‘এই ভাই, এদিকে আসেন। আমারে বাঁচান, ভাই। আমারে ভেতরে নিয়ে যান। আমি সোহেল তাজের ভাগ্নে সৌরভ। আপনারা পেপার-পত্রিকার খবরে দেখছেন, আমারে ১১ দিন আগে অপহরণ করে নিয়ে গেছিল। আমি একটু কথা বলি, আমারে বসতে দিতে হবে না, আমার মা-বাবার সঙ্গে ফোনে একটু কথা বলতে দেন।’ বৃহস্পতিবার (২০ জুন) ভোর ৪টার দিকে ময়মনসিংহের তারাকান্দার মধুপুর বটতলা এলাকার জামিল অটো-রাইস মিলের ইটের সীমানা প্রাচীরের পাশে একটি খেজুর গাছের সঙ্গে ছেঁড়া গামছা ও লুঙ্গি দিয়ে হাত-পা বেঁধে সৈয়দ ইফতেখার আলম সৌরভকে ফেলে রেখে যায় অপহরণকারীরা। এর কিছুক্ষণ পর জামিল অটো-রাইস মিলের কর্মচারী ছমির উদ্দিনকে দেখে ওপরের কথাগুলো বলেন তিনি।
ছমির উদ্দিন বলেন, ‘রাইস মিল চালুর জন্য ভোর পৌনে ৪টার দিকে ঘুম থেকে উঠে মিলের বয়লারের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। ওই সময় সৌরভ আমাকে দেখে ডাক দেন। তার ডাক শুনে আমি প্রথমে মিলের ম্যানেজার কাঞ্চন শর্মা সরকারকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসি। এরপর আমরা দুইজন সৌরভের কাছে যাই। এসময় মা-বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলার অনুরোধ করে সৌরভ জানান, তাকে একটি মাইক্রোবাসে করে নিয়ে এসে মিলের ইটের সীমানা প্রাচীরের পাশে একটি খেজুর গাছের সঙ্গে ছেঁড়া গামছা ও লুঙ্গি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে গেছে অপহরণকারীরা। একপর্যায়ে তিনি হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে সক্ষম হন। সৌরভের এসব কথা শুনে নাইটগার্ড আব্দুল মান্নানের সাহায্যে মিলের প্রধান গেটের তালা খুলে তাকে ভেতরে নিয়ে আসি আমরা।’
একটু থেমে ছমির উদ্দিন আরও বলেন, “মিলের ভেতরে আসার পর সৌরভ বলেন, ‘আমি খুবই পিপাসার্ত। আমাকে একটু পানি খাওয়ান’। সৌরভকে বসতে দিয়ে মিল থেকে ১০০ মিটার দূরের একটি দোকানে গিয়ে দোকানদারকে ঘুম থেকে তুলে আমি বিস্কুট কিনে আনি। এরপর পানি ও বিস্কুট খেতে দেই তাকে।”
ছমির উদ্দিন জানান, তার মোবাইল ফোন থেকে সৌরভের বাবার নম্বরে কল দিলে প্রথমে তার মা ও পরে তার বাবা কথা বলেন। মা-বাবা দুইজনেই সৌরভকে দেখে রাখার জন্য ছমির উদ্দিনকে অনুরোধ করেন। এর পাঁচ মিনিট পরই ছমির উদ্দিনের ফোনে কল দেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ। এসময় তিনি বলেন, “তোমরা সৌরভকে দেখে রাখো। পুলিশ কিছুক্ষণের মধ্যে এসে তাকে নিয়ে যাবে।”
অপহরণের ব্যাপারে সৌরভ কিছু বলেছেন কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে ছমির উদ্দিন জানান, সৌরভ তাদের কাছে বলেছেন, অপহরণের দিন তাকে মাইক্রোবাসে করে দূরে কোথাও নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে বেশ কিছু পথ হাঁটিয়ে একটি বাসার ছোট্ট কক্ষে রাখে তারা। যেখানে অপহরণকারীরা তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার করে।
একই প্রসঙ্গে ছমির উদ্দিন আরও যোগ করেন, সৌরভ তাদের আরও জানিয়েছেন, ১১ দিনের মধ্যে তিন দিন তাকে ভাত ও তিন দিনের মতো তাকে রুটি খেতে দেয় অপহরণকারীরা। প্রায়ই তার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তারা বলতো, ‘তোর বাবা-মার কাছ থেকে অনেক টাকা এনে দিতে হবে’।
মিল ম্যানেজার কাঞ্চন শর্মা সরকার জানান, তারা যখন সৌরভকে দেখেন, তখন তার পরনে ছিল সাদা প্যান্ট ও কালো রঙের ছেঁড়া গেঞ্জি। ওইসময় সৌরভকে খুবই ভীত, বিচলিত ও আতঙ্কিত লাগছিল। তিনি বলেন, ‘সৌরভ যখন আমাদের সাহায্য চান, তখন আমরা বোঝার চেষ্টা করি, তিনি আসলেই বিপদগ্রস্ত ও সোহেল তাজের ভাগ্নে কিনা। পরে তার কাছ থেকে অপরহণের বিষয়ে জানার চেষ্টা করি। সৌরভ জানিয়েছেন, তাকে খুব কষ্ট দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তবে অপহরণকারীদের দলে কতজন সদস্য ছিল—এই বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।’
কাঞ্চন শর্মা সরকার আরও বলেন, ‘সৌরভের কাছ থেকে সব শুনে মিল মালিক হিজবুল বাহার বাচ্চুকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানাই। তিনি আমাদের তারাকান্দা থানায় ফোন দিতে বলেন। পরে সকাল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে পুলিশ এসে সৌরভকে ময়মনসিংহে নিয়ে যায়।’
জামিল অটো-রাইস মিলের পাশের চা-দোকানদার আব্দুর রশিদ বলেন, ‘ভোর ৪টার পর মিলের কর্মচারী ছমির এসে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বিস্কুট নিয়ে গেছে। একজন লোক বিপদে পড়েছে বলে জানিয়েছেল সে। দোকানে আর কেউ না থাকায় মিলে যেতে পারিনি।’
উল্লেখ্য, গত ৯ জুন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন আফমি প্লাজার সামনে থেকে সৌরভকে অপরহণ করে দুর্বৃত্তরা। সৌরভের পরিবার চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানাধীন সুন্নিয়া মাদ্রাসা এলাকার বাসিন্দা। তাদের দাবি, সৌরভকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করানো হয়েছে। চাকরি দেওয়ার কথা বলে ডেকে এনে একটি কালো পাজারো গাড়িতে তাকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
এ ঘটনায় পরদিন ১০ জুন পাঁচলাইশ থানায় নিখোঁজ ডায়েরি দায়ের করেন সৌরভের বাবা। ঘটনার পর সৌরভের পরিবার আরও জানায়, আবু সালেহ চৌধুরী আজাদ নামে এক ব্যবসায়ীর মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের জের ধরে ওই পরিবারের লোকজন সৌরভকে অপরহণ করিয়েছে।
সৌরভের বাবা মানিক বলেন, ‘আবু সালেহ চৌধুরী আজাদের মেয়ের সঙ্গে সৌরভের সম্পর্ক ছিল। এর জের ধরে কয়েক বার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওই মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার জন্য হুমকি দেন। তার কাছ থেকে মুচলেকা নেন। ১০ রমজানও ঢাকার বনানীর বাসা থেকে সাদা পোশাকে ১০-১২ জন সৌরভকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তারা তাকে ছেড়েও দেয়। তাই আমাদের ধারণা, ওই মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের জের ধরেই সৌরভকে অপহরণ করিয়েছে মেয়েটির পরিবার। নিজের লোক দিয়ে হোক, অথবা অন্য কাউকে দিয়ে, না হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে হোক, সৌরভকে সালেহ আজাদই অপহরণ করিয়েছে।’
আরও পড়ুন–
সৌরভের ফোন থেকে কল এসেছিল: সোহেল তাজ (ভিডিও)