যে পাহাড় কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার পরিবারের আশ্রয়ের শেষ ঠিকানা ছিল, সেই পাহাড়ই গত বছর হঠাৎ করে ঘুমন্ত মানুষের ওপর হেলে পড়ে। কেড়ে নেয় ১২০টি তাজা প্রাণ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে পাহাড় ধসের ঘটনা। এটি রাঙামাটির ইতিহাসে প্রথম এবং ভয়াবহ ঘটনা বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্রবীণরা। তবে এখনও সেই স্থানে বাস করছেন অনেক মানুষ। প্রাণহানির ঝুঁকি থাকার পরও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে বসতি বদলাচ্ছেন না তারা।
জানা যায়, গত বছর রাঙামাটিতে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির পরও বর্ষা শেষে ফের একই স্থানে গড়ে উঠেছে বসতি। রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী, যুব উন্নয়ন এলাকা, মনতলা আদাম, সাপছড়ি, পোস্ট অফিস এলাকা, মুসলিম পাড়া, নতুন পাড়া, শিমুলতলী, মোনঘর, সনাতন পাড়া এলাকায় গত বছর সবচে বেশি পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এরপরও থেমে থাকেনি ঝুঁকিপূর্ণ এসব স্থানে বসতি স্থাপন। এককথায় মরণ ফাঁদ জেনেও এসব পাহাড়ের পাদদেশে নতুন করে বসতি নির্মাণ করে ঝুঁকি নিয়ে সেখানেই বাস করছে অসংখ্য পরিবার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরো জেলায় প্রায় ১৭ হাজার মানুষ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে বসবাসকারীরা শত ঝুঁকি জেনেও নিজেদের জায়গা থেকে সরতে রাজি নয়। মৃত্যুর শঙ্কা আছে জেনেও নিজেদের ভিটামাটি ছাড়বে না বলে জানিয়েছেন এসব মানুষ। প্রশাসনের শত উদ্যোগের পর থামানো যাচ্ছে না ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসত নির্মাণ।
শহরের শিমুলতলীর স্থানীয় বাসিন্দা মরিয়াম আক্তার বলেন, ‘গত বছর বাড়িঘর ভেঙে যাওয়া পার অনেক কষ্ট করে ঋণ করে এই বাড়িটি আবার করেছি। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও যাওয়ার আর কোনও জায়গা নাই আমাদের। সরকারও তো কয়েক মাস আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে কিছু টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমাদের জন্য নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা যেহেতু করে দেয়নি তাহলে আমরা কই যাবো? নিরুপায় আমরা। মরলে এখানে মরবো, বাঁচলে এখানে বাঁচবো।’
শহরের যুব উন্নয়ন এলাকার বাসিন্দা কালা সোনা চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য এলাকা যেহেতু পাহাড় দিয়ে ঘেরা। আর আমরা যেখানে বসবাস করছি সেটি পাহাড়ের নিচে। সরকার আমাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ওপরের রাস্তাটি যদি একটু নিচু করা হয় তাহলে এই গ্রামের মানুষরা নিরাপদে থাকতে পারতো।’
শহরের মোনঘর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা কালিন্দি চাকমা বলেন, ‘বৃষ্টি হলে খুব ভয় করে। যদি রাতে বৃষ্টি হয় তখন আর কেউ ঘুমাই না। যতক্ষণ বৃষ্টি হয়, ততক্ষন জেগে থাকতে হয়। অন্য কোথায় যাওয়া জায়গা থাকলে কখন চলে যাইতাম! সরকার যদি আমাদের কথা চিন্তা করে আমাদের নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করতো, তাহলে বার্ষাকালটা নিরাপদে রাতে ঘুমাইতে পারতাম।’
শহরের মুসলিম পাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. সোলাইমান জানান, ‘এই জায়গা বিক্রি করে অন্য জায়গায় ছোট জায়গা কেনার জন্য গত একবছর ধরে চেষ্টা করছি কিন্তু কেউ এই জায়গা কিনতে রাজি হচ্ছে না, যদি কেউ রাজিও হয় তাহলে দামও ভালো দিচ্ছে না। অন্য কোথায় গিয়ে থাকবো সেই অবস্থায়ও নেই। সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা হচ্ছে। সরকার যদি আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে যারা ঝুঁকিতে বসবাস করছে সবাইকে সরিয়ে নিতো, তাহলে সাবাই নিরপত্তার জন্য সরে যেত।’
এ প্রসঙ্গে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশীদ জানান, ‘বর্ষা মৌসুমে যে কোনও অবস্থার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছি। ইতোমধ্যে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ণয় করেছি এবং সেইসব এলাকায় আমরা মানুষদের সচেতনতামূলক মতবিনিময় সভা করেছি।আমরা আশ্রয় কেন্দ্রেও প্রস্তুত রেখেছি।’
তবে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনার জন্য কাজ চলছে বলেও জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
প্রসঙ্গত, গত বছর প্রবল বর্ষণে ব্যাপক পাহাড় ধসে রাঙামাটিতে ৫ সেনাসদস্যসহ ১২০ জন মারা যান। এতে আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ। ব্যাপক ক্ষতি হয় পুরো জেলায়। তিন মাস আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছিল প্রায় তিন হাজার মানুষ।
আরও পড়ুন-
এখনও পাহাড়ে ১৭ হাজার মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস
ফের পাহাড় ধস রাঙামাটিতে, নিহত অন্তত ১১
রাঙামাটিতে বৃষ্টি মানেই আতঙ্ক
পাহাড়ের স্বাভাবিক গড়ন নষ্ট করার কারণেই ঘটছে প্রাণহানি