X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘হাওরে পানি থাকলেও মরণ আবার না থাকলেও মরণ’

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র, সুনামগঞ্জ
১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:৩৬আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:৩৬

সুনামগঞ্জে সেচ দিয়ে হাওড়ে জমিতে চাষ করা হচ্ছে

কোন হাওরে সেচের পানির অভাব আর কোন হাওরে জলাবদ্ধতা দুই সংকটকে মোকাবেলা করে হাওরে বোরো আবাদে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন লাখো কৃষক।  তাহিরপুরে শনির হাওর, সদর উপজেলার দেখার হাওর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ফুর্জাকসি হাওর ও জামালগঞ্জের হালির হাওর ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।  কৃষকরা জানান, নদী খননের ফলে ও প্রাকৃতিক কারণে এবছর হাওরের পানি দ্রুত নেমে গেছে। অন্যদিকে হাওরের পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। দ্বিমুখি সংকটে পড়ে কৃষকরা নাজেহাল অবস্থায় বোরো আবাদ করছেন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ফুর্জাকসি হাওরে গিয়ে দেখা যায় মেশিন দিয়ে পানি সেচে হাওরের জলাবদ্ধতা দূর করে জমিতে ফসল রোপন করছেন। অন্যদিকে তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরে গিয়ে দেখা যায় রক্তি নদী থেকে পানি সেচ দিয়ে জমিতে চাষবাদ করছেন কৃষকরা।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলার ছোটবড়ো সবকটি হাওরেই কমবেশি সেচের পানির সংকট ও জলাবদ্ধতা  রয়েছে। এই দুই সংকট ধূর করতে হলে হাওরের অভ্যন্তরে খাল ও নদী খনন করতে হবে। তাহলে জলাবদ্ধতা ও সেচের পানির অভাব দূর হবে।

সদর উপজেলার হুসেননগর গ্রামের কৃষক আব্দুল মালিক বলেন, ‘তাদের বাড়ির পাশে পুর্যাকসি হাওরে ৪ বছর ধরে স্থানীয় সিরকা নদীর নাব্যতা হারানো ফলে হাওরের অভ্যন্তরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে মাছ ধরার ও পানি সেচের জন্য বাঁধ দেওয়ার কারণে সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। খিদ্দরপুর গ্রামের লাউস মিয়া বলেন, ‘হাওরে বেশি পানি থাকলেও মরণ আবার না থাকলেও মরণ।  হাওরে বেশি পানি থাকলে জলাবদ্ধতার কারণে ধান লাগানো যায় না আবার সেচের পানি না থাকলেও ধান লাগানো যায় না। ’

একই গ্রামের ইসলাম উদ্দিন বলেন, ‘সিরকা নদীর বেশির ভাগ অংশ শুকিয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মওসুমে পানি নিষ্কাশনের পথ না থাকায় দেখা দেয় জলাবদ্ধতা  আবার বর্ষাকালে হাওরে বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে পাকা ধান বৃষ্টির পানিতে জমিতেই তলিয়ে যায়।

শ্রীমতি বাজার এলাকার প্রবীণ কৃষক মিয়াফর আলী বলেন,  ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সিরকা নদীর মাত্র ৪ কিলোমিটার অংশে গভীরতা বজায় রয়েছে বাকী ৬ কিলোমিটার জায়গা শুকিয়ে গেছে। তাই ফুর্জাকসি হাওর, ডাকুয়ার হাওর, আলী মুকুর হাওর, ধামাইর হাওর, ঝুড়িঙ্গার হাওর, গাতিঙ্গার হাওরে প্রতিবছর জলাবদ্ধাতার সৃষ্টি হয়। একই গ্রামের  প্রবীণ কৃষক আলী নূর মিয়া বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে হুসননগর, মাগুরা,ধনপুর সর্দারপুর, চাঁনপুরসহ ১০ টি গ্রামের কৃষক জমিতে ধান রোপন করতে পারেন না।

উকারগাওর গ্রামের মাহমুদ আলী বলেন, ‘এবছর তিন গ্রামবাসী চাঁদা তুলে দুটি মেশিন কিনেছে। মেশিন দিয়ে ১৭ দিন রাত-দিন সেচ দেওয়ার পর হাওরের পানি কিছুটা কমেছে। এখন জমিতে ধান রোপণের কাজ চলছে।

চাঁনপুর গ্রামের রুবেল আহমদ বলেন, ‘দুটি মেশিনে প্রতিদিন দুইশ লিটার ডিজেল খরচ হয়। এগুলোর টাকাও তিন গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে দিয়েছে একারণে জমি রোপণ থেকে শুরু করে ধান কাটা পর্যন্ত কৃষকের খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এরকমভাবে জমি চাষাবাদ করে কৃষকের তেমন কোনও লাভ থাকবে না।  অন্যদিকে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের খিদ্দরপুর গ্রামের আব্দুল লতিফ বলেন, হাওর এলাকায় নদী খননের কাজ শুরু হওয়ায় এবছর হাওরের পানি দ্রুত নেমে গেছে। বিশেষ করে হাওরের উচু  জমিগুলোতে পানি  এক ফোঁটাও পানি নেই। তাই জমিচাষ, জমিতে মই দেওয়া থেকে শুরু করে ধানের চারা রোপণে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। 

গোপালগঞ্জ গ্রামের তাজ্জুদ আলী বলেন, ‘বোরো জমিতে চাষবাস থেকে শুরু করে ধানের ছরা আসা পর্যন্ত জমিতে নির্দিষ্ট পরিমাণে পানি থাকতে হয়। ওই পরিমাণ পানি থাকলে ধানের ফলন ব্যাপকভাবে কমে যাবে। ফলে কৃষকরা লোকসানের মুখে পড়বে।

খিদ্দরপুর গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, হাওর আর নদীর দূরত্ব কম করে হলেও তিন কিলোমিটার হবে। তাই এতো দীর্ঘ সেচ দিতে না পারায় জমিগুলো আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তীব্র সেচ সংকটে পড়বে। ’

ফতেহপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রনজিত চৌধুরী রাজন বলেন, ‘হাওরের জলাবদ্ধতা ও সেচ সংকট দূর করতে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।  বিশেষ পরিকল্পনা না নেওয়া হলে আগামীতে সেচ ও জলাবদ্ধতা সংকট আরো তীব্র হবে।’ হাওর বাঁচাও ও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি বীরমুক্তি যোদ্ধা অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী বলেন, ‘সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা দেশের অন্যতম খাদ্য শস্যের যোগান দিলেও স্বাধীনতার আগে ও পরে হাওরের সমস্যা নিরসনে কোনও উদ্যোগ কেউ না নেওয়ায় সেচ সংকট ও জলাবদ্ধতার মতো সংকট এখন আরও ঘনীভুত হচ্ছে। এজন্য টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া হাওরের অভ্যন্তরে জলমহালের ব্যবস্থাপনা গুরুত্ব সহকারে মনিটরিং করলে দুটি সংকট কিছুটা হলেও কমবে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল মোন্নাফ বলেন, ‘হাওরের সেচ সংকট ও জলাবদ্ধতা দুটোই কৃষকের জন্য ক্ষতিকর। সেচ সংকট ও জলাবদ্ধতার কারণে কৃষক জমিতে ধান রোপণ করতে পারেন না। সেচ সংকট  ও জলাবদ্ধতার কারণে জমি পতিত থাকে। একারণে ধানের উৎপাদন ব্যহত হয়। এ কারণে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়ে।  হাওর এলাকার এসব সমস্যা দূর করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তবে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নিয়ে কাজ করলে এটি আরও ফলপ্রসু হবে। সুনামগঞ্জ  পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া বলেন, হাওর এলাকার সমস্যা নিরসনে নদী খননের কাজ চলমান রয়েছে। নদীগুলোর খনন কাজ শেষ হলে কৃষক কিছুটা হলেও এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন। হাওরের প্রবীণ কৃষকদের দাবি হাওর এলাকার উন্নয়নে পৃথক নীতিমালা তৈরি করে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হলে কৃষকরা স্থায়ীভাবে এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন না।    

 

/জেবি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!