমের নাম উঠে আসে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১২টি। সোনাইকান্দি এলাকার আরেক মাসুমের নামেও মামলা আছে ১১টি। তারা এখন লাপাত্তা। এছাড়া খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মাদক ব্যবসায়ীদের গডফাদার হিসেবে পরিচিত সোনাইকান্দি এলাকার বাচ্চু ঘোষকে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৯টি। একই এলাকার রাজনের বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে ১২টি। আর পুরো পবায় মাদকের বিশাল নেটওয়ার্কের গডফাদার হিসেবে সবচেয়ে আলোচিত নাম কসবা এলাকার মিলন ওরফে ভকা মিলনও এখন আত্মগোপনে। মিলনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১০টি। কোনও মামলায় গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে অবৈধ এ কারবার চালিয়ে যায় তারা।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতেখায়ের আলম বলেন, ‘আমাদের দফতর থেকে নগরীতে ৩১৪ মাদক ব্যবসায়ীদের মাদক ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনার জন্য পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এদের মধ্যে ৫১ জন শপথ ভেঙে আবার মাদক কেনাবেচায় জড়িয়ে পড়েছিল। তাই তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আর বাকিরা গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলের মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে গত ছয় মাসে অন্তত ৬০০ অভিযোগ জমা পড়েছে র‌্যাব-৫ এর কার্যালয়ে। এই অভিযানে প্রতিদিনই খুচরা ব্যবসায়ী ও সেবনকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন আমদানিকারক, মজুতকারক, সরবরাহকারী, পাইকারি বিক্রেতা ও সেবনকারীদের আলাদা আলাদা ভাগ করে সবাইকে আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করছে পুলিশ। এতে অভিযান আরও জোরদার হয়েছে।

র‌্যাব-৫ এর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্যাম্পের একটি দল গত বছরের ৮ অক্টোবর রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার সারাংপুর নতুনপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাজেমান আলী নামে এক মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে হেরোইন জব্দ করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি দুটি পরীক্ষাগারের ফলে নমুনায় হেরোইন পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোদাগাড়ী থানার পরিদর্শক আলতাফ হোসেন মামলার দুই আসামিকে অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তবে আদালত এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে রাজশাহীর পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি মামলাটি পুনঃতদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

এ ব্যাপারে র‌্যাব-৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহাবুবর রহমান বলেন, ‘অনেক সেবী ও ব্যবসায়ীকে মাদকসহ গ্রেফতার করা হলে আইনের চোখকে তারা ফাঁকি দেওয়ার জন্য অনেক সময় মাদকের নমুনাকে ভুল প্রমাণ করে রেহাই পেয়ে যায়। এক কথায় তারা মাদকের কাঁচা টাকা ব্যবহার করে বিভিন্নজনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকে। এজন্য মাদকের বিরুদ্ধে অন্যদেরও জোরালো ভূমিকা থাকতে হবে।’

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
৫ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভা‌বিক
৫ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভা‌বিক
সুইডেনের বিপক্ষে পর্তুগাল দলে জায়গা হয়নি রোনালদোর
সুইডেনের বিপক্ষে পর্তুগাল দলে জায়গা হয়নি রোনালদোর
মিয়ানমারের বিমান হামলায় উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ মহাসচিব
মিয়ানমারের বিমান হামলায় উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ মহাসচিব
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
সর্বাধিক পঠিত
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
লিটনের বাদ পড়া নিয়ে যা বললেন হাথুরুসিংহে
পদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
একীভূত হলো দুই ব্যাংকপদ্মার গ্রাহকরা এক্সিম ব্যাংক থেকে আমানত তুলতে পারবেন
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সুইডেনের রাজকন্যার জন্য দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, ৫০০ স্থানে থাকবে পুলিশ
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
সঞ্চয়ী হিসাবের অর্ধকোটি টাকা লোপাট করে আত্মগোপনে পোস্ট মাস্টার
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই