X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

পলান সরকারের ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ হয়ে ওঠার গল্প

দুলাল আবদুল্লাহ, রাজশাহী
০৪ মার্চ ২০১৯, ১২:৫৩আপডেট : ০৪ মার্চ ২০১৯, ১৩:০৬

শিক্ষার্থীদের মাঝে পলান সরকার ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি পড়া হয়নি তার। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। যখন যে বই পেয়েছেন পড়েছেন। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকেই নিজে বই কিনে মেধাবী শিক্ষার্থীদের দিতেন তিনি। একটি-দু’টি করে বই পড়তে দিতেন পাড়ার লোকজনদের। সেখান থেকেই ক্রমে আশেপাশের গ্রামে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। নিজে বই নিয়ে ফেরিওয়ালার মতো গ্রাম থেকে গ্রামে খুঁজে বেড়াতেন। এটাই ছিল পলান সরকারের ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ হয়ে ওঠার গল্প। সেই পলান সরকার আর নেই। গত ১ মার্চ ৯৮ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন।

১৯২১ সালের ১ আগস্ট নাটোর জেলার বাগাতিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন পলান সরকার। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন হারেজ উদ্দিন সরকার। মা পলান নামে ডাকতেন। পাঁচ বছর বয়সে বাবা হায়াত উল্লাহ সরকারকে হারান পলান। পরে নানা ময়েন উদ্দিন সরকার তাদের নিয়ে আসেন রাজশাহীর বাউসায়। সেখানকার স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির পর ইতি টানেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। তবে থেকে যায় বই পড়ার অভ্যাস। প্রথমে এর-ওর কাছ থেকে বই ধার করে এনে পড়তেন। নিজের অভ্যাস আশোপাশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পলান সরকার নিজ এলাকায় ‘বইওয়ালা দাদুভাই’, ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ নামে পরিচিত ছিলেন।

বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দিতেন পলান সরকার পলান সরকারের নানা ময়েজ উদ্দিন সরকার ছিলেন স্থানীয় ছোট জমিদার। একসময় তিনি নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন। দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারীর চাকরি পান তিনি। নানার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪০ বিঘা সম্পত্তির মালিক হন তিনি।

ব্রিটিশ আমলেই তিনি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। অভিনয় করতেন ভাঁড়ের চরিত্রে। আবার যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপও বলে দিতেন। এভাবেই বই পড়ার নেশা জেগে ওঠে তার।

পলান সরকারের ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ হয়ে ওঠার গল্প

ছয় ছেলে ও তিন মেয়ের জনক পলান সরকার। বাউসা বাজারের অদূরে গেদুর মোড় এলাকায় তার বাড়ি। বাড়ির পাশেই পাঠাগার। পাঠাগারজুড়ে থরে থরে সাজানো বই। পাঠাগারের একটি তাকে সাজানো পলান সরকারের যাবতীয় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামে-গ্রামে বই বিলি করে গেছেন তিনি। বিশেষ করে গৃহিণীদের বই পড়তে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার চেষ্টায় আলোকিত হয়ে উঠেছে বাউসার আশেপাশের অন্তত ২০ গ্রাম।অর্জন। মুগ্ধ পাঠকের অভিব্যক্তিও ঠাঁই পেয়েছে পলান সরকারের পাঠাগারে।

একুশে পদক পাওয়ার পর পলান সরকার ১৯৬৫ সালে ৫২ শতাংশ জমি দান করেন বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য। ১৯৯০ সাল থেকে ওই বিদ্যালয়ে মেধাতালিকায় প্রথম ১০টি স্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের বই উপহার দিতেন তিনি। এছাড়া শিক্ষার্থীরাও বইয়ের আবদার করলে তাদেরও দিতেন। তবে শর্ত ছিল বই পড়ার পর তা ফেরত দেওয়ার। এরপর গ্রামের মানুষও তার কাছে বই চাইতে শুরু করেন। ১৯৯২ সালে ডায়াবেটিক হয় পলান সরকারের। ওই সময় তিনি হাঁটার অভ্যাস করেন। তখন থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দেওয়া শুরু করেন তিনি। পথে পথে ঘুরতে শুরু করেন ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার হয়ে। বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদি লেখকদের বইগুলো ছিল পলান সরকারের সবচেয়ে পছন্দের। তাছাড়া লোকসাহিত্যসহ অন্যান্য জনপ্রিয় লেখকের বইও তিনি বিতরণ করেন।

এভাবেই চা দোকানি থেকে শুরু করে গৃহবধূ সবাই তার পাঠকের তালিকায় চলে আসেন। বদলে যায় দৃশ্যপট। নিজের গ্রামে তার বাড়িটিই হয়ে ওঠে পাঠাগার। ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। পলান সরকারকে সবার সামনে নিয়ে আসে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভিতে প্রচারিত ইত্যাদিতে তাকে তুলে আনা হয় আলোকিত মানুষ হিসেবে। আর ২০১১ সালে পান একুশে পদক।

পলান সরকারের ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ হয়ে ওঠার গল্প ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারাবিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার ওপর নির্মিত হয় নাটক ও বিজ্ঞাপন চিত্র। শিক্ষা বিস্তারের অনন্য আন্দোলন গড়ে তোলায় ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে ‘সাদা মনের মানুষ’ খেতাবে ভূষিত করে।

পলান সরকার তার বই পড়ার আন্দোলনটাকে শুধু পাঠাগার কেন্দ্রিক না রেখে একটু অন্যভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আগে তিনি শুধু বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসতেন। পড়া শেষ হলে পুরোনো বইটা নিয়ে নতুন একটা দিয়ে আসতেন। কয়েক বছর থেকে তিনি বই বিতরণের জন্য এলাকাভিত্তিক পাঁচটি বিকল্প বই বিতরণ কেন্দ্র তৈরি করেন। এজন্য বাজারের বইপ্রেমী কোনও দোকানিকে তিনি বেছে নেন। দোকান মালিক তার দোকানে মালামালের পাশাপাশি পলান সরকারের বইও রাখতেন। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজন বই নিয়ে যান। পড়া বই শেষ হলে তারা নিজেরাই ফেরত দিয়ে নতুন বই নিয়ে যেতেন। মাসে এক-দুবার করে পলান সরকার দূরবর্তী এই কেন্দ্রগুলোতে ছেলের সঙ্গে মোটরসাইকেলে চেপে গিয়ে নতুন বই দিয়ে পুরোনো বই নিয়ে আসতেন। তবে এই কাজ ছেলে হায়দার আলীকে দিয়েই বেশি করাতেন। এছাড়া পাঠাগারে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। পুরস্কার হিসেবে তাদের হাতেও পলান সরকার বই তুলে দিতেন।

পলান সরকারের ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ হয়ে ওঠার গল্প পলান সরকার খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন। কথা বলে মানুষকে হাসাতে পারতেন। কাঁদাতেও পারতেন। তার বই পড়ার আন্দোলন সম্পর্কে ২০১৬ সালের নভেম্বরে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পলান সরকার বলেছিলেন, ‘আমি হাঁটতে হাঁটতে এই সমাজটাকে বদলানোর আন্দোলনে নেমেছি। যত দিন আমি হাঁটতে পারি, তত দিন আমার আন্দোলন চলবেই। আমি হাঁটতে হাঁটতে মানুষের বাড়িতে বই পৌঁছে দেবই। যারা পাঠাগারে আসবেন, তারা ইচ্ছেমতো বই পড়বেন। তবে আমার বয়স হয়েছে। জানি না আর কত দিন হাঁটতে পারবো।’

ছেলে হায়দার আলী বলেন, ‘বার্ধক্যজনিত কারণে কয়েক দিন ধরে বাবা শয্যাশায়ী ছিলেন।’

বাউসা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, ‘একজন ভালো মানুষকে আমরা হারালাম। তার মতো নিবেদিত মানুষের অভাব রয়েছে। আশা করি তার শূন্যস্থান অন্য কেউ পূরণ করবেন। তার উত্তরসূরি হয়ে আবারও আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে উঠবেন। এটা আমাদের প্রত্যাশা।’ 

 

 

 

/এসটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আধুনিকায়নে কাজ করবে জাইকা ও বিএফডিসি
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আধুনিকায়নে কাজ করবে জাইকা ও বিএফডিসি
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের