X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘ব্রাশফায়ারে ছয় জন মারা যায়, গুলিবিদ্ধ ৯ জন কাতরাচ্ছিলাম’

এস এম রেজাউল করিম, ঝালকাঠি
১৫ আগস্ট ২০১৮, ১৭:২২আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০১৮, ১০:২১

বাঁ থেকে মায়ের কোলে সুকান্ত বাবু, মাঝে বিশেষ ভঙ্গিমায় সুকান্ত বাবু এবং শেষে শাহানারা আবদুল্লাহ, ছবি- সংগৃহীত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলার পাশাপাশি তার ভগ্নিপতি ও তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭ নম্বর মিন্টো রোডের বাড়িতেও হামলা করে ঘাতকেরা। সেখানে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কাতরাচ্ছিলেন পরিবারের আরও ৯ সদস্য। এদের মধ্যে একজন ছিলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্রবধূ, স্থানীয় সরকার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির বর্তমান সভাপতি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর স্ত্রী শাহানারা আবদুল্লাহ। সেদিনের মর্মন্তুদ ঘটনা প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

শাহানারা আবদুল্লাহ বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোর, সবে ফজরের নামাজের সময় হয়েছে। চারদিক থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল। এমন সময় অতর্কিত হামলায় কেঁপে উঠলো মিন্টো রোডের বাড়িটি। ঘাতকদের আগমনে ভয় পেয়েছিল আমার চার বছরের ছেলে সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত। সে আমার কোলে আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই ঘাতকরা চোখের সামনে গুলি চালিয়ে হত্যা করে সুকান্ত বাবুকে।’

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহানারা আবদুল্লাহ বলেন, ‘‘সেদিন (১৫ আগস্ট) ফজরের আজানের পর আমরা প্রচণ্ড গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। শব্দ আমাদের বাসার দিকেই আসছিল। গুলির শব্দে হঠাৎ করে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমার শাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগম) বললেন— বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দাও। এরপর আমার শ্বশুর আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুকে একটা ফোনও করেছিলেন। কিন্তু কী কথা হয়েছিল, বলতে পারবো না। এরইমধ্যে আমি শেখ ফজলুল হক মনি ভাইকে ফোন করলাম। ফোনে তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির দিকে কারা যেন গুলি করতে করতে আসছে, বুঝতে পারছি না।’ মনি ভাই বললেন, ‘কারা গুলি করছে দেখো।’ বললাম, ‘বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না।’ মনি ভাই বললেন—‘তারপরেও দেখো, কারা আসছে।’

সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ প্রসঙ্গে এরপর তিনি আরও বলেন—‘এরমধ্যেই ফোনটি আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে আমার শাশুড়ি মনি ভাইকে বলেন—‘বাবা বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমাদের বাঁচাও।’ একথা বলেই ফোন রেখে দিয়ে আমার শাশুড়ি আমার শ্বশুরকে বললেন—‘কী ব্যাপার, তুমি আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দিলা না?’ আমার শ্বশুর বলেন—‘তোমার ভাইও মনে হয় রেহাই পায়নি।’

ঘাতকদের প্রসঙ্গে শাহানারা আবদুল্লাহ জানান, ‘‘এদিকে ততক্ষণে আমাদের দরজা ভাঙার শব্দ পাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম—তোমরা সামনে এগোবে না, ভালো হবে না। এ সময় ওরা (ঘাতকেরা) থমকে দাঁড়ায়। ওই চিৎকারটি দিয়েছিলেন আমার স্বামী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। এরপর উনি দোতলায় চলে যান। কাজের বুয়া দরজাটা বন্ধ করে দেয়। দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর উনি আমাদের ঘরে না ঢুকে ডান পাশের রুমে ঢুকে যান। পরে আমরা জানতে পারি, সে সময় একটা ফোন আসে। ফোনটি রিসিভ করেন হাসানাত। খবর ছিল— মনি ভাই মারা গেছেন। এরমধ্যে ঘাতকেরা বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা রুমে ঢুকে ‘হ্যান্ডস আপ, হ্যান্ডস আপ’ বলে আমাদের সবাইকে কর্ডন করে নিচতলার ড্রইং রুমে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখে। সিঁড়ির অর্ধেক নেমেই বাবু (সুকান্ত বাবু) বলে, ‘মা আমি তোমার কোলে উঠবো।’ কিন্তু আমি ওকে কোলে নিতে পারলাম না। পাশে আমার ভাসুর (শহীদ সেরনিয়াবাত) ওকে কোলে নিলো। নিচে নামার পর ভারী অস্ত্র ঠেকিয়ে ওরা (ঘাতকেরা) আমাকে জিজ্ঞাসা করে—‘উপরে আর কে কে আছে?’ এমন সময় আমার শ্বশুর আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে তার চোখের ইশারায় আমি বললাম—ওপরে আর কেউ নেই। তাই উপরের রুমগুলো তল্লাশি না হওয়ায় আমার স্বামী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে ওরা খুঁজে পায়নি।’’

