X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

কুমিল্লায় বিলুপ্তির পথে ৫৫ প্রজাতির মাছ

মাসুদ আলম, কুমিল্লা
২০ জুলাই ২০১৮, ২৩:০৪আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৮, ১৩:৩১

মাছ ধরায় ব্যস্ত জেলেরা কুমিল্লার নদ-নদী,খাল-বিল দখল এবং পুকুর ও ডোবাসহ জলাশয় ভরাটের কারণে দিন দিন দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জেলেরা বেছে নিচ্ছেন অন্য পেশা। জেলার মেঘনা, গোমতী, তিতাস ও ডাকাতিয়াসহ বিভিন্ন নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর, দিঘিসহ নানা জলাশয় থেকে অন্তত ৫৫ প্রজাতির দেশি মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। ফসলি জমিতে কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, উন্মুক্ত জলাশয়ে বাঁধ নির্মাণ, কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য পানিতে গিয়ে পড়া, অবৈধ কারেন্ট জালের ব্যবহারসহ মাছের বিচরণক্ষেত্র পরিবর্তনের কারণেই মূলত এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে। গত ৭-৮ বছরে বেশ কয়েক প্রজাতির মাছ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলেও জানায় মৎস অফিস।

জানা যায়, কৃষি জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে দেশি প্রজাতির মা মাছগুলো প্রজনন কিংবা ডিম ছাড়তে পারে না। ফলে এসব অঞ্চলে ইদানিং দেশি মাছের উৎপাদন নেই বললেই চলে। এর ফলে বাধ্য হয়ে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত হাইব্রিড মাছ দিয়েই চাহিদা মেটাতে হচ্ছে মানুষকে। এছাড়া দেশি অনেক মাছ বিলুপ্তির কারণে স্থানীয় জেলেদের চরম দুর্দিন চলছে। সারাদিন নদীতে জাল পেতে বসে থাকলেও পরিবারের চাহিদা মেটাতে পারছেন না অনেক জেলে। নদীতে মাছ না পেয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন অনেকে। ফলে বাধ্য হয়ে বেছে নিতে হচ্ছে অন্য পেশা।

জেলা ও সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোর মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লার নদীগুলোর মধ্যে মেঘনা, তিতাস, গোমতীর বিভিন্ন খাল-বিল এবং ডাকাতিয়া নদীর শাখা নদী কাঁকর, ঘাঘুর, নদনা, মেল্লার খালসহ বেশ কিছু নদ-নদী ও খাল-বিল মাছের প্রধান উৎস। এক সময় এসব জলাভূমির দেশি মাছ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এখন অনেক প্রজাতির মাছই তেমন দেখা যায় না।

জেলা মৎস্য কার্যালয় আরও জানায়, বর্ষা মৌসুমে মা মাছগুলো ডিম ছাড়ে। কিন্তু ওই সময় এক শ্রেণির মৎস্য শিকারিরা এগুলো ধরায় ব্যস্ত থাকেন। এতে মাছের প্রজনন সীমিত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া অতি মুনাফার লোভে কতিপয় মৎস্য চাষি জলাশয় ইজারা নিয়ে কীটনাশক ব্যবহার করে মাছের আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করে ফেলছেন। এতেও হারিয়ে গেছে দেশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে ডাকাতিয়া নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারনেও মাছ শূন্য হয়ে পড়ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি ভরাট হলেও দেশি মাছ তেমন পাওয়া যাচ্ছে না।

জেলার মনোহরগঞ্জ, লাকসাম ও নাঙ্গলকোট উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, আগে এ অঞ্চলে যেসব দেশি প্রজাতির মাছ দেখা যেত, তার বেশির ভাগই এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত প্রজাতির এসব মাছের মধ্যে রয়েছে, ‘নানদিয়া, রিঠা, বাচা, ছেনুয়া, গাওড়া, নাপতিনী, বুইতা’ ইত্যাদি। এছাড়া ‘বাগাইড়, গোলসা, পাবদা, আইড়, নামাচান্দা, তারা বাইম, বড় বাইম, কালিবাউশ, দাঁড়কিনাসহ প্রায় ৫৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে।

মাছ ধরায় ব্যস্ত জেলেরা এ অঞ্চলের বেশ কয়েকজন মাছ শিকারি জানান, প্রায় এক যুগ আগেও কুমিল্লার জলাঞ্চল খ্যাত লাকসাম-মনোহরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করে আনন্দঘন পরিবেশে মাছ শিকার করা হতো। নদী ও খালের দুপাড়ে ভোর না হতেই হরেক রকম পণ্যের মেলা বসতো। আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে হৈহুলেল্লাড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরতো যুব-বৃদ্ধসহ নানা বয়সের মানুষ। এ সুযোগে ছোট ছোট ছেলে মেয়েসহ স্থানীয় মৎস্যজীবীরাও নেমে পড়তেন মাছ ধরতে। এখন আর এসব দৃশ্য দেখাই যায় না।

গত প্রায় ২০ বছর থেকে ডাকাতিয়া নদীতে মাছ ধরে আসছেন মনোহরগঞ্জ উপজেলা সদর এলাকার জেলে সুধীর চন্দ্র বর্মণ। তিনি বলেন, ‘আগে আনরা গাঙ্গের (নদী) মইদ্ধে ২-৩ ঘন্টা জাল বাইলে মাছে নৌকা হুরি যাইতো। অন আর গাঙ্গো মাছ নাই। হারা দিন জাল বাইলেও মাছ হাই না। বৌ-বাইচ্চা লই অন খুব কষ্ট কইত্তো অয়। গাঙ্গে আগের দিনের মাছ ধরার কতা কইলে মাইন্সে মনে করে কিচ্চা (গল্প) কই।’ নদীতে এভাবেই দেশি মাছের প্রাচুর্যতা হারিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দেন এই জেলে।

জেলার হোমনা এলাকার জেলে শাহ আলম ও মেঘনা এলাকার জেলে আবদুল কাদের জানান, তিতাস নদীতে আগে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো মাছ ধরতে। অনেকে সাইকেল, রিক্সা, প্রাইভেট কার, মাইক্রোসহ বিভিন্ন যানবাহনে পলো বেঁধে নিয়ে আসতো। আবার কেউ আগের দিন এসে থাকতো নদী বা খালের পাড়ে তাঁবু গেড়ে। এ সময় উৎসবমুখর হয়ে উঠতো পরিবেশ। এখন তা অতীত। নদীতে মাছ নেই। আমাদের পরিবারে সুখ নেই। তাই বাধ্য হয়ে অনেক জেলে মাছ ধরা ছেড়ে রিক্সা,অটোরিক্সা চালিয়ে দিন পার করছেন।

এসব প্রসঙ্গে জানতে জেলা মৎস কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস আকন্দ বলেন, ‘আমরা দেশি মাছ রক্ষায় প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। তবে দেশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে মাছের বিচরণ ক্ষেত্র ও প্রজনন ক্ষেত্র হ্রাস পাওয়া। এছাড়া নদীতে পলি জমে পানি না থাকা এবং অবৈধ কারেন্ট জালের ব্যবহারের কারনেও দেশি মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘মৎস অধিদপ্তর দেশি মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র বাড়াতে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেছে। তবে গণসচেতনতার মাধ্যমে জমিতে কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার রোধ, কারখানার বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা গেলে বিপন্নপ্রায় মাছ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।’


 

 

 

 

/আইএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা