X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিষাক্ত শিল্পবর্জ্যে ভয়াবহ হুমকির মুখে হালদা

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
২৪ জুন ২০১৮, ০৭:৫৯আপডেট : ২৪ জুন ২০১৮, ০৭:৫৯





দূষিত বর্জ্য মিশ্রিত পানিতে মরে যাচ্ছে মাছ অবিরত দূষণ, ভরাট, দখল-বেদখলসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে ভয়াবহ হুমকির মুখে রেয়েছে দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। কারখানার দূষিত বর্জ্যের কারণে সম্প্রতি এই নদীতে মারা যাচ্ছে রুই, মৃগেলসহ নানা প্রজাতির মাছ। গত কয়েকদিন ধরে হালদাসহ আশপাশের খাল-বিলে অসংখ্য মরা মাছ ভেসে উঠতে দেখেছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, পানির দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় মাছগুলো মরে ভেসে উঠছে। 

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হালদা নদী বিশেষজ্ঞ মঞ্জুরুল কিবরিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য পানিতে যে পরিমাণ অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন, আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, দূষণের কারণে হালদার পানিতে এখন সেই পরিমাণ অক্সিজেন নেই। উল্টো পানিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে মাছগুলো মরে যাচ্ছে।’
শুধু কারখানার বর্জ্যই নয়, নদীর গতিপথে বিভিন্ন রকমের বাধা-বিপত্তি, রাবার ড্যাম, ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলনের কারণে দিন দিন হালদা নদী মাছ শূণ্য হয়ে যাচ্ছে।  এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই নদীটি তার স্বাভাবিক চরিত্র হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 
তারা মনে করেন, হালদাকে বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। অন্যথায়, মানবসৃষ্ট এসব দূষণ নদীটিকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলবে। 
বিগত ৩০ বছর ধরে হালদা নদী নিয়ে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী। তিনি বলেন, ‘মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে হালদা দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে। এর পেছনে নদীসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খালে স্লুইচগেইট নির্মাণ এবং নদীতে পতিত গৃহস্থলী ও শিল্পবর্জ্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।’
কলকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত পানি প্রথমে পড়ে খালে, সেখান থেকে যায় হালদায় তিনি বলেন, ‘নদীর ১১টি স্থানে বাঁক সমান করে ফেলায় মাছের বিচরণ ও প্রজনন কমে গেছে। বাঁক না থাকায় প্রাকৃতিকভাবে কোনও কুম (নদীর তলদেশে গভীর খাদ, যেখানে আগে মা মাছেরা ডিম ছাড়তো) তৈরি হচ্ছে না। উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ায় এখন মা মাছেরা নমুনা ডিম ছাড়ার পর, আর কোনও ডিম ছাড়ছে না। ফলে দিন দিন নদীতে মা মাছের ডিম ছাড়ার হার কমছে। এর বাইরে কিছু কিছু জায়গায় জেগে ওঠা চর নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। হালদাকে বাঁচাতে হলে দূষণ ও বালি উত্তোলন বন্ধ এবং হালদার মুখে নতুন জেগে উঠা চর অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ 
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তফতরের ২০১৬ সালের  এক তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিকটবর্তী আটটি প্রতিষ্ঠানের কারণে মূলত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে হালদা নদীর মৎস্য প্রজনন। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনও কার্যকর তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) না থাকায় কারখানার তরল বর্জ্য এবং গৃহস্থালির বর্জ্যের মাধ্যমে দূষিত হচ্ছে হালদা। নদীর সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন খাল ও ছোট ছোট ছড়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে এ দূষণ।
প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, বায়েজিদ-অক্সিজেন এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন কারখানা এবং আবাসিক এলাকার বর্জ্য বামনশাহী খালের মাধ্যমে হালদায় পড়ছে। আগে বামনশাহী খালের পানি সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে পড়তো। কিন্তু এখন তা অন্যান্য আবাসিক এলাকার ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি কুয়াইশ খালের মাধ্যমে হালদায় পড়ছে। এতে হালদা ভয়াবহভাবে দূষিত হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার (২১ জুন) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা গবেষণা পরীক্ষাগার ও পরিবেশ অধিদফতরের একটি প্রতিনিধি দল হালদা নদীর ১০টি পয়েন্টের পানির নমুনা পরীক্ষা করেন। পরদিন শুক্রবার (২২ জুন) বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিনিধি দল দূষণের শিকার হালদা নদীর সাসঙ্গে সংযুক্ত শাখা খালগুলো পরিদর্শন করেন এবং হালদা নদীর পানির নমুনা পরীক্ষা করেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা অনেক কমে গেছে। সাধারণত এই নদীর প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের স্বাভাবিক মাত্রা থাকে পাঁচ মিলিগ্রাম। কিন্তু হালদা নদীর পানির নমুনা পরীক্ষা শেষে বর্তমানে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ দুই মিলিগ্রামের চেয়ে কম পাওয়া গেছে। এছাড়া, পানিতে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে অ্যামোনিয়ার উপস্থিতি।
খালের এই বিষাক্ত পানি গিয়ে মিশছে হালদার পানিতে হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন,  ‘ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন, রাবার ড্যাম তৈরিসহ মোট পাঁচটি কারণে হালদা দূষিত হচ্ছে। এর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্যের কারণে। বায়েজিদ-অক্সিজেন এলাকার আবাসিক বর্জ্য বামনশাহী খালের মাধ্যমে সরাসরি হালদায় পড়ছে। যা হালদাকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হালদা এখন আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি দূষণের শিকার। আমি আগেও অনেকবার হালদার পানি পরীক্ষা করে দেখেছি। কিন্তু এবারের মতো এত খারাপ অবস্থা আর কখনও দেখিনি। শিল্প-কারখানার বর্জ্য খালে পড়ে  ব্যাপকহারে পানি দূষিত করছে। খালের পানি একেবারে কুচকুচে কালো আকার ধারণ করেছে। এই পানিই হালদায় গিয়ে মিশে সেখানকার পানি দূষিত করছে।’তিনি হালদা দূষণ রোধে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, দেশের রুই জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। এক সময় এ নদী থেকে রেনু সংগ্রহ করে সারাদেশের চাহিদা মেটানো হতো। চট্টগ্রামের ৬০ লাখের বেশি মানুষের দৈনন্দিন পানি সরবরাহও হয় এ নদী থেকে। খাগড়াছড়ির পাতাছড়ি থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত ৯৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীর দুপাশের মানুষের কৃষি কাজেও ব্যবহার হয়এখানকার পানি।

 

/এমএইচ/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?