ঢাকার কাছের জেলা মানিকগঞ্জে ছড়িয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উত্তাপ। সিংগাইর উপজেলা, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার একাংশ ও হরিরামপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। তবে নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকায় এই আসনে এবার আওয়ামী লীগের অবস্থা কিছুটা নাজুক। এছাড়া জাতীয় পার্টির সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোট হলে জাপার টার্গেটেও রয়েছে মানিকগঞ্জের এই আসনটি। অন্যদিকে দীর্ঘদিন এই আসনটিতে শক্ত অবস্থান ধরে রাখা বিএনপি আসনটিতে নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে চায়। আওয়ামী লীগের স্থানীয় গ্রুপিং কোন্দল এবং মহাজোটের ভাগ বাটোয়ারার ফাঁকে নিজেদের ফায়দা তুলে নিতে চায় দলটি।
বরাবরের মতো মনোনয়ন নিয়ে এবারও আওয়ামী লীগে রয়েছে প্রকাশ্য বিরোধ। এবার আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন বর্তমান এমপি মমতাজ বেগম, শক্ত প্রতিপক্ষ সাবেক কেন্দ্রীয় যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য ও জেলা পরিষদের সদস্য শিল্পপতি ইঞ্জিনিয়ার সালাম চৌধুরী, শিল্পপতি গোলাম মনির হোসেন। এছাড়া সাবেক এমপি সামসুদ্দিনের নামও শোনা যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের ফলে সিঙ্গাইর ও হরিরামপুর উপজেলা এবং মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয় মনিকগঞ্জ-২ নং আসন। এর আগে সিংগাইর উপজেলা এবং মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে এই আসনটি ছিল মানিকগঞ্জ-৩।
সে সময় হরিরামপুর ও শিবালয় উপজেলা নিয়ে ছিল মানিকগঞ্জ-২। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনটি নির্বাচনে বর্তমান মানিকগঞ্জ-২ অর্থাৎ সিংগাইর ও মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি ইউনয়ন নিয়ে গঠিত আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন বিএনপির সাবেক শিল্পমন্ত্রী শামসুল ইসলাম খান নয়া মিয়া। ২০০৬ সালে তিনি মারা গেলে উপনির্বাচনে তার ছেলে বর্তমান জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মঈনুল ইসলাম খান শান্ত এই আসনে নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তার জায়গায় মনোনয়ন পান সাবেক মন্ত্রী হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মেয়ে বর্তমান জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা।
নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী আব্দুল মান্নানের কাছে ২১ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। সেসময় আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দিয়ে জাতীয় পার্টিকে সমর্থন করে। জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খানম রিতা এবারও এই আসনে মনোনয়ন চাইবেন। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মঈনুল ইসলাম খান শান্ত একজন শক্তিশালী প্রার্থী। এছাড়া আরেক প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন হরিরামপুর উপজেলা চেয়ারম্যান শিল্পপতি সাইফুল হুদা চৌধুরী শাতিল।
২০০৮ সাল থেকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দলের সভাপতি আফরোজা খান রিতার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্ব চরমে। সেই থেকে জেলায় দুটি পৃথক গ্রুপ সক্রিয়। যার প্রভাব আগামী নির্বাচনেও ফলার আশংকা রয়েছে এই আসনটিতেও। এই আসনের উপজেলা দুটিতেই এখন রিতা ও শান্তর নামে বিএনপির নেতা কর্মীরা বিভক্ত।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমকে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বাঘাবাঘা প্রার্থী থাকলেও সরাসরি মনোনয়ন দেয়া হয় তাকে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ- নির্বাচিত হয়েই তিনি তার এলাকায় আওয়ামী লীগের একক প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। নিজেই হয়ে যান সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার নির্বাচনি এলাকা সিংগাইর ও হরিরামপুর এবং সদর উপজেলার একাংশের তৃণমুল পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করান। তবে নিজের পছন্দের লোকজন দিয়ে কমিটি গঠন করায় তিনি সমালোচিত হয়ে পড়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বাদ দেওয়া হয়েছে অনেক পুরানো এবং পরিক্ষীত নেতাদের।
এ নেতাকর্মীদের নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়া বিষয়ক সাবেক সম্পাদক প্রখ্যাত ফুটবলার দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল বড় ধরনের একটি বলয় তৈরি করেছেন। তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাও রয়েছেন তার পক্ষে। প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ভেতরে তারা শফিউল আরেফিন টুটুলের নেতৃত্বকেই পছন্দ করেন। স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিমত এই দুই গ্রুপকে একত্রিত করতে না পারলে আগামী নির্বাচনে আসনটি আওয়ামীলীগে হাত ছাড়া হওয়ার সমুহ সম্ভবনা রয়েছে।
অপর দিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী না হলেও জোটগতভাবে নির্বাচন হলে এই আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ২০০৮ সালের সংসদ সদস্য এসএম আবদুল মান্নান মনোনয়ন পেতে পারেন।
সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম বলেন, এবারও এমপি মনোনয়ন চাইবো। কারণ আমার সময় নির্বাচনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তাই আমি মনে করি দল আমার এই কাজের মূল্যায়ন করবে। দলের তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক কাঠামো মজবুত করেছেন দাবি করে তিনি আরও বলেন, ‘তৃণমূলের ও নারীদের অধিকাংশ জনমত আমার পক্ষে রয়েছে।’
তবে আওয়ামী লীগের যেকোনও নেতা দলের কাছে মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মনোনয়ন প্রত্যাশী দেওয়ান শফিঊল আরেফিন টুটুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ৯ বছরের বেশি সময় ধরে সারা দেশে ব্যপক উন্নয়ন হয়েছে। মানিকগঞ্জের অন্য দুটি আসনে তার প্রতিফলন হলেও আমাদের আসনে তার ছোঁয়া লাগেনি। মনোনয়ন পেলে এবং নির্বাচিত হলে ঢাকার পাশের সম্ভাবনাময় এ অঞ্চলকে আগামীতে আরও উন্নত করতে কাজ করবো।
জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহি সদস্য ও জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য আব্দুস সালাম চৌধুরী। ব্যক্তি ইমেজ ও দলের জন্য নিবেদিত কর্মী সদালাপী ইঞ্জিনিয়ার সালাম চৌধুরী ইতোমধ্যে নেতাকর্মীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এছাড়া তালিকায় রয়েছে হাটিপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং মম জর্দার মালিক শিল্পপতি গোলাম মনির হোসেন, মানিকগঞ্জ (মহুকুমা) জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান চৌধুরীর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তারিকুর রহমান চৌধুরী উইলটন।
জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা বলেন, দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। সেই কাজের মূল্যায়ন হিসেবে এবার মনোনয়নের দাবি রয়েছে। আশা কারি দল আমার কাজের মূল্যায়ন করবে।
অন্যদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রসঙ্গে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মঈনুল ইসলাম খান শান্ত বলেন, নির্বাচন হলে আমি মনোনয়ন পাবো বলে আশাবাদী। কারণ দলের জন্য আমার বাবা ও আমার অনেক ত্যাগ রয়েছে। এছাড়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবেও আমি মনোনয়নের দাবিদার।
২০০৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসাবে জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জেলা জাপার সভাপতি এসএম আব্দুল মান্নান এই আসনের শক্ত প্রতিপক্ষ বিএনপি আফরোজা খান রিতাকে ১৮ হাজারের বেশী ভোটে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সাবেক এমপি এসএম মান্নান বলেন, মহাজোটে থাকার কারণে দলের সিদ্ধান্তে গত নির্বাচনে সরে দাঁড়িয়েছিলাম। এবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। মহাজোটগতভাবে নির্বাচন হলে এই আসনে মনোনয়ন চাইবো।