পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে বিনিময় প্রথার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি মেলা। আজ সোমবার উপজেলার কুলিকুন্ডা গ্রামের মেলায় কৃষকদের পাশপাশি দূরদুরান্ত থেকে আসা ক্রেতারা বিভিন্ন ধরনের শুঁটকি কেনেন। মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়।
সরকারি নিয়মে গতকাল সারা দেশে পহেলা বৈশাখ পালিত হয়েছে। তবে বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী আজ বছরের প্রথম দিন। এ দিনে নাসিরনগর সদর উপজেলার কুলিকুন্ডা গ্রামের বিস্তৃর্ণ জমি জুড়ে বসে ঐহিত্যবাহী শুঁটকি মেলা। ব্যতিক্রমধর্মী এই মেলার প্রধান আকর্ষণ সূর্যদয় থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি ক্রয়বিক্রয়। এবারও তাই হয়েছে।
এলাকার মুরব্বী আলমাস আলী জানান, ‘শত বছরের বেশি সময় ধরে এই মেলা বছরের প্রথমদিন পহেলা বৈশাখ হয়ে আসছে। আমার কয়েক পুরুষ ধরে, অন্তত ৩০০ বছর ধরে এই মেলা হয়ে আসছে। মেলায় এলাকার কৃষকরা তাদের উৎপাদিত আলু, ডাল, সরিষা, পেঁয়াজ, কাঁচা আম, গম, রসুনসহ নানা জাতের পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি বেচাকেনা করেন। তবে সেটা সকাল ৯টা পর্যন্ত হয়। এর পর চলে অর্থের বিনিময়ে বেচাকেনা। তবে কালের আবর্তে মেলায় জৌলুস অনেকটাই হারিয়েছে।’তিনি এতিহ্যবাহী মেলার ঐতিহ্য ধরে রাখার আহ্বান জানান।
মেলায় প্রথমবারের মতো আসা নতুন প্রজন্মের দর্শনার্থী খোদেজা আক্তার জানান, ‘আমি এই মেলার কথা অনেক আগে থেকে শুনে আসছি। তবে প্রথম বার মেলায় এসে আমি অনেকটাই উৎফুল্ল। কারণ গ্রামের মেলা, বারুণি টিকে আছে তার আপন গতিতে। কুলিকুন্ড গ্রামে না আসলে আমি তা বুঝতে পারতাম না মেলা কত রকম হতে পারে।’
মেলায় শুঁটকি মাছ কিনতে আসা জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘পুঁটি, বোয়াল, শোল, গজার, বাইম, টেংরাসহ নানা জাতের শুঁটকি পাওয়া যাচ্ছে। আমি ১২ টাকা কেজি দরে শোল শুঁটকি কিনেছি। আরও শুঁটকি কেনা যায় কিনা মেলা ঘুরে দেখছি।’
হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে আসা মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘প্রতিবছরই এই মেলায় আসি। এবারও এলাম। মেলা থেকে বাইম, টেংরাসহ নানা জাতের শুঁটকি কিনেছি। দাম বড় বিষয় নয়। পছন্দের শুঁটকি কিনেছি সেটাতেই স্বস্তি। বেশ ভালো লাগছে।’
এদিকে মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দোকানিরা নানা জাতের শুঁটকির পসরা সাজিয়ে বনেস। কিশোরগঞ্জ থেকে শুটকি মাছ নিয়ে আসা দোকানি অর্জুন দাস ও পরিমল দাস জানান, মেলায় বোয়াল, শোল, গজার, বাইম, পুঁটি, টেংরাসহ নানা জাতের শুঁটকি বেচাকেনা হয়েছে । চাহিদা অনুযায়ী ক্রেতার দেখাও পেয়েছেন তারা। বেচাকেনাও বেশ ভালো হয়েছে। তারা জানান মেলায় দেশি মাছের শুঁটকির প্রাধান্যই বেশি। এছাড়া ইলিশসহ বিভিন্ন জাতের মাছের ডিমও বিক্রি হয়েছে।
মেলা সর্ম্পকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নবনির্বাচিত নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ফয়েজ চিশতি জানান, ‘আদিকালে কুলিকুন্ডা অঞ্চলে জেলে সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল বেশি। তখন অর্থের প্রচলন তেমন ছিল না। সেই থেকে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে এই শুঁটকি মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে অনেকটাই মেলার ঐতিহ্য ম্লান হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের পণ্য বিনিময়ের পর মেলায় অর্থের প্রচলন ঘটার কারণে। তবে মেলাটিকে আরও বর্ণিল ও তার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হবে। আমরা আগামীতে যেন আরও বড় আকারে মেলাটি উদযাপন করতে পারি সেই প্রচেষ্টা চালাবো।’
এই শুঁটকি মেলাকে কেন্দ্র করে অন্তত পাঁচ একর জায়গা জুড়ে বসেছে লৌকজ মেলা। মেলায় স্থানীয় কুমারদের হাতের তৈরি মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, ঝাঁঝর, থালা, ঘটি, বাটি, পুতুল ও প্রদীপসহ অন্যান্য সামগ্রী স্থান পেয়েছে। নাগরদৌলার দোলানীতে মাতোয়ারা মেলায় আসা শিশুরা। দিনব্যাপী খাবার দোকান সহ অন্তত পাঁচ শতাধিক দোকানি অংশগ্রহণ করেছে।