পঞ্চগড় জেলার পাঁচ উপজেলার মৎস্য অভয়াশ্রমগুলোতে অবাধে চলছে মাছ শিকার। অভিযোগ উঠেছে, মৎস্য বিভাগ এ বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রকাশ্যে দিনের আলোতেই মাছ শিকারের নামে চলছে হরিলুট। মাছ চুরি ঠেকাতে গিয়ে প্রভাবশালী অসাধু একটি মহলের হাতে করতোয়া মৎস্য অভয়াশ্রমের এক প্রহরী খুন হলেও মাছ চুরি থামছে না। বরং অভয়াশ্রমের মাছ অবৈধভাবে শিকার করার পর তা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি ও মৎস্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার বাড়িতেও পৌঁছে যাচ্ছে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত করতোয়া মৎস্য অভয়াশ্রমসহ পঞ্চগড়ের মৎস্য অভয়াশ্রমগুলো বর্তমানে মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে মৎস্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের নীরবতায় জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
জানা গেছে, পঞ্চগড় জেলার পাঁচ উপজেলার নদীনালা ও খাল বিলে ১৪টি মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়েছে। জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার সদরের চীন মৈত্রী সেতু সংলগ্ন করতোয়া মৎস্য অভয়াশ্রম, ধুলাঝারি অভয়াশ্রম, দেবীগড় অভয়াশ্রম, পাথরাজ নদীর পাখিপড়া মনি অভয়াশ্রম, বোদা উপজেলার করতোয়া নদীর বোয়ালমারী অভয়াশ্রম, টেকরামনি অভয়াশ্রম, পঞ্চগড় সদর উপজেলার করতোয়া নদীর নলকুরা অভয়াশ্রম, তালমা নদীর তালমা অভয়াশ্রম, চাওয়াই নদীর চাওয়াই অভয়াশ্রম, তেঁতুলিয়া উপজেলার করতোয়া নদীর কালিয়ামনি অভয়াশ্রম ও ভেরসা নদীর ভেরসা অভয়াশ্রম উল্লেখযোগ্য। অভয়াশ্রমগুলোর অধিকাংশই করতোয়া নদী বেষ্টিত।
জেলার সবচেয়ে বড় মৎস্য অভয়াশ্রম দেবীগঞ্জের চীন মৈত্রী সেতু সংলগ্ন করতোয়া অভয়াশ্রম। এই মৎস্য অভয়াশ্রমটিতে ২০০৬ সালে মাছ সংরক্ষণ শুরু হলে ভালোভাবে কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। ২০১৩ সালে মৎস্য অভয়াশ্রমটি জাতীয়ভাবে স্বর্ণপদক লাভ করে। এরপর থেকেই অভয়াশ্রমের মাছ চুরির অভিযোগ উঠে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ অভয়াশ্রমের জেলেদের বিরুদ্ধে। এখানে ২ থেকে ২০ কেজি ওজনেরও মাছ দেখতে পাওয়া যেতো। সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে মাছের গতিবিধি দেখতেন শত শত পর্যটক। তবে অভিযোগ উঠেছে, মাছের লোভ সামলাতে না পেরে রাতে ও দিনের বেলা এখান থেকে মাছ চুরি করতে করতে বর্তমানে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত এই ভয়াশ্রমটি এখন মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। 
সরেজমিন দেখা যায়, করতোয়া সেতুর পূর্ব পাড়ে নদীর তীররক্ষা বাঁধের নিচে বিভিন্ন বয়সী লোকজন বড়শি দিয়ে মাছ ধরছেন। কেউ কেউ নদীর অল্প পানির মধ্যে বালির বস্তা ফেলে তার ওপর বসে মাছ ধরে চলেছে। একই অবস্থা পঞ্চগড়ে নলকুরা ও বোদার বোয়ালিমারী অভয়াশ্রমসহ অন্য অভয়াশ্রমগুলোতেও। নলকুরা অভয়াশ্রমে গিয়ে দেখা যায়, দিনের বেলাতেই বড়শি দিয়ে মাছ ধরছেন ৩/৪ জন স্থানীয় যুবক। ক্যামেরা দেখেই বড়শি নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন তারা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিনের চেয়ে রাতের বেলাতেই বেশি মাছ চুরি হয়। অভয়াশ্রমের মৎস্যজীবী সমিতি থেকে পাহারাদার নিযুক্ত করলেও তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে চলছে মাছ ধরা। গত বছরের ২৩ অক্টোবর মাছ চুরিতে বাধা দেওয়ায় বিশুদাশ (৩৫) নামের ওই মৎস্য অভয়াশ্রমের নৈশপ্রহরীকে হত্যা করে মাছ চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্বৃত্তরা। এ বিষয়ে আদালতে একটি হত্যা মামলা চলমান রয়েছে।
আরও অভিযোগ রয়েছে, কোথাও কোথাও সমিতির সদস্যরাও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। কোনও অভয়াশ্রমেই মৎস্য বিভাগের কোনও নজরদারি নেই। প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের নাকের ডগায় নিয়মিত মৎস্য অভয়াশ্রমের মা মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিধন করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মৎস্য অভয়াশ্রমগুলোতে অবাধে মাছ চুরি হওয়ায় একদিকে সাধারণ মৎস্যজীবীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, ঠিক তেমনি মৎস্য বিভাগের মূল উদ্দেশ্যও ভেস্তে যাচ্ছে।
দেবীগঞ্জে ঘুরতে আসা শাহীন আলম বলেন, ‘আগে আমি মাঝে মাঝে এখানে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘুরতে আসতাম। সেতুর ওপর থেকেই বড় বড় মাছ ভেসে থাকতে দেখা যেতো। শিশুরা এই অভয়াশ্রমের মাছ দেখে খুব মজা পেতো। কিন্তু এখন কোনও মাছের দেখা নেই।’
দেবীগঞ্জ বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘করতোয়া মৎস্য অভয়াশ্রমটি দিনের পর দিন একটি চক্র কখনও গোপনে, কখনও প্রকাশ্যে মাছ ধরে মাছশূন্য করে ফেলেছে। কিন্তু আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শক্ত কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখছি না। বিশেষ করে মৎস্য বিভাগের কোনও নজরদারিই নেই।’
দেবীগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পরিমল দে সরকার বলেন, ‘আমরা এই মৎস্য অভয়াশ্রমের জন্য স্বর্ণপদক পেয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখন আমাদের দলীয় একটি চক্র এবং সমিতির জেলেরাও মাছ ধরার পক্ষে। চক্রটি শক্তিশালী হওয়ায় আমরা তাদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারিনি। এখানে মাছ চুরিতে বাধা দেওয়ায় খোদ প্রহরীকে খুন হতে হয়েছে। এটি মা মাছ সংরক্ষণের একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল। কিন্তু তারা তা নষ্ট করে ফেলেছে।’
বোদা উপজেলার নলকুরা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য সুরুত জামান বলেন, ‘দিনরাত স্থানীয় জেলে ও প্রভাবশালীরা এখানে মাছ চুরি করে। কখনও কারেন্ট জাল দিয়ে, আবার কখনও বড়শি দিয়ে বড় বড় মাছ ধরে নিয়ে যায়। আমরা বাধা দিতে গেলেই আমাদের ওপর হুমকি আসে। মৎস্য অফিসে জানালে তারা মাছ চুরির সঙ্গে জড়িতদের ধরে নিয়ে যেতে বলে। এটা কী আমাদের পক্ষে সম্ভব।’
বেলাল হোসেন নামে আরেক জেলে বলেন, ‘যারা মাছ ধরতে আসে তারা সমিতির নেতা বা ঊর্ধ্বতনদের লোক বলেই আসে। তাই আমরা নিষেধ করলে উল্টো আমাদেরই হুমকি দেয়।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. আফতাব হোসেন বলেন, ‘অভয়াশ্রমের বিষয়টি সমিতির সদস্যরা দেখভাল করেন। মাঝে মাঝে অভিযোগ পেলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি। এর বাইরে আমাদের কিছু করার নেই।’
এদিকে জেলার মৎস্য অভয়াশ্রমগুলোর বিষয়ে তথ্য জানতে গেলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. আফতাব হোসেন সিনিয়র সহকারী পরিচালক আশরাফুজ্জামানকে দেখিয়ে দেন। আবার সিনিয়র সহকারী পরিচালক আশরাফুজ্জামানের কাছে তথ্য চাইতে গেলে তিনি দেখিয়ে দেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. আফতাব হোসেনকে। তবে ড. আফতাব হোসেনের কাছে গেলে জেলা মৎস্য অফিস থেকে পাওয়া অভিযোগগুলোর বিষয়ে কোনও উত্তর বা তথ্য পাওয়া যায়নি।
