গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ‘গোপনে দরপত্র আহ্বান’ করে ১১০টি সরকারি খাস পুকুর লিজ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব পুকুর লিজে সরকারি নীতিমালা মানা হয়নি। কমিশনের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসন পুকুরগুলো বরাদ্দ দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মৎসজীবীরা। তাদের দাবি, গোপনে এসব পুকুর লিজ দেওয়ার কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছেন স্থানীয় প্রকৃত মৎসচাষীরা। এছাড়া মোটা অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার।
এদিকে অনিয়মের মাধ্যমে পুকুরগুলো লিজের ঘটনায় মৎসজীবীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। লিজ দেওয়ার প্রতিবাদে এবং তা বাতিল করে পুনঃদরপত্রের দাবিতে মানববন্ধনসহ জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন মৎসচাষীরা।
জানা গেছে, গোবিন্দগঞ্জে ছোট-বড় মিলে প্রায় চার শতাধিক সরকারি খাস পুকুর রয়েছে। তিন বছর মেয়াদি এসব পুকুর মৎসজীবীদের নিয়ে গঠিত সমিতিকে লিজ দেয় উপজেলা প্রশাসন। এলাকার মৎসজীবীরা এসব পুকুরে মাছ চাষ করে আসছেন। মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রথম পর্যায়ে ১২১টি (২০ একর) পুকুর ইজারা দিতে দরপত্র আহ্বান করে ২৪ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে উপজেলা প্রশাসন। গত ৬ মার্চ দরপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল। নির্ধারিত দিনে দরপত্র দাখিলকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। এতে দরপত্র জমা দিতে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে বাধা দেয়। একপর্যায়ে নেতাকর্মীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় ভাঙচুর করা হয় উপজেলা পরিষদ চত্বরের বেশ কিছু দোকানপাট। সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ উভয়পক্ষের অন্তত ১৪ জন আহত হন। পরে শর্টগানের গুলি ও লাঠিপেটা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ। এ পরিস্থিতিতে দরপত্র দাখিল স্থগিত করে পরবর্তীতে পুনঃদরপত্র আহ্বানের ঘোষণা দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার রামকৃষ্ণ বর্মণ।
এরই মধ্যে উপজেলা প্রশাসন গোপনে দরপত্র আহ্বান করে ১২১টির মধ্যে ১১০টি পুকুরের লিজ প্রক্রিয়া শেষ করেছে বলে জানতে পারেন এলাকার মৎসজীবীরা। মৎসজীবীদের অভিযোগ, প্রভাবশালী মহলের যোগসাজসে ২৪ মার্চ গোপনে স্থানীয় একটি পত্রিকায় দরপত্র আহ্বান করে উপজেলা প্রশাসন। ২৪ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত পুনঃদরপত্র বিক্রি ও দাখিলের শেষদিন দেখানো হয় ৩ এপ্রিল। অথচ পুনঃদরপত্র আহ্বানের বিষয় জানেন না প্রকৃত মৎসজীবীদের কেউ। এমনকি উপজেলা পরিষদ ও ভূমি অফিসেও দরপত্র বিজ্ঞপ্তির কোনও নোটিশ দেওয়া হয়নি। তাছাড়া দরপত্র আহ্বানের নোটিশ সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও তহসিলদারকে দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের কেউ নোটিশ পাননি।
মৎসজীবীদের অভিযোগ, ‘লাখ লাখ টাকা কমিশন আদায় করে নামমাত্র টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে পুকুরগুলো লিজ দেওয়া হয়েছে। ইউএনও’র যোগসাজসে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও প্রভাবশালীরা এসব পুকুর সমিতির নামে লিজ নিয়েছে। লিজ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা মানা হয়নি। একটি সমিতির নামে দুটি পুকুর লিজের কথা থাকলেও ১১০টি পুকুর লিজ হয় ১২ থেকে ১৪টি সমিতির নামে।’
গুমানীগঞ্জ মৎসজীবী সমিতির সভাপতি ধলু মিয়া বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে এসব পুকুর লিজের কারণে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হলে সরকারের রাজস্ব আয় হতো। কিন্তু তা না করায় পকেট ভারি হয়েছে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের।’সুষ্ঠু তদন্ত করলে অনিয়মের প্রমাণ মিলবে বলে দাবি করেন তিনি।
রাজাহার ইউনিয়ন মৎসজীবী সমিতির সভাপতি আবদুস ছাত্তার মিয়া জানান, এর আগে পুকুর লিজ নিয়ে তিনি মাছ চাষ করছেন। পুকুরে এখন ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আছে। প্রথম পর্যায়ে দরপত্র আহ্বানের শেষদিনে আবেদন করতে গিয়েও তিনি আবেদন করতে পারেননি। কিন্তু পুনঃদরপত্র আহ্বানের বিষয়টি জানেন না তিনি, কোনও নোটিশ বা মাধ্যমে জানতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘এখন শুনছি পুকুর লিজ হয়েছে। লিজ পাওয়া লোকজন পুকুর দখল নিতে চাচ্ছেন। এমন অবস্থায় পুকুরের মাছ নিয়ে কী করবো বুঝতে পারছি না।’
শুধু সাত্তার মিয়া নয়, তার মতো অনেকেই পুকুর লিজ না পাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। পুকুর লিজ না পাওয়ায় সংসার চালাবেন কী করে সে চিন্তায় এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এলাকার মৎসচাষীরা।
এদিকে গোপনে পুকুর লিজের প্রতিবাদে ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে মৎসজীবীদের মধ্যে। পুকুর লিজ বাতিল ও পুনঃদরপত্রের দাবিতে উপজেলার ১৬টি মৎসজীবী সমিতির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। সম্প্রতি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বরে পুকুরগুলোর লিজ বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন মৎসজীবীরা। লিজ বাতিল না হলে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন এবং কঠোর অন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন মৎসজীবীরা।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করছেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রামকৃষ্ণ বর্মণ। তিনি বলেন, ‘পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। পুকুর লিজ নিয়ে কোনও অনিয়ম হয়নি। তবে একটি সমিতি একাধিক পুকুর লিজ পাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপজেলা জলাশয় বন্দোবস্ত কমিটি।’
পুকুর লিজ নিয়ে মৎসজীবীদের পক্ষ থেকে পাওয়া লিখিত অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন।
