X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাতক্ষীরার শতাধিক বিদ্যালয় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, ঝরে যাচ্ছে শিক্ষার্থী

আসাদুজ্জামান সরদার, সাতক্ষীরা
১১ মে ২০১৯, ০৯:৪৩আপডেট : ১১ মে ২০১৯, ১৩:৪৭

শাল্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণির ক্লাস চলছে একটি টিনশেডের মধ্যে সাতক্ষীরার সাত উপজেলায় এক হাজার ৯৪টি বিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে ৮৯টি বিদ্যালয় ভবনকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা। এরপরও ওইসব ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। অনেক অভিভাবক সন্তানদের ওইসব ঝুকিপূর্ণ বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে নিয়ে কিন্ডার গার্টেন বা অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জেলার পুনর্নির্মাণযোগ্য জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে সদর উপজেলার ১৪টি, কালিগঞ্জ উপজেলার ১৭টি, কলারোয়া উপজেলার ১৪টি, তালা উপজেলার ১৩টি, আশাশুনি উপজেলার ৬টি, দেবহাটা উপজেলার ৩টি ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৯টি বিদ্যালয়ের ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ৩৪ নম্বর শাল্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণির ক্লাস চলছে একটি টিনশেডের মধ্যে। এই ভবনের চারদিকের দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়ছে। এর চারদিকের দেয়াল ও পিলারের প্লাস্টার খসে ফাটল দেখা দিয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই শিক্ষার্থীদের বই-খাতা ভিজে যায়। গরমের সময় প্রচণ্ড তাপদাহে টিন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ভবনটির মাঝে কোনও দেয়াল নেই। পাশাপাশি চলছে দুটি ক্লাস। এতে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে।

এই ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় আরও ১৫ বছর আগে। মূল ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভবন সংকটের কারণে স্থানীয়দের সহায়তায় ১৫ বছর আগের পরিত্যক্ত ভবনটি মেরামত করে সেখানে ক্লাস চলছে। এটার দেয়াল যেকোনও মুহূর্তে ধসে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এভাবে ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে শতাধিক শিক্ষার্থী।

এদিকে, ২০১৪ সালে বিদ্যালয়ের দুটি ক্লাসরুম বিশিষ্ট ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে ছাদ খসে পড়ে দুই শিক্ষার্থী আহত হলে সেটিকেও পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। পরিত্যক্ত ভবনটির ছাদের আস্তরণ খসে পড়ে রড বের হয়ে পড়েছে, মেঝে নিচের দিকে দেবে গিয়ে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে এখন শিক্ষকদের মোটরসাইকেল ও শিক্ষার্থীদের বাইসাইকেল রাখা হয়। এই ভবনটি যেকোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। পাঁচ বছরেও এই ভবন পুনর্নির্মাণের উদ্যোগে গ্রহণ করেনি সরকার।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার নেবাখালী সরদার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফয়জুল্ল্যাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আশাশুনি উপজেলার বৈকারঝুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বছরের অধিকাংশ সময় এসব বিদ্যালয়ের খোলা মাঠে কিংবা বারান্দায় পাঠদান চলছে।

সাতক্ষীরা সদরের বাঘডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ২০১৩ সালে সরকারি হওয়া এই স্কুলে কোনও ভবনই নেই। বাঁশ, খুঁটি, কাঠ ও টিন দিয়ে কোনও রকম ঘেরা। ভবনে চালের টিন সম্পূর্ণ নষ্ট। বৃষ্টি আসলে অঝোরে পানি পড়ে। যেকোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে এই স্কুলটির কাঠামো। এমনিভাবে জেলার অনেক স্কুলে ভবন না থাকায় শুকনো মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা খোলা আকাশের নিচে এবং বর্ষা মৌসুমে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে। এছাড়া অনেক বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়াশুনা করছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।

বৈকরঝুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এসব বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংস্কারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগের অভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিমুখ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ছে। সামর্থ্যবান অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কিন্ডার গার্টেনে ভর্তি করাচ্ছেন।

অনেকে আবার অভিযোগ করে বলেন, সরকারি প্রাথমিক স্কুলের এই দশার কারণে যেখানে সেখানে কিন্ডার গার্টেন ও প্রি-ক্যাডেট স্কুল গড়ে উঠছে।

মোখলেছুর রহমান নামে এক অভিভাবক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার একটি ছেলে শিশুশ্রেণিতে পড়াশুনা করে। ওদের কোনও ক্লাস রুম নেই। সেজন্য কখনও গাছের নিচে কখনও খোলা আকাশের নিচে পড়ানো হয়। আমার আরেকটি ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে। স্কুলের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ  হওয়ায় ভয়ে থাকি। আমার আর্থিক সামর্থ্য কম। সে কারণে বাধ্য হয়ে ওই স্কুলে আমার ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছি। অনেক অভিভাবক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কারণে তার তাদের সন্তানদের এই স্কুল থেকে নিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করেছেন। আমাদের দাবি দ্রুত ভবনটি সংস্কার করা হোক। ’

শাল্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবব্রত কর্মকার বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ের সমস্যায় জর্জরিত বিদ্যালয়টির শ্রেণি কক্ষের সংকট দীর্ঘদিনের। ১৯৯৫ সালে আমরা একটি ভবন পেয়েছিলাম সেই ভবনটি ২০১৪ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ভবন সংকটের কারণে আমরা বাধ্য হয়ে ১৫ বছর আগে পরিত্যক্ত একটি টিনের শেড মেরামত করে সেখানে ক্লাস নিচ্ছি। এখানে বৃষ্টির সময় পানি পড়ে শিক্ষার্থীদের বই ভিজে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনেক সময় বাধ্য হয়ে খোলা মাঠে অথবা গাছের তলায় ক্লাস নেওয়া লাগে। শ্রেণিকক্ষের অভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ২০১৪ সালে ছাদ খসে পড়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়। এর পর থেকে ওই দুটি কক্ষে আর ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয়নি। আমাদের একটি অফিস রুম একটি ক্লাসরুম ভালো আছে। পরিত্যক্ত বিদ্যালয়ের ভবন পুনর্নির্মাণের জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার দফতরে একাধিকবার অবহিত করেছি। পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও আমাদের ভবন দেওয়া হয়নি। ভবন সংকটের কারণে লেখাপড়ার মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী আমাদের স্কুল ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী দূরের স্কুলে যেতে না পেরে লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ছে।’

সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার রুহুল আমিন বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে জরাজীর্ণ ভবন সম্পর্কে জানতে চেয়ে আমাদের চিঠি দিয়েছে। জেলায় কতোটি ভবন করা লাগবে সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছে মন্ত্রণালয়। সাতক্ষীরায় এক হাজার ৯৪টি বিদ্যালয়ের ভবনের মধ্যে জরাজীর্ণ ৮৬টি স্কুল অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছি। জরাজীর্ণ বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বেশির ভাগই নিলামযোগ্য ও  পুনর্নির্মাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সারাবছর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে মেরামত করা হয়। নতুন ভবন নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, দেওয়াল নির্মাণ, টয়লেট তৈরিসহ যেখানে যা মেরামত করা দরকার সেগুলো করা হয়। যেখানে যে পরিমাণ বরাদ্দ দরকার সেখানে সেই পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কোনও বিদ্যালয়ের ভবনের জন্য আলাদাভাবে বরাদ্দ দেওয়া দরকার হলে সেটিও আমরা করে থাকি। তারপরও অনেক সময় অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। এখানে আমাদের কোনও হাত থাকে না। ’

তিনি আরও বলেন, ‘একটি স্কুল ভবন দীর্ঘদিন টিকে থাকার কথা। কিন্তু ঠিকাদারদের দুর্নীতির কারণে সেই ভবনটি অনেক আগেই ভেঙে পড়ে। সেক্ষেত্রে আমাদের করার কিছু থাকে না। স্কুলের ভবন নির্মাণের দায়িত্বে থাকে এলজিডি। এই দফতরের কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে ভবন যতোদিন ভালো থাকার কথা ততোদিন ভালো থাকে না। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও অনেক সময় সেটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা হয় না। এতে করে অনেক ভবনের দ্রুত কাজ করার দরকার, সেগুলো হয় না। আমরা প্রতিনিয়ত জেলা এবং উপজেলা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে থাকি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বরগুনার ওই ঘটনার পর মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে জেলা বা উপজেলার কোনও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা বাদ পড়লে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়ী করা হবে। জেলার কোনও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন যাতে বাদ না পড়ে সে ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট আছি। আশা করি, এরপর জেলায় কোনও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন থাকবে না।’

 

 

 

/এমএএ/
সম্পর্কিত
ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীর মোটরসাইকেল বহরে বোমা হামলা
ঘুমের ওষুধ খাইয়ে স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে স্ত্রীর ‘আত্মহত্যা’
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
সর্বশেষ খবর
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী