‘জীবনে আর কোনোদিনও ইয়াবা কারবার করবো না; স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবো। অন্যদেরও এই কারবারে না আসার অনুরোধ করবো।’
কক্সবাজারের টেকনাফের নাজিরপাড়া গ্রামের মৃত মোজাহের মিয়ার ছেলে এনামুল হক প্রকাশ এনাম মেম্বর এ কথাগুলো বলেন, যিনি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
শনিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে টেকনাফের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কথা হয় এনামের সঙ্গে। অনুষ্ঠান মঞ্চের পূর্বপাশে বসে যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন পাশ থেকে একই কথা বলেন টেকনাফের লেঙ্গুরবিলের সামশু মিয়ার ছেলে মো. সিরাজ, যিনি পরে অনুষ্ঠানে আগতদের কাছে অঙ্গীকার করেন, জীবনে কোনোদিন মাদক ব্যবসা করবেন না বলে।
শুধু এনাম ও সিরাজ নয়; এদিন আত্মসমর্পণ মঞ্চে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আরও বেশ কয়েকজন ইয়াবা কারবারির। এর মধ্যে টেকনাফের দক্ষিণ কচুবনিয়া গ্রামের মৃত হাজি সুলতান আহমদের ছেলে মৌলভী বশির আহমদ বলেন,‘টাকার লোভে পড়ে এ ব্যবসায় পা দিয়েছিলাম। ভুল হয়ে গেছে, এখন বুঝতে পারছি। এ ব্যবসা আর করবো না। বউ-বাচ্চা ও পরিবার নিয়ে বাঁচতে চাই।’
একই কথা বলেন টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর নুরুল বশর; যিনি পৌরসভার কুলালপাড়া গ্রামে বাস করেন। তার বাবার নাম মো. ইউনুছ। বশর বলেন, ‘টাকার লোভে একদিকে দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছি, অন্যদিকে নিজের পরিবার ও স্বজনদের কাছে থাকতে পারিনি পুলিশের ভয়ে। অশান্তি থেকে বাঁচতে আত্মসমর্পণের পথ বেছে নিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে, আইনগতভাবে সেসব মামলা মোকাবিলা করবো। শুধু সমাজের অন্য ১০ জনের মতো স্বাভাবিক জীবন চাই।’
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘আত্মসমর্পণকারীদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে থাকা পুরনো মামলা প্রচলিত আইনে চলবে। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আদালতকে সুপারিশ করা হতে পারে।’
তিনি আরও জানান, আত্মসমর্পণকারীদের সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। পরে বিচারকের আদেশে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
এদিকে, কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পরিদর্শক মো. দিদারুল আলম জানান, আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে দুইটা মামলা হয়েছে; একটা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে, অন্যটা অবৈধ অস্ত্র আইনে।
এদিন দুপুরে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, আত্মসমর্পণকারী ১০২ জন ইয়াবা কারবারিকে মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে। একইসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণকারীদের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
ইয়াবা কারবারিদের বেশিরভাগই বিত্তবান মন্তব্য করে আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, ইয়াবার কারবার থেকে আত্মসমর্পণকারীদের আয় করা সম্পদ জব্দ করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হবে। তবে তাদের মধ্যে অসচ্ছল কেউ থাকলে তাদের সহায়তা দেওয়া হবে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে কোনও প্রকার মাদক ও অবৈধ নাগরিক যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। এক্ষেত্রে বিজিবিকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।’
এসময় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘দেশে এখনও যেসব ইয়াবা কারবারি ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে, তারা সময় থাকতে আত্মসমর্পণ করুক, আমরা চাই। না হয় খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। সরকার জঙ্গিবাদকে রুখে দিয়েছে, জলদস্যু ও বনদস্যুদের রুখে দিয়েছে। এবার মাদক কারবারিদেরও রুখে দেবে। যেকোনও কিছুর বিনিময়ে দেশকে মাদকমুক্ত করা হবে।’
এদিন দুপুর ১২টার দিকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে ৩ লাখ ৫০ হাজার ইয়াবা, ৩০টি দেশীয় পিস্তল ও ৭০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ জমা দেন ১০২ জন ইয়াবা কারবারি। এসময় তারা ‘জীবনে আর কখনও ইয়াবা কারবার করবো না’ বলে শপথও নেন।
উল্লেখ্য, গত বছর মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেন এবং দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযানের নির্দেশ দেন। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সারাদেশে ৩ শতাধিক মাদক কারবারি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায়; শুধু কক্সবাজারে টেকনাফে মারা যায় ৩৯ জন ইয়াবা কারবারি। ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাদক কারবারিদের নিয়ে একটি তালিকাও প্রকাশ করে; যাতে কক্সবাজার ও টেকনাফের ১ হাজার ১৫১ জন মাদক ব্যবসায়ীর নাম উঠে আসে। এর মধ্যে ৭৩ জন শীর্ষ মাদক কারবারী বা পৃষ্টপোষকের নাম আছে। এ তালিকায় রয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিসহ তার পরিবারের ২৬ জনের নাম।