পূজায় এবার একসঙ্গে খুব আনন্দ করবো-এমনটাই মাকে জানিয়েছিলেন গার্মেন্ট কর্মী নিরাঞ্জন। সোমবার রাতে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। গাড়ি না পেয়ে টাইলসবাহী ট্রাকে উঠেছিলেন পরিবার নিয়ে। কিন্তু তাদের বাড়ি ফেরা হয়নি। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গাড়ি উল্টে স্ত্রী, সন্তানসহ নিহত হন নিরাঞ্জন। একদিকে সন্তানের মৃত্যু শোক, অন্যদিকে সংসারের একমাত্র উপর্জানক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে কান্না থামছে না তার স্বজনদের।
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল পৌর এলাকার শাখারুঞ্জ মহল্লার নিরাঞ্জনের বাড়িতে মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা-মাসহ স্বজনদের আহাজারি। নিরাঞ্জনের মা সুমতি রাণী বলেন, ‘পূজার তিন দিনের ছুটি কাটাতে বাড়ি আসছিল আমার বাবা (নিরাঞ্জন)। বাবার সঙ্গে আমার ফোনে শেষ কথা হয় সোমবার রাত ১১টায়। বলেছিল,বাস না পেয়ে ট্রাকে চড়ে বাড়ি ফিরছি। তোমরা চিন্তা করো না,আমি টাকা নিয়ে আসছি। সবাই একসঙ্গে এবার খুব আনন্দ করবো পূজায়। সেই কথায় যে বাবার শেষ কথা হবে আমি বুঝতে পারিনি। খরচ দেওয়ার মতো আমার যে আর কেউ থাকলো না।’
বাবা ফটিক চন্দ্র কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘গ্রাম পুলিশের চাকরি হারানোর পর তিন বছর থেকে বাবা আমাদের সংসার খরচ চালাতো। বাবা খরচ না দিলে আমাদের না খেয়ে মরতে হতো। আমাদের অথৈ সাগরে ফেলে বাবা আমার চলে গেল। আমরা এখন কী খেয়ে বাঁচবো?’
ফটিক চন্দ্রের দুই ছেলের মধ্যে নিরাঞ্জন ছিল উপার্জনক্ষম। ফটিক গ্রাম পুলিশের চাকরি করতেন একসময়। জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স ভুলের কারণে তিন বছর আগে চাকরি হারান তিনি। তথ্য সংশোধন করেও সেই চাকরি আর ফিরে পাননি তিনি। এরপর পরিবারকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে নিরাঞ্জন দুই স্ত্রী ও দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গাজীপুরে চলে আসে। সেখানে একটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন তিনি। বাড়িতে দাদির কাছে থাকতো তার ছেলে সাধন চন্দ্র। প্রতিমাসে তিন হাজার টাকা খরচ পাঠাতেন বাবা-মা’র জন্য।
ছেলের সঙ্গে কথা বলার পর বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ২টার দিকে নিরাঞ্জনের দ্বিতীয় স্ত্রী লিপি রানী ফোন করে জানায়, ট্রাক উল্টে নিরাঞ্জন, মেয়ে স্বর্ণা রানী ও প্রথম স্ত্রী সাগরী রানী মারা গেছেন। আর তিনি ও তার মেয়ে প্রেমা গুরুতর আহত হয়েছেন।
এবার পূজায় বাবা-মাকে নতুন কাপড় কিনে দেওয়ার কথা ছিল নিরাঞ্জনের। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা সবকিছু ওলোট-পালোট করে দিল।
ক্ষেতলাল পৌরসভার স্থানীয় কাউন্সিলর জুলফিকার আলী চৌধুরী বলেন,গ্রাম পুলিশের চাকরি হারানোর পর থেকে ফটিক চন্দ্র খুব অসহায় হয়ে পড়েন। সংসারের খরচ চালানোর সামর্থ্য ছিল না তার। ছেলে নিরাঞ্জন গার্মেন্টে চাকরি করে বাবাকে সংসারের খরচ দিতেন।
প্রসঙ্গত, সোমবার রাত ২টার দিকে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের টাঙ্গাইলের মীর্জাপুর সুবল্লা সেতু এলাকায় ট্রাক উল্টে নিরাঞ্জন (৩৫), তার স্ত্রী সাগরী রানী (২৮) ও মেয়ে স্বর্ণা রানী (৭) মারা যায়। আর দ্বিতীয় স্ত্রী লিপি রানী ও মেয়ে প্রেমা গুরুতর আহত হয়। তাদের টাঙ্গাইলের কুমুদিনি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
টাঙ্গাইলে ট্রাক উল্টে একই পরিবারের নিহত ৩