X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধরলার ভাঙন ঠেকাবে কে

মোয়াজ্জেম হোসেন, লালমনিরহাট
১৬ জুলাই ২০১৮, ১৬:৫৪আপডেট : ১৬ জুলাই ২০১৮, ১৯:০৫

ধরলার ভাঙনে সব হারিয়ে পথে বসা এক নারী

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ধরলা নদীর তীব্র ভাঙনে লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন ও পাটগ্রাম পৌরসভাসহ উপজেলার চারটি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক পরিবারের ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি,গাছ, কবরস্থান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তীব্র ভাঙনের মুখে রয়েছে আরও শতাধিক পরিবারের বাড়ি ও কয়েকশ’ একর ফসলি জমি। প্রতিবছর এমন ভাঙনের মুখে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। এর বিনিময়ে সরকার যে ত্রাণ পাঠায় তাও পুরোটা জোটে না তাদের। তাদের অভিযোগ,প্রশাসন, জন প্রতিনিধি ও সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের হাত ঘুরে আসার পথেই এর অনেকটাই হাপিস হয়ে যায়। প্রতিবছরই নদীতে সব খুইয়ে এমন ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে আর চান না ক্ষতিগ্রস্তরা। তাদের দাবি আর ত্রাণ নয়, ধরলার ভাঙন রোধে এবার পরিকল্পিতভাবে নদী শাসন করা হোক।

ধরলা ভাঙছে, উদ্বিগ্ন এলাকাবাসীর নজর নদীর পানির দিকে।

বাংলাদেশের মানচিত্রে ধরলা নদী খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। ভারত বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক মানচিত্রে নদীটির অবস্থান সহজেই চোখে পড়ে। সেখানে তিস্তা নদীর শাখা নদী হিসেবে দেখা গেলেও আরও গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমের সীমান্তবর্তী মো ফরেস্টের কাছে উদ্ভূত মুরতি নদী বিভিন্ন নামে ধাবিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ময়নাগুড়ি এলাকায় এর একটি ধারা এসে ধরলা নদীর সঙ্গে মিশে বুড়িমারী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদী বুড়িমারী থেকে পাটগ্রাম শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জোংড়া সীমান্ত দিয়ে আবারও ভারতে চলে গেছে। অন্যদিকে,ভারত-ভুটান সীমান্তে উদ্ভূত জলঢাকা নদী ভারতের বিস্তীর্ণ জনপদ পাড়ি দিয়ে এবং ভারতের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক নামে পরিচিত হয়ে শেষদিকে শিংগিমারী নদী নামে প্রবাহিত হয়েছে। পানাগুড়ি সীমান্তে সেটি ধরলার সঙ্গে মিশে আবারও লালমনিরহাটের মোগলহাট সীমান্ত দিয়ে ধরলা  নামে প্রবেশ করে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদীতে পড়েছে। ফলে ভারতের তিনটি পাহাড়ি খরস্রোতা নদী তিস্তা, মুরতি ও জলঢাকার পানি একসঙ্গে নেমে আসায় ওপরে শান্ত দেখালেও ধরলা নদীর তলদেশে তীব্র স্রোত বিরাজমান।

ধরলার ভাঙনে ভিটেমাটি তো গেছেই রক্ষা পাচ্ছে না নিকটাত্মীয়দের কবরস্থানও

সরেজমিনে দেখা যায়, লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট, মোগলহাট, বড়বাড়ী এবং পাটগ্রাম উপজেলার জোংড়া, শ্রীরামপুর, জোংড়া, বুড়িমারী ইউনিয়ন ও পাটগ্রাম পৌরসভার ২২টি পয়েন্টে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এসব ইউনিয়নের মধ্যে পাটগ্রামের জোংড়া, পাটগ্রাম পৌরসভা, শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ও লালমনিরহাটের কুলাঘাট, মোগলহাটের অবস্থা ভীষণ উদ্বেগজনক। অবশ্য জোংড়া, কুলাঘাট, মোগলহাট ইউনিয়নের কিছু এলাকায় ধরলা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে নদী শাসন করার কাজ চলমান রয়েছে। পাটগ্রাম পৌরসভার ৩টি স্থানে বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।

রাক্ষুসী ধরলার পেটে যাচ্ছে নদীপাড়ের মানুষের ভিটেমাটিসহ ফসলি জমি

এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিদের দাবি,পরিকল্পনা ছাড়াই যেনতেন ভাবে চলছে নদী শাসন।ফলে খাপছাড়াভাবে নদী শাসনের কাজ চললেও অনেক স্থানে বাড়ছে নদী ভাঙন, বিলীন হচ্ছে সেখানকার জনপদ। কৃষির ওপর নির্ভরশীল নদীর পাড়ের লোকজনের দাবি,পরিকল্পিতভাবে নদী শাসনের জন্য সরকারকে সমীক্ষা করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

পাটগ্রামের জোংড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আশরাফ আলী, পাটগ্রাম পৌরসভার মেয়র শমসের আলী ও মোগলহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন,‘বন্যা হলেই নদীর পাড়ের পরিবারগুলোর মারাত্মক কষ্ট হয়। কিন্তু আমাদের করার কিছু থাকে না। এসব অতি গরিব পরিবারগুলোর জন্য কিছুই করার থাকে না। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে একমাত্র নদী শাসনই সহায়ক হতে পারে। ধরলা নদী শাসনের জন্য পানিসম্পদমন্ত্রীসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। স্থানীয় সংসদ সদস্যগণও চেষ্টা করছেন, কিন্তু এজন্য প্রাপ্ত বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।’ 

ধরলার ভাঙনে সব হারিয়ে এক নারীর বিলাপ

কুলাঘাট ও মোগলহাট ইউনিয়নের বেলিচা বেগম, আইনুদ্দিন, মোতালেব উদ্দিন, নজরুল ইসলাম, শামসুল হক, গফুর মোল্লা, মাইফল নেছা, ফয়াজ উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, রেজিয়া বেগমের ঘর-বাড়িসহ সহায় সম্বল কিছুদিন আগের বন্যায় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

এসব পরিবারের সদস্যরা বলেন, ‘আমরা ত্রাণ চাই না। এই বাঁধটা করে দিলে আমাদের আবাদি জমি,ঘর-বাড়ি, গাছও রক্ষা হবে। আমরা আর কিছু চাই না। নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার জন্য একটি বাঁধই আমাদের কোটি টাকা সাহায্যের চেয়েও বেশি উপকারে আসবে। তাই বাঁধটা যাতে হয়, এই জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চাই।  

ধরলার ভাঙন

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও চর কুলাঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইদ্রিস আলী বলেন,‘সাম্প্রতিক বন্যার পানি ধরলা নদী থেকে নেমে গেলেও অস্বাভাবিক ভাঙনের মুখে ৬০টি পরিবার সহায় সম্বল হারিয়ে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে। শীঘ্রই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তালিকাটি জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ বলেন,‘‘কিছু কিছু এলাকায় ধরলা নদী শাসনের কাজ চলছে। তাছাড়াও ধরলার ভাঙন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় টেকসই ব্যবস্থা নিতে এবং কৌশলগত করণীয় নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। তালিকা পেলে তাদের সহযোগিতা দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

ধরলার করালগ্রাসে যে কোনও মুহূর্তে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এই জমিও

লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন এমপি বলেন, ‘‘লালমনিরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমানের তত্ত্বাবধানে কুলাঘাট ও মোগলহাটে ধরলা নদী শাসনের কাজ চলমান রয়েছে। পাটগ্রামের জোংড়া ইউনিয়নেও ধরলা নদী শাসন ও খনন কার্যক্রম চলছে। অবশিষ্ট অংশেও পর্যায়ক্রমে নদী শাসন করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ধরলা নদী শাসন ও খনন করতে যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন, এত টাকা একসঙ্গে বরাদ্দ পাওয়া যায় না। তবে কাজ চলমান রয়েছে। তবে এগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে কি না সেদিকে গণমাধ্যমেরও চোখ থাকা প্রয়োজন।’

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘‘পাটগ্রামের জোংড়া ইউনিয়নে ১০টি প্যাকেজে ২৪ কোটি টাকার কাজ চলছে। লালমনিরহাটের তিনটি ইউনিয়নে ৮টি প্যাকেজে ৮ কোটি টাকার কাজ চলছে। এরমধ্যে সাড়ে ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে জোংড়া ইউনিয়ন এলাকায় ধরলা নদী খনন কাজও চলছে। অনেকস্থানে ধরলা নদী যথাসময়ে শাসন না হওয়ায় নদী তীরবর্তী অসহায় পরিবারগুলো নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড পরিকল্পনা করেই কাজ বাস্তবায়ন করে থাকে। তবে নদী শাসনের জন্য একসঙ্গে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায় না। বরং লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট, মোগলহাট ও বড়বাড়ী ইউনিয়নে ধরলা নদীর ভাঙন ঠেকাতে বাঁধ নির্মাণের চলমান কাজের আট কোটি টাকাই বাকিতে করছে ঠিকাদাররা। আমরা অর্থ বরাদ্দ পেলে নদী শাসনের কাজ দ্রুত করা হবে।’

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা