X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিলীন হয়ে গেছে মোমিননগরের তাঁতশিল্প

তৌহিদ জামান, যশোর
১৯ এপ্রিল ২০১৯, ১২:৪০আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০১৯, ১২:৪৮

অযন্তে অবহেলায় পড়ে আছে তাঁত বিলীন হয়ে গেছে যশোরের ঐতিহ্যবাহী মোমিননগরের তাঁতশিল্প। সময়ের পরিক্রমায় আজ আর শোনা যায় না তাঁতের খট খটা খট শব্দ। নানা পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন এখানকার তাঁতশিল্পীরা।

যশোর শহর লাগোয়া মোমিননগর গ্রামটি। এই গ্রামটি নওদাগ্রাম বা নওদাগাঁ নামেও পরিচিত। এখানকার তাঁত কাপড়ের বিশেষত্ব ছিল- পাকারঙের শাড়ি, লুঙি, গামছা, তোয়ালে। একসময় গ্রামের অধিবাসীদের সিংহভাগই তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মোমিননগরের তৈরি কাপড়ের সুনাম ছিল দেশব্যাপী। তবে এখন সেই পরিচিতি নেই বললেই চলে।

ঐতিহ্য

তাঁতের সঙ্গে জড়িরা জানান, মোমিননগরের কাপড়ের বিশেষ গুণ ছিল কাপড়ের রঙ টেকসই। রঙ উঠতো না। সেকারণে তাদের নানামুখি কাজও ছিল। প্রথমে বাজার থেকে সুতা কেনার পর তা সাবান দিয়ে ভালোভাবে ধোয়া। এরপর সেই সুতা দুই ধরনের কেমিক্যালের পাত্রে রেখে ভেজানো। পরপর তিনবার কেমিক্যালে ভেজানোর পর সুতা আরেকটি কেমিক্যাল (হাইড্রোকস্টিক) মেশানো গরম পানিতে সেদ্ধ করা। গরম পানি থেকে সেই সুতা তুলে একদিন রোদে শুকিয়ে তা কাপড় বোনার কাজে ব্যবহার। আর কী কাপড় বোনা হতো- তার ওপর নির্ভর করতো সুতা রঙ করার পদ্ধতি। এসব কারণে এই অঞ্চলের কাপড়ের চাহিদা ছিল।

১৯৪০ সালের দিকে যশোরের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়াজ মোহাম্মদ খান নওদাগ্রামের তাঁতিদের উৎপাদিত পণ্য ও বিপণনের ব্যবস্থা দেখে এগিয়ে আসেন। এই অঞ্চলে মুসলিম ছাড়া অন্য কোনও ধর্মের লোক বসবাস করতো না। সেকারণে তিনি নওদাগ্রাম নামটি বদলে মোমিননগরের প্রচলন করেন। অযন্তে অবহেলায় পড়ে আছে তাঁত

ওইসময়ে নওদাগ্রামের তাঁতিরা তাদের তৈরি কাপড় বিক্রি করতেন শহরতলীর রাজারহাটে, সপ্তাহের একটি দিনে। তখন পাইকাররা ন্যায্যমূল্য দিতো না, আবার অত্যাচার নির্যাতনও করতো। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে তিনি এখানে ‘মোমিননগর তন্তুবায় সমবায় সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেন। পরে সমিতির নাম পরিবর্তন করে মোমিননগর সমবায় শিল্প ইউনিয়ন লিমিটেড করা হয়। এরপর তাঁতিদের কাছ থেকে কাপড় কিনে সমিতি তাদের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে বিপণন করতো। এখনও অবশ্য সেই সমিতি বিদ্যমান এবং যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিপণন কেন্দ্র রয়েছে।

একজন সুলতানের গল্প

নওদাগাঁ এলাকার বাসিন্দা সুলতান হোসেন (৫৬)। বাবার নাম মৃত গোলাম আলী বিশ্বাস। পাকিস্তান আমল থেকেই বাবা ছিলেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। সুলতান ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯৭৭ সালের দিকে তিনি তাঁতশিল্পে সম্পৃক্ত হন। তবে পিতৃপুরুষের তাঁত পেশা ছেড়ে দিয়েছেন বছরখানেক আগে। এলাকায় দিয়েছেন মুদি দোকান। তাঁত এখন তার কাছে কেবলই স্মৃতি।

সুলতান বলেন, ‘৮০’র দশকে আমার ৩৫টি তাঁত চালু ছিল। তৈরি হতো শাড়ি, গামছা আর তোয়ালে। ৯০-এর দশকে প্রতিদিন আমার তাঁতে ৪০ থেকে ৫০টি তোয়ালে উৎপাদন হতো। তবে আস্তে আস্তে আমার তাঁতের সংখ্যা কমতে থাকে। ২০১৭ সালে সর্বশেষ ৮টি তাঁত ছিল। পরের বছর পুরোপুরি বন্ধ করতে বাধ্য হই। মূলত সুতোর দাম বৃদ্ধি, নতুন ডিজাইনের অভাব, শ্রমিকের স্বল্প মজুরি আর বাজার অব্যবস্থাপনার কারণে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের মানুষ তাঁত বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন আর খুব বেশি বাজারে যাওয়া হয়ে ওঠে না। পুরনো ইজারাদারদের সঙ্গে দেখা হলেই শাড়ি-কাপড়ের কথা জিজ্ঞেস করেন, মনটা খারাপ হয়ে যায়।’

সুলতানের বাড়িতে এখন একটিই তাঁত মেশিন রয়েছে; তাও সেটি স্মৃতি হিসেবে রাখা। জ্বালানি কাঠের মধ্যে ছোট্ট একটি ঘরে রেখে দিয়েছেন তাঁত মেশিন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার যদি সহায়তা করে তবে অবশ্যই বাপ-দাদার এই পেশায় আবারও ফিরে আসতে চাই।’ হাবিবুর ও তাবিউরের কাছে তাঁত এখন স্মৃতি

প্রিন্টের শাড়ির চাপে বিলীন হবিবুরের তাঁতের শাড়ি

কথা হয় একই এলাকার হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। ষাটোর্ধ্ব এই মানুষটি হবি নামেই পরিচিত। ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন। বাড়িতে ছিল ১৮টি তাঁত। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫টি তাঁতের শাড়ি তৈরি হতো তার কারখানায়।

তিনি বলেন, ‘১৯৯০ সালের দিকে ভারত থেকে প্রিন্টের শাড়ি আসা শুরু হয়। সেইসময় অল্পদামের ওই শাড়ির ব্যাপক চাহিদা ছিল আমাদের মা-বোনদের কাছে। প্রতিযোগিতায় তাদের কাছে আমরা হারতে শুরু করি। কেননা তাঁতের শাড়ির দাম ছিল বেশি। আমরা শাড়ি বিক্রি করেছি তিনশ’ টাকায় আর প্রিন্টের শাড়ি বিক্রি হতো দুইশ’ টাকায়। খরচের সঙ্গে পেরে না উঠায় আস্তে আস্তে বিপর্যয় নেমে আসে। ২০০০ সাল পর্যন্ত তাঁত কমতে কমতে ৮-৯টিতে নেমে আসে। দুই বছর পর বন্ধ করতে বাধ্য হই।’

তিনি বলেন, ‘বুননশিল্পীরা সারাদিন কাজ করে দেড়শ’ থেকে দুইশ’ টাকা আয় করতেন। আর শহরে ইজিবাইক চালিয়ে চার থেকে পাঁচশ’ টাকা উপার্জন সম্ভব। সেকারণে তারাও হারিয়ে যেতে থাকলো এই পেশা থেকে।’ অযন্তে অবহেলায় পড়ে আছে তাঁত

হবি এখন কুষ্টিয়া থেকে শাড়ি কাপড় কিনে তা বিক্রি করে বিভিন্ন হাটে হাটে।তিনি বলেন, ‘মোমিননগর সমিতি থেকে আগে সুতা দিতো, কাপড় নিতো। পরে টাকা দেওয়া শুরু করে। কিন্তু কখনও নতুন ডিজাইন তারা দেয়নি। আমরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কাপড় তৈরি করি। কিন্তু তাদের অপছন্দ হলে সেগুলো আর নিতো না।’

হাবিবুর রহমানের চার ভাইয়ের মধ্যে তিনজনেরই বাড়িতে তাঁত ছিল। তাদের বাড়িতে সবমিলিয়ে মোট ৪০টি তাঁত মেশিন ছিল। আজ আর একটিও নেই। সরকারের সহযোগিতা পেলে তাদের বাপ-দাদার এই পেশা টিকিয়ে রাখতে এখনও অর্ধেকের বেশি তাদের পেশায় ফিরতে চান বলে তিনি জানান।

তাঁতশিল্পী থেকে রাজমিস্ত্রির জোগালী

তাঁতশিল্পী হিসেবে কাজ করতেন আবু সাঈদ (৪৫)। প্রায় এক যুগ তিনি বুনেছেন তোয়ালে। প্রতিদিন দশ থেকে বারটি তোয়ালে বুনে দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা পর্যন্ত আয় হতো। মোমিনননগরে তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বছর দুই তিনি রাজমিস্ত্রির জাগালী হিসেবে কাজ করেন। এতে প্রতিদিন এখন চারশ’ থেকে সাড়ে চারশ’ টাকা আয় হয়। তাঁতের আগের পেশায় তিনি আর ফিরতে চান না।

তবে কথা হয় এই অঞ্চলের ‘তাঁত মাস্টার’ নামে পরিচিত আলফাজ উদ্দিনের সঙ্গে। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি বুনন শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। বছর দুই পুরোপুরি বেকার। ১৩ বছর আগে স্ত্রী গত হয়েছেন। এখন সন্তানদের উপার্জনের ওপর বেঁচে আছেন। তিনি চান, মোমিননগরের সেই ঐতিহ্য আবারও ফিরে আসুক।

সমস্যা ও সম্ভাবনা

মোমিননগর সমবায় শিল্প ইউনিয়ন লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘তাঁতশিল্পে গোটা পরিবার জড়িত থাকতো। কেউ সুতা তৈরি করছে, কেউ কাপড় বুনছে, কেউ মাড় দিচ্ছে, কেউ বাজারজাত করছে। মোমিননগরে এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে এখন সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধা, তাদের তৈরি পণ্য ন্যায্যমূল্যে বাজারজাতকরণ এবং সময়ে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন হলে অবশ্যই আমাদের এই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘মোমিননগরে ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে এখন প্রয়োজন সরকারের হস্তক্ষেপ। সেক্ষেত্রে প্রকৃত তাঁতিদের সহজশর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ, সুতোয় ভর্তুকি আর সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা হলে তারা ফের এই পেশায় ফিরতে পারবেন।’

এ বিষয়ে যশোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘মোমিননগরের তাঁত আমাদের যশোরের একটি ঐতিহ্য। এই শিল্পকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। বর্তমান সরকার ক্ষুদ্রশিল্প রক্ষায় বিশেষ নজর দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চমহলে আলোচনা করে দেখবো, তাদের জন্যে কী করা যায়।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশনের ডেপুটি ম্যানেজার ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তাদের ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে তারা যোগাযোগ করলে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা পেতে পারেন। এছাড়া আমাদের পক্ষ থেকে তাদের শিল্প সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শও দেওয়া সম্ভব।’

 

/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!