X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের চাপে নাকাল স্থানীয়রা

আবদুল আজিজ, কক্সবাজার
২৬ আগস্ট ২০১৮, ২০:১৫আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০১৮, ২০:১৭

 

রোহিঙ্গাদের চাপে নাকাল স্থানীয়রা মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা বিপাকে পড়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, কক্সবাজার এলাকার সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন খাত এখন বিপর্যয়ের মুখে। বিশেষ করে বনভূমি, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধ্বংসের পথে। দখল-দূষণসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন তারা। স্থানীয়দের এসব অভিযোগ স্বীকার করে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের মধ্যে অনেকের ভিটে পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে।’

স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে মোট ১১ লাখ ১৬ হাজার ৪১৭জন রোহিঙ্গার বসবাস। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর সঙ্গেই রয়েছে স্থানীয়দের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বসতি ও চাষযোগ্য জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই বিপুল জনগোষ্ঠী উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ৬ হাজার একর বনভূমির দখল করে রেখেছে। অনেকের ভিটে-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও চাষাবাদের জমিও দখলে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। একইভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপর্যয়ের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমেছে ধস। 

ভূমি দখল

উখিয়ার বালুখালী ২নং ক্যাম্পের বালুখালীর ছড়া নামক এলাকার একটু সামনে যেতেই দেখা হয় স্থানীয় বনকর্মী কবির আহমদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘২০ বছর ধরে এই বনভূমিতে বসবাস করে আসছি। পাশাপাশি স্থানীয় বনবিভাগকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছি। কিন্তু আজ সব বনাঞ্চল ও পাহাড় রোহিঙ্গারা দখলে নিয়েছে।’

উখিয়া ডিগ্রি কলেজের বাণিজ্য বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র শামসুল আলম বলেন, ‘হঠাৎ লাখো রোহিঙ্গা আমাদের এলাকায় বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। বাড়ির পাশে চাষযোগ্য জমিও কম ছিল না। কিন্তু, এখন রোহিঙ্গারা আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। আমার ৫ একর জমি ছিল এখন সবখানে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ও তাদের বসতি।’ 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান ব্যাহত

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে। এসব এলাকার স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোয় রোহিঙ্গাদের অবস্থান, আনসার, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্থায়ী ব্যারাক স্থাপন, শ্রেণিকক্ষে মেডিক্যাল টিম, ত্রাণ কেন্দ্র, লঙ্গরখানার রান্নাঘর, আসবাবপত্র মজুদ করার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াত নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এরফলে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন উপস্থিতি কমে অর্ধেকে নেমেছে। এ কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন স্থানীয় অভিভাবক ও স্থানীয়রা।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উখিয়ার কুতুপালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি লাখ-লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে কুতুপালং এলাকায়। এসব রোহিঙ্গার মানবিক সেবায় বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষ বিভিন্নভাবে দখল হয়ে গেছে। এ কারণে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে মেডিক্যাল টিম, অন্য দুটিতে আনসার ও পুলিশ ব্যারাক, বিদ্যালয়ে নিচে লঙ্গরখানার সরঞ্জাম ও মাঠে বিশাল তাঁবু নিয়ে তৈরি করা হয়েছে লঙ্গরখানার রান্নাঘর। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চলতে থাকায়  স্কুলের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।’ 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান ব্যাহত সম্পর্কে জানতে চাইলে উখিয়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ফজলুল করিম বলেন, ‘আমরা মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু আমাদের তো বাঁচতে হবে? আজ একবছর ধরে কলেজের পুরো মাঠ ও অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের গুদাম ও অফিসের জন্য ছেড়ে দিতে হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান স্বাভাবিকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।’

বনভূমি ধ্বংস

কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং বাজার থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিতে অবস্থিত লম্বাশিয়া ও মধুরছড়া। এই ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গা বসতি আর বসতি। লম্বাশিয়া এলাকা পার হয়ে এখন মধুরছড়ার পুরোটাই দখলে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। পাহাড় কাটার পাশাপাশি গাছ গাছালির শেকড় পর্যন্ত কেটে সাবাড় করেছে তারা। এই রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় বাংলাদেশিরা ভূ-সম্পদ হারিয়েছে। তাদের গৃহপালিত গরু, ছাগল ও মহিষের আবাস্থল বেদখল হয়ে গেছে। এসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের জন্য ২ হাজার একর জমি নির্ধারণ করলেও এখন ৪ হাজার একর চলে গেছে রোহিঙ্গাদের দখলে।

জানতে চাইলে কুতুপালং গ্রামের ব্যবসায়ী বশির উল্লাহ বলেন, ‘রোহিঙ্গা আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। আমার ৪টি গবাদি পশু রয়েছে। কিন্তু, চরানো মতো কোনও জায়গা নেই। এতে আমার গরুগুলোর স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে। আমাদের জমি-জমা এখন রোহিঙ্গাদের দখলে।’

প্রায় একই অভিযোগ উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের ভেতর অবস্থিত স্থানীয় যুবক হেলাল উদ্দিনেরও। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এসে শুধু বসতি নয়, পুরো সবুজ গাছ গাছালি কেটে সাবাড় করে ফেলেছে। পাহাড়ের মাটি কাটার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির গাছের মুল ও শেকড় উৎপাটন করেই চলেছে। একের পর এক পাহাড় কেটে ফেললেও স্থানীয় বনবিভাগ যেন অসহায়।’   

বনভূমি ধ্বংসের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মো. আলী কবির বলেন, ‘বনবিভাগের উখিয়া রেঞ্জের এই বনভূমিগুলোর মধ্যে এখন ১০হাজার একর জমি রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। এরমধ্যে কুতুপালং রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পসহ পুরনো রোহিঙ্গারা দখলে নিয়েছিল প্রায় ৬ হাজার একর। আর এখন নতুন করে রোহিঙ্গারা এসে দখলে নিয়েছে আরও ৪ হাজার একর জমি। তবে সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য যে ২ হাজার একর জমি নির্ধারণ করেছে, সে জমিগুলোও দখলে নেওয়া জমির ভেতর পড়েছে।’

কক্সবাজারে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ও রাজাপালং ইউনিয়নের এক লাখ সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকায় বনভুমির ওপর বসবাসরত মানুষ তাদের চাষযোগ্য জমি ও বসতি হারিয়েছে। থাকার একমাত্র ঘরটি ছাড়া ভিটা পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে।’  

এদিকে, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে স্থানীয় ঈদ উপহার থেকে শুরু করে চাল, ডাল, কাপড় ও এলপি গ্যাস থেকে শুরু নানা সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর ও আশপাশের এলাকা ছাড়াও পুরো জেলার সাধারণ মানুষের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে সরকার।’

 

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?