রাজশাহী কারা কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণের জন্য গত কয়েকদিন ধরে নগরীর সিপাইপাড়া এলাকার পাখি কলোনির গাছগুলো কাটা হচ্ছিল। শতবর্ষী এসব গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে রাজশাহীবাসীর ব্যানারে আন্দোলনে নামে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। আন্দোলনের মুখে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সন্ধ্যায় গাছ কাটা বন্ধের নির্দেশ দেন ডিআইজি (প্রিজন্স) আলতাব হোসেন।
এর আগে সোমবার বিকালে গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে ‘আমরা রাজশাহীবাসী’ নামের একটি সংগঠন মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন শেষে তারা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে তার দফতরে দেখা করেন। এসময় মেয়র লিটন তাদের কাছ থেকে গাছ রক্ষার দাবি শোনেন। পরে লিটন জেলা প্রশাসককে গাছগুলো রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ফোনে নির্দেশ দেন।
এদিকে মেয়রের নির্দেশনার পর সোমবার সন্ধ্যায় রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করেন মানববন্ধনে অংশ নেওয়া রাজশাহীবাসীর সদস্যরা। এসময় জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের ডিআইজি প্রিজন্সকে গাছ কাটা বন্ধ করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক এস এম আব্দুল কাদের বলেন, ‘গাছ কাটা বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। গাছ আর কাটা হবে না। গাছ রেখেই কীভাবে ভবন নির্ণয় করা যায়, সে বিষয়ে দেখার জন্য ডিআইজি প্রিজন্সকে বলা হয়েছে।’
এ বিষয়ে ডিআইজি প্রিজন্স আলতাব হোসেন বলেন, ‘গাছ কাটা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপাতত গাছের একটি পাতাও আর কাটা হবে না। আমি ঢাকায় আছি। ফিরে এসে সবার সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’
পাখির আবাস গাছ ও প্রকৃতি রক্ষার দাবিতে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে অংশ নেন- পাখি গবেষক তারেক অণু, বিশ্ব পর্যটক তানভীর অপু, সমাজসেবী মাহবুব টুংকু, পাখি প্রেমিক শোভন আহমেদুজ্জামান, অর্গানিক কৃষক রেজাউল করিম মহব্বত, আইনজীবী লিসা আর্জুমানসহ অনেকে। নগরীর সিপাইপাড়া নদী সংলগ্ন কারা ভবনের সামনে ‘গাছ ও পরিবেশের জন্য আমরা, পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়ন চাই না’ স্লোগান লেখা ব্যানার হাতে নিয়ে মানববন্ধনে অংশ নেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। এসময় বক্তারা বলেন, শতবর্ষী গাছ নিধনের অধিকার কারোর নেই। কারণ একটি শতবর্ষী গাছ তৈরি করতে শতবছর সময় লাগে। তার জায়গায় শত বা হাজারটি গাছ রোপণ করলেও এই ক্ষতিপূরণ হয় না।’
পাখি গবেষক তারেক অণু বলেন, এই গাছগুলোতে শামুকখোল, নানা প্রজাতির টিয়া, বিরল প্রজাতির পেঁচাসহ শতশত প্রজাতির পাখির বাস। বিশেষ করে পদ্মানদীতে বেড়ানো পাখিরা এখানেই আশ্রয় নেয়। বাসা তৈরি করে বাচ্চা ফোটায়। এখন অনেক পাখির প্রজনন মৌসুম। অথচ এই সময় গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। আমাদের বাড়ি-ঘর হঠাৎ ভেঙে দিলে যেমন লাগবে, পাখিদেরও তেমনই লাগছে। পাখিদের বাঁচার পরিবেশ না হলে প্রকৃতি বাঁচবে কীভাবে? প্রকৃতি না বাঁচলে মানুষ কীভাবে বাঁচবে? আজকে গাছ না থাকলে প্রকৃতির তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। আগে মানুষ গাছের ছায়ায় থাকতে পারতো। এখন গাছ না থাকায় আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে রাজশাহীতে। প্রয়োজন আরও গাছ। কিন্তু তা না করে গাছ কেটে রাজশাহীকে মরুভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
বিশ্ব পর্যটক তানভীর অপু বলেন, বিশ্বের ৬৫টি দেশের ৬৭৫টি শহর ঘুরেছি। কোথাও গাছ নিধনের এমন উৎসব দেখিনি। শতবর্ষী গাছ কাটার অধিকার কারও নেই। বিশ্বে অনেক পুরনো গাছ সংরক্ষণের নজির দেখেছি। ধ্বংসের দৃষ্টান্ত শুধু আমাদের দেশেই।
প্রকৃতি, পাখি ও পরিবেশ রক্ষায় গাছগুলো কাটা বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষকে বাঁচাতে হলেও গাছ বাঁচাতে হবে। গাছ রক্ষার বিকল্প হতে পারে না।
সমাজসেবী মাহবুব টুংকু বলেন, মাত্র এক থেকে দুই ফুট জায়গা ছেড়ে দিলেও অনেকগুলো শতবর্ষী গাছ রক্ষা করা যেতো। কিন্তু তা না করে গাছ কাটা হয়েছে। ঘটনাস্থল দেখে মনে হয়েছে, কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলেই গাছগুলো বাঁচিয়ে উন্নয়ন কাজ করতে পারতো।
এদিকে নগরীতে অবৈধভাবে গাছ কাটানর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং নিন্দা জানিয়েছে সামাজিক সংগঠন এলিজাবল ইয়্যুথ ফর ইভোলিউশন-আই। সোমবার সকাল ১১টায় সংগঠনের কার্যালয়ে গোলাম নবী রনির সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জানা গেছে, রাজশাহী নগরীর সিপাইপাড়া পদ্মানদীর পাড় ঘেঁষে কারা প্রশিক্ষণ অ্যাকাডেমির বাউন্ডারি দেয়াল, প্রশাসনিক ভবন ও প্যারেড মাঠ গড়ে তোলা হবে। এ কারণে কেটে ফেলা হচ্ছে ছোট বড় সব মিলিয়ে ৫৬১টি গাছ। এরমধ্যে শতবর্ষী গাছ রয়েছে শতাধিক।
এ ব্যাপারে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হালিমা খাতুন এক স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীকে বলেছিলেন, এখানে কারা প্রশিক্ষণ একাডেমির বাউন্ডারি করা হবে, প্রশাসনিক ভবন, প্যারেড মাঠ করা হবে। বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে গাছগুলো কাটা হচ্ছে। গাছগুলো রেখে ভবন করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সবগুলো গাছ রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। তিনি বলেন, ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় শতাধিক গাছ কাটা পড়ছে। এজন্য আমরা প্রায় দ্বিগুণ গাছ লাগানোর ব্যবস্থাও করে রেখেছি।