সে সময়কার কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা প্রসঙ্গে শাহানারা বলেন—‘তখনও আমরা বুঝতে পারছিলাম না, ওরা আমাদের মারতে এসেছে, নাকি গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। আমার শ্বশুর ওদের বললো—‘তোমরা কী চাও। তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে।’ ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে—‘আমরা কিছুই চাই না। আমাদের কোনও কমান্ডিং অফিসার নেই।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাতকেরা ব্রাশফায়ার করে। আমরা মাটিতে পড়ে যাই।’’

‘শহীদ ভাইকে ঠেকিয়ে ওরা গুলি করে। উনি সঙ্গে সঙ্গে উপুড় হয়ে পড়ে যান। আমার শ্বশুরের শরীর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। আমার শরীরের পেছনের অংশে হাত দিয়ে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। ওরা চলে যেতে লাগলো। তখনও আমার জ্ঞান ছিল। এরমধ্যেই কে যেন কান্না করে ওঠে। এরপর ঘাতকরা আবারও দৌড়ে এসে ব্রাশফায়ার করে। এবার ওরা নিচ দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। আমার শ্বশুর সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। আমি আমার শ্বশুরের পেছনে ছিলাম, আমার কোমরে গুলি লাগে। সে সময় ব্রাশফায়ারে ছয়জন মারা যান। আমরা গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ৯ জন কাতরাচ্ছিলাম।’ একটু থেমে শাহানার ফের বলেন, ‘এরমধ্যে আবারও একদল লোক গাড়ি নিয়ে আসে। তখন ভাবলাম—এই বুঝি শেষ। কিন্তু পরে দেখি রমনা থানার পুলিশ এসেছে। তারা আমার শ্বশুরের পালস দেখে বলে, বাড়ির কেউ আহত আর কেউ মারা গেছে।’

শিশু সুকান্তর মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ আসার পর বাবুকে শহীদ ভাইয়ের বুকের নিচ থেকে উঠানো হল। দেখলাম ওর নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কিছু সময় আগে যে সন্তান আমার কোলে উঠতে চেয়েছিল, তাকে কোলে নিতে পারি নাই, সেই সন্তানের নিথর দেহ আমার চোখের সামনে।’

ছেলের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন—‘আমার বাবু ছিল অসম্ভব মা-ভক্ত। আমি যখন যা বলতাম, তাই শুনতো। ও মাঝে মধ্যে বলতো—মা তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে ঘাসের মধ্যে গিয়ে শুয়ে থাকবো।’

সেই ভয়াল কালরাতে তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ঢাকার মিন্টো রোডের বাসায় বরিশালের ছয়জন নারী-পুরুষ নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন। তারা হলেন—সাবেক মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত এবং বরিশালের ক্রিডেন্স শিল্পগোষ্ঠীর সদস্য আব্দুর নঈম খান রিন্টু। আর আহত হয়েছিলেন ৯ জন। তারা হলেন—আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের স্ত্রী আমেনা বেগম, বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ, বিউটি সেরনিয়াবাত, হেনা সেরনিয়াবাত, আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, খ ম জিল্লুর রহমান, ললিত দাস ও সৈয়দ মাহমুদ।’

/এএইচ/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক রকেট হামলা হিজবুল্লাহর
ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক রকেট হামলা হিজবুল্লাহর
হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, গ্রেফতার ৫
হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, গ্রেফতার ৫
ন্যাটোর কোনও দেশ আক্রমণের পরিকল্পনা নেই রাশিয়ার: পুতিন
ন্যাটোর কোনও দেশ আক্রমণের পরিকল্পনা নেই রাশিয়ার: পুতিন
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
‘বউদের ভারতীয় শাড়ি পোড়ালে বর্জনের কথা বিশ্বাস করবো’
বিএনপির নেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী‘বউদের ভারতীয় শাড়ি পোড়ালে বর্জনের কথা বিশ্বাস করবো’