X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইটভাটার ধোঁয়ায় পুড়ছে ফসল, তিন শতাধিক কৃষকের মাথায় হাত

বিপুল সরকার সানি, দিনাজপুর
১১ মে ২০১৯, ১২:১৩আপডেট : ১১ মে ২০১৯, ২৩:৫৭

খানসামা উপজেলার কুমড়িয়া গ্রামে ইটভাটায় ধোঁয়ায় পুড়ে গেছে ধান ‘প্রায় দেড় একর জমি অন্যের কাছ থেকে বর্গা নিয়েছি ৬০ হাজার টাকা দিয়ে। বোরো ধান বপন, রোপন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৪৮ হাজার টাকা। অন্যের কাছে ধার-দেনা করে, লোন তুলে এই খরচ করেছি। সার ও কীটনাশকের দোকানেও বাকি পড়েছে। আশা  ছিল ধান ঘরে তোলার পর ধার-দেনা, লোন ও বাকি পরিশোধ করবো। এখন ভাটার প্রভাবে পুরো ফসল নষ্ট হয়েছে, একটি ধানের দানাও পাওয়া যাবে না। এখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিজে খাবো কী, জমির মালিককেই কী দেবো আর ধারদেনা ও লোনই বা পরিশোধ করবো কী দিয়ে এই চিন্তাতেই দিনা পার করতে হচ্ছে।’

আক্ষেপ করে এই কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার কুমড়িয়া আলমপাড়া গ্রামের রশিদুল ইসলাম। শুধু রশিদুল ইসলামই নয়, খানসামা উপজেলার প্রায় দেড়শ’ কৃষকের স্বপ্ন পুড়েছে ইটভাটার কালো ধোঁয়া ও গ্যাসের প্রভাবে। আর খানসামা উপজেলা ছাড়াও, চিরিরবন্দর, সদর ও বীরগঞ্জ উপজেলাতেও ভাটার প্রভাবে নষ্ট হয়েছে ক্ষেতের ফসল। এই চার উপজেলায় পৃথক পৃথক ইটভাটার প্রভাবে প্রায় ৩০০ একর জমির ধান, ভুট্টা ক্ষেত, টমেটো, লিচু, কলাসহ অন্যান্য ফসল পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে তিন শতাধিক কৃষকের। এসব কৃষক পরিবারের আশঙ্কা, যদি এসব ফসলের ক্ষতিপূরণ পাওয়া না যায় তাহলে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের না খেয়ে দিন কাটাতে হবে। তবে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়গুলো নিয়ে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

দিনাজপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্যমতে, দিনাজপুরে মোট ইটভাটা রয়েছে ২৫২টি। এর মধ্যে সদরে ২৬টি, চিরিরবন্দরে ৩৯টি, খানসামায় ৬টি ও বীরগঞ্জে ২৯টি ইটভাটা রয়েছে। এছাড়াও ফুলবাড়ীতে ১১টি, বিরলে ১৭টি, ঘোড়াঘাটে ৮টি,  পার্বতীপুরে ৪৩টি, নবাবগঞ্জে ৩৩টি, বিরামপুরে ১০টি, কাহারোলে ৮টি, বোচাগঞ্জে ২১টি, চিরিরবন্দরে ৩৯ টি ও হাকিমপুরে একটি ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটার ধোঁয়ায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ধানের জমিতে কৃষকের আহাজারি

ইটভাটার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে খানসামা উপজেলার ভাবকী ইউনিয়নের কুমড়িয়া গ্রামে। সেখানকার এসএইচএস এবং টু-স্টার নামে দুটি ইটভাটার বিষাক্ত ধোয়ায় ওই এলাকার প্রায় ২০০ একর জমির বোরো ধান, আম, কাঠাল, লিচুসহ পুড়ে গেছে বাঁশ ঝাড়। শুধু তাই নয়, বিষাক্ত গ্যাসের কারণে মারা গেছে খামারের চার শতাধিক মুরগী। ওই দুটি ইটভাটার কারণে পার্শ্ববর্তী চিরিরবন্দর উপজেলার নশরতপুর এলাকারও প্রায় ২০ একর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। দিনে দিনে আক্রান্ত এলাকার পরিমাণও বাড়ছে।

জানা গেছে, গত এপ্রিল মাসের ২৮ ও ২৯ তারিখ এসএইচএস এবং টু-স্টার ভাটায় ইট তৈরির কার্যক্রম এ বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। বন্ধ করার সময় হঠাৎ ভাটার চিমনি দিয়ে বিষাক্ত এবং দুর্গন্ধযুক্ত ধোঁয়া বের হয়। এর ফলে ওই এলাকার কুমড়িয়ার আলমপাড়া, মন্ডলের বাজারসহ প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বোরো ফসল নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। পরে বিষয়টি কৃষকেরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

কুমড়িয়া আলমপাড়া এলাকার রবিউল ইসলাম জানান, তার প্রায় ৪৫ শতক জমিতে তিনি বোরো ধান রোপণ করেছেন। কিন্তু কয়েকদিন আগে দেখেন গাছে আসা ধানগুলো সব কালো হয়ে পুড়ে গেছে। ভেতরে নেই কোনও চাল, এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা ধান না হওয়ায় একদিকে লোকসান অন্যদিকে পরিবারের সদস্যদের না খেয়ে থাকতে হবে।

লিচু বাগান ব্যবসায়ী ফজির আলী জানান, ‘ভাটার প্রভাবে গাছে আসা লিচুও ঝড়ে যাচ্ছে। আম, কাঠালেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখন আমরা চাই আমাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হোক। এর আগেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভাটাগুলো বন্ধ বা সরিয়ে নেওয়ার কোনও উদ্যোগ।’

চিরিরবন্দর নশরতপুর এলাকার কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, ওই ভাটার গ্যাসের কারণে তারও ৫০ শতক জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।  ইটভাটার ধোঁয়ায় নষ্ট হয়ে ঝড়ে পড়েছে লিচুর কুঁড়ি

খানসামার ভাবকী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত ফসল আমি নিজে পরিদর্শন করেছি। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও পরিদর্শন করেছেন। আমি চাই কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হোক।’

খানসামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহমেদ মাহবুব-উল ইসলাম বলেন, ‘ভাটার কারণে কৃষকদের ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হচ্ছে। ভাটা মালিকদের সাথেও ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে আলোচনা চলছে।’

এই ঘটনায় এসএইচএস ভাটার মালিক মান্নান সরকার ও মোজাফফর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনও বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে ভাটার সহকারী ম্যানেজার আব্দুর রহিম বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভাটায় এসেছিলেন। তার সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা মোতাবেক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।’

টু-স্টার ভাটার মালিক সাইফুর রহমান জানান, ‘আমার ভাটায় বিষাক্ত ধোঁয়ায় যাতে কোনও ক্ষতি না হয় এমন ব্যবস্থা আছে। এরপরেও যদি আমার ভাটা থেকে এটি হয় তাহলে আমি ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি আছি।’

একই অবস্থা সদর উপজেলার পূর্ব রামনগর এলাকার প্রায় ৫০ একর জমির। গাছে ধরা ছোট ছোট লিচু ঝড়ে যাচ্ছে, ঝলসে যাচ্ছে ক্ষেতে আসা ভুট্টার মোচা। মরে যাচ্ছে টমেটোর গাছ, আর কলা গাছের চেহারা যেন আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলা হয়েছে। কৃষকরা দাবি করেছেন, ফসলী জমির পাশেই গড়ে উঠা আরইবি নামে একটি ইটভাটার ধোঁয়ার কারণেই ফসলের এমন ক্ষতি হচ্ছে। আর তাই নষ্ট হয়ে যাওয়া ফসলের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন কৃষকরা।

দক্ষিণ শিবপুর গ্রামের আইনুদ্দিন বলেন, ‘এই মৌসুমে শুধু লিচু এক মাস আগে কিনেছি দেড় লাখ টাকা দিয়ে। পরিচর্যা, পানি সেচ, সার, কীটনাশক ও শ্রমিক খরচও হয়েছে। এখন হঠাৎ করেই লিচু থোকার বোটা শুকিয়ে ঝড়ে যাচ্ছে। ভাটার কারণে এখন আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি, আমি শেষ।’

পূর্ব রামনগর মুশহর পাড়া এলাকার ধীরেন ঋষি বলেন, ‘ধার নিয়ে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ভুট্টা আবাদ করেছি। এখন ভুট্টা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন আমার বড় চিন্তা অন্যের টাকা, জমির টাকা ও লোন শোধ করবো কীভাবে?’ ভাটার কারণেই তার এমন ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।

অভিযোগ পাওয়ার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ৪নং শেখপুরা এলাকার চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ভাটার ধোঁয়ার কারণেই ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গরীব কৃষকরা কষ্ট করে আবাদ করে। তাই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানাই।’

আরইবি ভাটার ম্যানেজার সুনীল কুমার রায় বলেন, ‘আমাদের ভাটাটি জিকজ্যাক। এই ভাটার ধোঁয়া দিয়ে ফসল ক্ষতি হওয়ার কথা না। লিচুতে অধিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগের কারণে এটি হতে পারে। এরপরও বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা হবে।’

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আকলিমুজ্জামান বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ফসলের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ল্যাবের প্রতিবেদনে যদি ভাটার কারণে এমনটি হয়েছে বলে প্রমাণ হয় তাহলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রশাসনকে বিষয়টি অবহিত করা হবে।’

একই অবস্থা বীরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া ইউনিয়নের নখাপাড়া এলাকায়। এসবিএম নামের একটি ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসের কারণে সেখানকার প্রায় ৫০ একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষকেরা জানায়, গত ৩০ এপ্রিল ভাটার বিষাক্ত গ্যাস ছেড়ে দিলে গ্যসের প্রভাবে আশপাশের এলাকার প্রায় ৫০ বিঘা জমির বোরো ধানসহ বিভিন্ন প্রকার ফলজ ও বনজ গাছ আকস্মিক মড়ক দেখা গেলে কৃষকেরা চরম হতাশায় ও বিপাকে পড়েছে। প্রায় ৬৫/৭০ জন কৃষক ন্যায় বিচারের দাবিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক রহিদুল ইসলাম জানান, ‘ভাটার বিষাক্ত গ্যাসের কারণেই বোরো ধানের গাছ মরে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ঝড়ে পড়ছে লিচু, আম, কাঠালসহ অন্যান্য ফসল।’ এই ঘটনায় উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তিনি।

বীরগঞ্জের নিজপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ওবাইদুল হক জানান, ‘কৃষি জমিতে ভাটার প্রভাবে ফসলী জমির ফসল  নষ্ট হচ্ছে। তবে এই বিষয় প্রতিকারে কৃষি কর্মকর্তারা কোনও পদক্ষেপ নেননি। আমি নিজেও বিভিন্ন সময়ে এই ভাটার বিরোধিতা করেছি। ভাটার মালিক সেলিম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে তার ভাটার কারণে ফসলের ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।’

দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম জানান, ‘ভাটার কারণে যেসব এলাকায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে সেসব এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। কৃষকরা যাতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

আরও পড়ুন-

ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় শত বিঘা জমির ধান নষ্ট

ইটভাটার তাপে পুড়লো জমির ধান

/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা