X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

মাছ চাষ হয় যে গ্রামের সব জলাশয়ে

রায়হানুল ইসলাম আকন্দ, গাজীপুর
২০ জুলাই ২০১৮, ১৪:৫২আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৮, ১৪:০৮

মোশারফ হোসেনের ফিশারিজ গাজীপুরে শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের ভিটিপাড়া গ্রামে কোনও পরিত্যক্ত জলাশয় নেই। এমনকি আবাদি জমিতে পানি আটকিয়েও সেখানে মাছ চাষ করা হচ্ছে। ধান কাটা শ্রমিকের অভাবে কৃষকেরা এখন চাষ পরিবর্তন করে মাছ চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এ চিত্র এখন ভিটিপাড়া গ্রামের সবখানে।

প্রায় ৩৩ বছর আগে মাত্র ৩৫ শতক জলাশয় থেকে মাছ চাষ শুরু করেন ভিটিপাড়া গ্রামের মোশারফ হোসেন কাঁইয়া (৫৫)। এখন তিনি প্রায় ৪৪ একর জলাশয়ের একজন সফল মৎস্য চাষি। তার অধিকাংশ জলাশয়ই অন্যদের কাছ থেকে লিজ নেওয়া। ১০ জন শ্রমিক তার খামার নিয়মিত দেখাশোনা করেন। তার খামার পরিচর্যা দেখে এলাকার অন্তত ১০ জন উদ্যোক্তা মৎস্য চাষে উৎসাহিত হয়েছেন। তারাও আজ সফল মৎস্য চাষি।

মোশারফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারিনি। ছোট বেলা থেকেই নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার মানসিকতা কাজ করতো। আত্মনির্ভরশীল হয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কখনও ভাড়ায় আবার কখনও নিজেই গ্রামে ক্ষুদ্র ব্যবসা করতাম। ১৯৮৬ সনের কথা। ওই বছরের একদিন দেখতে পাই আমার বাপ-চাচাদের জমি জিরাত ও জলাশয় থেকে এলাকার মানুষ অবাধে প্রাকৃতিক মাছ যে যার মতো ধরে নিয়ে যাচ্ছে। একবার একটি জলাশয়ে আমার এক চাচা মাছের কিছু পোনা ছেড়ে দেন। ভালো উৎপাদন দেখে আমিও আমার বাবার ৩৫ শতক জমিতে মাছ চাষ শুরু করি। প্রথম বছরেই ভালো ফলন পাই। পরে নিজের ও স্বজনদের কয়েক একর জলাশয় ভাড়া নেই। ভাড়া নেওয়া জলাশয় থেকেও ভালো উৎপাদন পাই।’

মোশারফ হোসেন বলেন, ‘১৯৮৮ সালে বিয়ে করি। আমার স্ত্রী নাছিমা আক্তারও মাছ চাষে আমাকে নানাভাবে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে নাজমুল হাসান সজীব এবার ফার্মাসি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছে। মেয়ে সুবর্ণা বিবাহিত।’

তিনি বলেন, ‘আমার চাষবাস দেখে এক চাচাতো ভাই মাছ চাষে তাকে যুক্ত করার অনুরোধ করে। কিন্তু অংশীদারী চাষে পর পর তিন বছর সফল হতে পারিনি। পরে চার বছরের মাথায় আবার এককভাবে মাছ চাষ শুরু করি। এসময় সরকারের কাছ থেকে বিনা সুদে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আবারও মাছ চাষ শুরু করি। প্রসারিত হতে থাকে আমার মাছ চাষের ক্ষেত্র। উপজেলা মৎস্য অধিদফতর থেকে নিয়মিত পরামর্শ, প্রশিক্ষণ নিয়ে জলাশয় মাছ চাষের উপযোগী করে তুলি। এছাড়া মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও মাছের নানা প্রকারের রোগ প্রতিরোধের জন্য নানা ধরণের ওষুধ ব্যবহার করি।’

মোশারফ হোসেন বলেন, ‘মাছ চাষের আয়তন বাড়ানোর জন্য জমানো লাভের টাকা দিয়ে কিছু জলাশয় কিনি। ৬ বছর আগে আরও কিছু জলাশয় লিজ নিয়ে মাছ চাষের ক্ষেত্র প্রসারিত করি। এখন প্রায় ৪৪ একর জলাশয়ে মাছ চাষ করছি। বর্তমানে আমার কোনও ঋণ নেই। মাছ চাষই করেই আমি স্বাবলম্বী।’

তিনি বলেন, ‘মাছের খাদ্য সরবরাহের জন্য এখন আর বাজারমুখী হই না। নিজেই সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ফিড মিল করেছি। কাঁচামাল কিনে এনে খামারেই মাছের খাদ্য তৈরি করি। মাছের খামারের এক পাশে তিন হাজার ৪’শ মুরগীর শেড ও ২০টি দেশি-বিদেশি উন্নত জাতের গরু লালন পালন করছি।’ মোশারফ হোসেনের ফিশারিজ

সফল এই মৎস্যচাষী জানান, তার কাছ থেকে এলাকার অনেকেই মাছ চাষের নিয়ম কানুন ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তারা প্রত্যেকেই এখন সফল মৎস্য চাষী। তার সফলতা দেখে উদ্ধুদ্ধ হওয়ায় এখন ভিটিপাড়া গ্রামে পরিত্যক্ত কোনও জলাশয় নেই। নিজের সফলতা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এখন বরমী বাজারে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত বরমী আইডিয়াল স্কুল নামে একটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছি। আমি সফল মানুষদের আহ্বান জানাবো, জীবনের একটি পর্যায়ে সফল হলেও কেউ যেন তার জীবনের ফেলে আসা ইতিহাস ভুলে না যান।’

একই গ্রামের আব্দুর রহিম কাঁইয়া বলেন, ‘সফল চাষী মোশারফ কাঁইয়ার সফলতা দেখে মাছ চাষে আমিও আগ্রহী হই। গত ২০ বছর যাবত মাৎ চাষে আমিও জড়িত। মাছ চাষ শুরু করার আগে ঝুঁকি নিতে ভয় হতো। পরে মোশারফ কাঁইয়ার পরামর্শে মাছ চাষে উদ্ধুদ্ধ হই। পর পর বেশ কয়েকবার উপজেলা মাৎস্য অফিসের মাধ্যমে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। বর্তমানে সাত একর জলাশয়ে মাছ চাষ করছি। অধিকাংশ জলাশয় ব্যাক্তি মালিকের কাছ থেকে লিজ নেওয়া।’

তিনি বলেন, ‘মাছ চাষে সাধারণত যে সমস্যাগুলো হয় তার মধ্যে জলাশয়ের পাড় ভেঙে যাওয়া, বার বার একই খাদ্য ব্যবহারে পানিতে গ্যাস হওয়া, অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া, জলাশয়ের ভাড়া বেড়ে যাওয়া, খাদ্যমূল্যের সঙ্গে মাছের বিক্রয়মূল্যের সামঞ্জস্য না থাকা ইত্যাদি। পরে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের পরামর্শে সমস্যা সমাধানেরও ব্যবস্থা করা হয়। তবে মাঝে মধ্যে মাছের মড়ক দেখা দিলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে ওঠে।’

মাছ চাষী আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘ভিটিপাড়া এলাকায় প্রথম, অভিজ্ঞ এবং বড় মাছচাষী মোশারফ হোসেন কাঁইয়া। তার অনুপ্রেরণা ও পরামর্শেই মূলত এ গ্রামের উদ্যোক্তারা মাছ চাষে ঝুঁকেছেন। বর্তমানে ভিটিপাড়া এলাকায় কোনও পরিত্যক্ত জলাশয় নেই। এমনকি ২ শতকের একটি ছোট গর্তও খালি নেই। যে যেভাবে পারছে মাছ চাষ করছে। যেখানে ইরি ধান হতো সেসব জমিতে এখন মাছ চাষ হয়। ধানের জমিগুলো এখন জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। এখন ধান কাটা শ্রমিক পাওয়া যায় না তাই জমির মালিকেরা মাছ চাষিদের কাছে জমি ভাড়া দিচ্ছে। এখন বরমী ইউনিয়নের ৯০ ভাগ জলাশয়ে মাছ চাষ হয়।’

শ্রীপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বদিউজ্জামান বলেন, ‘শ্রীপুর উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে ৭০টি খামারে মাছ চাষ হয়। এর আয়তন ৯৭ হেক্টর। এছাড়াও পারিবারিক পর্যায়ে মাছ চাষে জলাশয়ের পরিমাণ ৭’শ ১৬ দশমিক ৭৮ হেক্টর।’

আরও পড়ুন- শোল মাছ চাষে জাকিরের সাফল্য

/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তীব্র গরমে যেসব অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ে
তীব্র গরমে যেসব অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ে
চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানসহ ২৬ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত
উপজেলা নির্বাচনচেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানসহ ২৬ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন অপহরণের শিকার সেই প্রার্থী
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন অপহরণের শিকার সেই প্রার্থী
‘হোম অব ক্রিকেটে’ বাংলাদেশের স্পিন কোচ মুশতাক
‘হোম অব ক্রিকেটে’ বাংলাদেশের স্পিন কোচ মুশতাক
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