মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার কামতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থী ২২ জন। আর দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মাত্র একজন। সারা বছর এক ক্লাসে সেই একজন ছাত্রকেই পড়ান শিক্ষকরা। স্কুলে আসার কোনও রাস্তা না থাকা, আশপাশের এলাকায় জনবসতি কমে যাওয়া এবং আরও কয়েকটি স্কুল গড়ে ওঠায় এই ছাত্র সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ঘিওর উপজেলার দুর্গম গ্রাম নিমতা। যে স্থানটিতে স্কুলটির অবস্থান, তার প্রায় দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনও জনবসতি নেই। ওই গ্রামটির মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬’শ। এই গ্রামটি তিনটি উপজেলার সীমান্তঘেরা। ৪৬ বছর আগে এই গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় নিমতা প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্তমানে স্কুলটির পাকা ভবন হয়েছে। স্কুলের প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২২ শিক্ষার্থী রয়েছে। আর দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মাত্র একজন। নাম শাওন মোল্লা। কোনও সহপাঠী না থাকলেও বছরের শুরু থেকে বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে নিয়মিত ক্লাস করে যাচ্ছে সে। বিদ্যালয়ের হাজিরা খাতা ঘেঁটে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে গত ২২ নভেম্বর পর্যন্ত শুধু এক দিন ক্লাসে আসতে পারেনি শাওন মোল্লা।
স্কুলে গিয়ে দেখা যায় দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠকক্ষে বেলী মন্ডল নামে এক শিক্ষিকা ক্লাস নিচ্ছে। সেখানে ৯টি বেঞ্চ থাকলেও মাত্র একজন শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন তিনি। বেলী মন্ডল জানালেন, এই ক্লাসে একমাত্র শিক্ষার্থী সেখানে বসা শাওন মন্ডল। অন্য দুটি কক্ষে গিয়ে দেখা গেলো দুই-তিন জন করে শিক্ষার্থী উপস্থিত রয়েছেন।
তিনি আরও জানালেন, তাদের স্কুলের শিশু শ্রেণিতে (প্রি-ওয়ান) শিক্ষার্থী ৩ জন, প্রথম শ্রেণিতে ৪ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে (তিনি যে ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন) ১ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৪ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৫ জন আর পঞ্চম শ্রেণিতে ৫ জন। সবমিলে পুরো স্কুলে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২২ জন।
শিক্ষার্থী শাওন মোল্লা জানায়, শিশু শ্রেণিতে গত বছর সে ও আরেকজন ভর্তি হয়েছিল। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর ওই সহপাঠী অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এখন সে একা একা ক্লাস করে। এতে তার ভালো লাগে না।
এব্যাপারে কথা হয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন কুমার মন্ডলের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘বিদ্যালয়টিতে শিক্ষকতা করছি ১৯৮২ সাল থেকে। ১৯৭২ সালের দিকে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর বেসরকারি বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ (সরকারি করণ) হয় ২০১৩ সালে। ওই সময় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্য ছিল দেড় শয়ের ওপরে।’ স্কুলের বর্তমান চিত্র তুলে ধরে তিনি জানান, ‘সকালের শিফটে ৮ জন ও দুপুরে শিফটে ১৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। আর দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মাত্র ১ জন।’ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় এবং কাছাকাছি এলাকায় জনবসতি কম থাকায় শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে শিক্ষকের সংখ্যা ৪ জন।’
তিনি আরও জানান, স্কুলের আশপাশের গ্রামগুলো মিলিয়ে জনসংখ্যা সাড়ে ৬’শ মতো। ২০১৮ সালে ১৩ জন শিশু ভর্তি হওয়ার উপযুক্ত ছিল। কিন্ত নিমতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে মাত্র একজন ছেলে ও ২ জন মেয়ে। বাকি শিশুরা ভর্তি হয়েছে অন্য বিদ্যালয়ে। তবে বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনি পরীক্ষায় গত ৩ বছরে যে কয়জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছিলো সবাই পাস করেছে। এবারও ৫ জন শিক্ষার্থী সমাপনিতে অংশ নিয়েছে।
নিরঞ্জন কুমার মন্ডল আরও জানান, ‘শিক্ষার্থী কম থাকায় আমাদেরও পড়াতে ভালো লাগে না। আশপাশের এলাকায় প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বোঝানো হয় তারা যেন আমাদের বিদ্যালয়ে তাদের সন্তানদের পাঠান। কিন্তু শিক্ষার্থী কম থাকায় অনেক অভিভাবক মনে করেন বিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতা নেই। ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করে কী হবে, এছাড়া বিদ্যালয়ে আসার মতো কোনও রাস্তা নেই, বর্ষা সময় নৌকা ছাড়া আসা যায় না। এসব চিন্তা করেই অনেকই তাদের সন্তানদের আমাদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন না।’
স্কুল আঙ্গিনায় কথা হয় চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী শিশির মোল্লার মা শেফালি বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, তার চার সন্তানের মধ্যে তিন মেয়েই এই বিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করে গেছে। একমাত্র ছেলে শিশিরও এখানেই পড়ে। শিক্ষকরা অনেক যত্ন করে তাদের সন্তানদের পড়ান। কিন্তু তার পরও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি না হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ে আসার মতো কোনও রাস্তা নেই। বিদ্যালয়ে আশে পাশে জনবসতি কিংবা কোনও দোকানপাট নেই। বর্ষা শুরু সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়ে চারপাশ পানিতে টইটুম্বর থাকে।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছবেদ আলী জানান, ‘বিদ্যালয়ের কাছের এলাকাগুলোর মধ্যে নিমতা গ্রামের পাশে রয়েছে ঘিওর উপজেলার বাশাইল, শিবালয় উপজেলার পাড়াগ্রাম ও হরিরামপুর বিজয় নগর। এই ৩টি গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ওই সব বিদ্যালয়ে ২শ থেকে ৩শ করে শিক্ষার্থী থাকলে নিমতা সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। বিদ্যালয়টির বয়স ৪৬ বছর হলেও বিদ্যালয়ে যাওয়া আসার কোনও রাস্তা হয়নি। এছাড়া নিমতা এলাকায় অধিকাংশ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস করে। জনশূণ্যতার কারণে ভর্তি হওয়ার মতো শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি মনে করেন বিদ্যালয়টি যাতায়াতের জন্য রাস্তা হলে আগামীতে ভর্তি হওয়ার শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি হবে।
ঘিওর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সৈয়দ নাজনীন আলম জানান, ‘৬৩ নং নিমতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি মূল সমস্যা হচ্ছে যোগাযোগের রাস্তা। বছরের কয়েক মাস বিদ্যালয়ে যাওয়ার রাস্তা পানি-কাদায় তলিয়ে থাকে। এসব কারণে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে না।’ তিনি আরও জানান, বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়াতে পার্শ্ববর্তী এলাকায় তারা নিয়মিত মা সমাবেশ ছাড়াও জনপ্রতিনিধি এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সভা করছেন। তার আশাবাদ, নতুন বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে।’