খুলনার উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ত পতিত জমিগুলোর উৎপাদনশীলতা ফিরিয়ে আনতে নানামুখী গবেষণা ও তৎপরতা চলছে। এর অংশ হিসেবে এক ফসলি এসব জমির উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভুট্টা চাষে সফলতা এসেছে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ২৫ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়। ভুট্টা থেকে চারা তৈরির পর তা জমিতে রোপণ করা হয়। এ পদ্ধতির ভুট্টা চাষ শুধু খুলনা অঞ্চলেই নয়, বাংলাদেশেও প্রথম। লবণাক্ত পানিতে ডুবে থাকা জমির কাঁদা-পানিতে মৌসুম শুরুর আগেই ভুট্টা চারা রোপণ করা হয়। এছাড়া আরেকটি পদ্ধতি হলো, পানি কমে গেলে আবাদযোগ্য জমির কাঁদা বা নরম মাটিতে বীজ বপন করা হয়। খুলনায় পরীক্ষামূলকভাবে এ দুই পদ্ধতিতেই ভুট্টা চাষ করা হয়েছে। এখন ফসল তোলার পর্যায়ে রয়েছে। পরীক্ষামূলক এ চাষে ভালো ফলন দেখে এলাকার কৃষকদের মাঝে ভুট্টা চাষে আগ্রহ দেখা দিয়েছে।
মৃক্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের আওতায় ‘লবণাক্ততা ব্যবস্থা ও গবেষণা কেন্দ্র’ বটিয়াঘাটার অধিনে এ ভুট্টা চাষ হয়েছে।
লবণাক্ততা ব্যবস্থা ও গবেষণা কেন্দ্র বটিয়াঘাটার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শচীন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন,‘বটিয়াঘাটাসহ খুলনার উপকূলীয় এলাকার জমিতে নভেম্বর-ডিসেম্বরে ধান উঠে যাওয়ার পর পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে। কৃষকরা আবার আগস্ট মাসের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। ৮/৯ মাস এ জমি পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে। লবণাক্ততার কারণে এ জমিতে অন্য কোনও ফসল উৎপাদন হয় না। এ অবস্থার কারণে ১৯৯৬ সালে ৯.৮৮ একক জমি নিয়ে এ লবণাক্ততা গবেষণা কেন্দ্রটি তৈরি হয়। বর্তমান সরকারের ফসল উৎপাদন বাড়ানোর কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ লবণাক্ত এলাকার পতিত জমিকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে এবারই প্রথম ২৫ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়। যা স্থানীয় কৃষকদের মাঝে নতুন আশার আলো সৃষ্টি করেছে।’
তিনি আরও বলেন,‘এই পতিত জমিতে কোনও প্রকার চাষ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। ধান কাটার পর নরম মাটিতে ভুট্টার বীজ রোপণ করলেই চলে। আবার ভুট্টার বীজতলা তৈরি করে সেখান থেকে ১৫-২০ দিনের চারা তুলে এনে রোপণ করলেও হয়। আর সেচ দেওয়ার জন্য পানির তেমন সঙ্কটও হয় না। সারের প্রয়োগটাও সমন্বয় করতে হয়। খুলনার বটিয়াঘাটার দেবীতলায় পরীক্ষামূলকভাবে ভুট্টা চাষে ডিবলিং ও ট্রান্সপ্লান্ট ২ পদ্ধতিই প্রয়োগ করা হয়েছে। যা থেকে সুফল পাওয়া গেছে। এ সফলতা কৃষকদের মাঝে আশার আলো সৃষ্টি করেছে।’
তিনি বলেন,‘গবেষণা কেন্দ্রের মধ্যে ভুট্টা চাষে হেক্টর প্রতি ১০/১১ টন উৎপাদন পাওয়া যায়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে হেক্টর প্রতি ভুট্টা উৎপাদন ৭/৮ টন আশা করা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে প্রাকৃতিক নানা সমস্যা প্রভাব ফেলার কারণে গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ে মাঠে ৩/৪ টন উৎপাদন হ্রাস পায়।
কৃষক রিতা রাণী বলেন,‘২ বছর আগে তিনি ১ বিঘা জমিতে চাষের মাধ্যমে ভূট্টা চাষ করেছিলেন। কিন্তু ওই বছর নানা প্রাকৃতিক সমস্যার কারণে ফসলের ক্ষতি হয়। ঝড়ো বাতাসে গাছ ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়। তারপরও সামান্য যা কিছু উৎপাদন হয়েছিল, তা বাজারজাত করার প্রক্রিয়া না জানার কারণে বিক্রি করতে পারেননি। পরে তা গরুর খাবারে পরিণত হয়েছে। এর ফলে আর ভুট্টা চাষ করেননি। তবে, আগাম ও বিনা চাষে ভুট্টা চাষের প্রক্রিয়া দেখে এবং ফলন ভালো হওয়ায় তিনি আশাবাদী। আগামী বছর ভুট্টা চাষ করতে আগ্রহী। এ জন্য গবেষণা কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
দেবীতলার কৃষক বনসপতি বলেন,‘ওই ২৫ বিঘা জমির মধ্যে তার নিজের ৫০ শতক জমি রয়েছে। গবেষণা কেন্দ্রের তৎপরতায় আগ্রহী হয়ে পতিত থাকা জমিতে তিনিও ভুট্টা চাষ করেন। এখন ভালো ফসলও পাচ্ছেন। প্রতিটি গাছে ২-৩টি করে ভুট্টা ধরেছে। আকারও বেশ বড় হয়েছে। তাদের জমির ফলন দেখে আশপাশের কৃষকরাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন। আগামীতে এখানে কোনও জমিই পতিত থাকবে না বলে আশা করছি।’
তিনি বলেন,‘আমার এ জমিতে ভুট্টা চাষ না হলে পতিত পরে থাকত। ভুট্টা চাষের ফলে আরও একটি ফসল এবার ঘরে তোলা যাবে। ভালো লাভও হবে। আমরা কোনও চাষ ছাড়াই ভুট্টার ভালো ফলন পাচ্ছি। শুধু খাল থেকে ২ বার সেচ দিয়েছি। আর গবেষণা কেন্দ্রের পরামর্শ অনুযায়ী সার দেওয়াসহ গাছ বাতাসে ভেঙে পড়া থেকে রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছি।’
দেবীতলার চাষি অংশুমান রায় বলেন,‘এ জমিতে বৎসরে একবার ধান হতো। ধান কাটার পর আবার ওই জমিতে ধান লাগানোর জন্য ৮/৯ মাস অপেক্ষায় থাকতে হতো। জমি ছিল এক ফসলী। এ সময়টা জমি পতিত পরে থাকতো। এখন ধান কাটার পর বিনা চাষেই ভুট্টা চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। ভুট্টা ঘরে তুলতে ৪-৫ মাস সময় লাগে। ভুট্টার পরীক্ষামূলক চাষে সফলতা মিলেছে। এখন এ জমিকে আর এক ফসলী বলার সুযোগ নেই।
বটিয়াঘাটা এলাকার নারী নেত্রী আশলতা ঢালী বলেন,‘ভুট্টা চাষের পর ঘরে তোলা ও বাজারজাত করার জন্য যথেষ্ট শ্রমিক প্রয়োজন হয়। এ অঞ্চলে শ্রমিকের তেমন ঘাটতি নেই। ফলে বিনা চাষে ভুট্টা চাষে সফলতার পর বাজারজাত করণে কৃষকের তেমন কোনও সমস্যা হবে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার উপ-পরিচালক পঙ্কজ কান্তি মজুমদার বলেন,‘দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকায় মাটি ও পানির লবণাক্ততা, দেরিতে পানি নিষ্কাশন ও অপসারণ, এটেল মাটির আধিক্য এবং সেচ উপযোগী মিষ্টি পানির অভাব রয়েছে। এ সব কারণে শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ জমি পতিত থাকে। এ পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। এর অংশ হিসেবে পতিত জমিতে ভুট্টার এ ফলন প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক বিধান কুমার ভান্ডার বলেন, ‘দেশে বছরে ভুট্টা চাহিদা রয়েছে ৫০ লাখ টন। আমাদের উৎপাদন হয় ৩৮ লাখ টন। অবশিষ্ট ১২ লাখ টন আমদানি করতে হয়। আমরা তাই ভুট্টা চাষ বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছি। এ লক্ষ্যে প্রথমেই পতিত লবণাক্ত জমিতে ভুট্টা চাষের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করা হয়। গবেষণা কেন্দ্রে সফলতা পাওয়ার পরই মাঠ পর্যায়ে এবারই প্রথম বটিয়াঘাটার ২৫ বিঘা জমিতে ট্রান্সপ্লান্ট ও ডিবলিং ২টি পদ্ধতিতেই ভূট্টা চাষে সফলতা পাওয়া গেছে। এখন স্থানীয় কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পতিত জমিতে ভুট্টা চাষ বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষামূলক এ চাষে কৃষকদের বীজ ও চারা গবেষণা কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তাও কৃষকদের দেওয়া হয়েছে। আগামীতেও লবণাক্ত এলাকার কৃষকদের পতিত জমিতে ভুট্টা চাষে সব ধরণের সহায়তা অব্যহত থাকবে। শুধু চাষেই নয়, ভুট্টা চাষের পর তা ঘরে তোলা, বাজারজাত প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও বাজার সৃষ্টিতে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
