উৎপত্তিস্থলে বাঁধ দেওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় ইছামতি নদীর পানির প্রবাহ। এরপর থেকে এ নদীর দুই পাশের নিচু জায়গা ও জলাভূমি বালু দিয়ে ভরাট করতে থাকে অবৈধ দখলদারেরা। সেইসঙ্গে গড়ে উঠতে থাকে দালানকোঠা। দালানকোঠা তৈরির এই প্রতিযোগিতা এখনও অব্যাহত। এদিকে, এ নদীতেই যাচ্ছে পাবনা শহরের অধিকাংশ বর্জ্য-আবর্জনা। এতে একসময়ের দুরন্ত ইছামতি এখন পরিণত হয়েছে সরু নালায়।
স্থানীয়রা জানান, ইছামতি রক্ষার জন্য তারা নানা সময় মানববন্ধন, স্মারকলিপি দেওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু দখলদারদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। তবে জেলা প্রশাসন বলছে, অবৈধ দখল উচ্ছেদের পাশপাশি শিগগিরই তারা নদী খনন কাজে হাত দিতে যাচ্ছে।
পাবনার দক্ষিণ দিকে পদ্মা থেকে ইছামতির উৎপত্তি। পাবনা শহর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে প্রায় ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদী জেলার উত্তর-পশ্চিমের হুরাসাগর ও যমুনায় গিয়ে মিশেছে। ইছামতি মূলত হুরাসাগরের উপনদী। একসময় পদ্মা ও আত্রাই নদীর পানি ইছামতি হয়ে হুরাসাগরে গিয়ে পড়তো।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজের আঘাতে কালে কালে ইছামতি তার আদি আদল হারায়। তবে এ নদীর সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয় এর উৎপত্তিস্থল পদ্মায় বাঁধ নির্মাণ করা হলে। এরপর গত ৫০ বছরে দখল ও দূষণে ইছামতির পাবনা শহরের সাড়ে সাত কিলোমিটারসহ ৩৭ কিলোমিটার অংশ নালায় পরিণত হতে থাকে।
সূত্রগুলো আরও জানায়, হুরাসাগরের দিক থেকে পাবনার আতাইকুলা পর্যন্ত ইছামতির ৪৭ কিলোমিটার অংশ খনন করা হয়। এতে এদিকটায় সবসময় পানি থাকে। এ নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে পাবনা শহরের সাড়ে সাত কিলোমিটারসহ ৩৭ কিলোমিটার অংশেও খননের কাজ হয়েছিল। কিন্তু সেটা অপরিকল্পিতভাবে হওয়ায় এ অংশটা মৃতপ্রায়ই থেকে গেছে।
খেয়াঘাট পাড়ার বাসিন্দা রাম গোপাল সরকার বলেন, ‘এই নদীতে ছোটবেলায় মাছ ধরেছি, সাঁতার কেটেছি। আমার সাঁতার শেখা এই নদীতেই। প্রবাহমান থাকাকালে শহরের এই খেয়াখাটে বড় বড় বজরা ভিড়তো; নতুন ব্রিজের নিচ ও রূপকথা সড়কের শেষ মাথায় বড় বড় গয়নার নৌকা ভিড়তো। এ ছাড়া, নদীতে চলতো লঞ্চ-স্টিমার। এখন সেই দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। ইছমতি এখন মরাখাল ও ময়লা-আবর্জনার স্তূপ।’
নদীর পাশের জয়কালীবাড়ি পাড়ার বাসিন্দা ভাস্কর সান্যাল বলেন, ‘আমার বাবা-মায়ের কাছে শুনেছি, একসময় এ নদীতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বড় বড় মালবাহী নৌকা, স্টিমার চলতো। তবে আমি কখনও দেখি নাই, আমার বয়স চল্লিশ হতে চললো।’
পাবনা প্রেসক্লাবের সম্পাদক আখিঁনূর ইসলাম রেমন বলেন, ‘২০০৪ সাল থেকে ইছামতি রক্ষার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছি। এখন এ নদী রক্ষার দাবি গোটা পাবনাবাসীর।’
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পাবনার সহকারী পরিচালক (ভূমি ও রাজস্ব) মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘২০০৩ সালে জেলা প্রশাসন, পাউবো, জেলা পরিষদ, পাবনা পৌরসভা যৌথভাবে জরিপ করে। এখানে সিএ রেকর্ড অনুযায়ী জরিপ করা হয়। ১৮০ ফিট প্রস্থ ইছামতি নদী বর্তমানে আরএস-এ কোথাও ৯০ ফিট, কোথাও ১২০ ফিট। বর্তমানে পাউবো ও বুয়েটের একটা জরিপ চলছে। এখানে বলা আছে, সিএস রেকর্ড অনুযায়ীই নদী খনন করতে হবে। এদিকে, নদী কমিশন ও হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে, সিএস রেকর্ড অনুযায়ী নদী উদ্ধার করতে হবে এবং নদী খনন করতে হবে। পাউবোরও ইচ্ছা আছে, প্রকল্পটি সিএস রেকর্ড অনুযায়ীই বাস্তবায়ন করার।’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শাফিউল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন নদী পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম শুরু করে। এর অংশ হিসেবে ইছামতি উদ্ধারের কার্যক্রম চলছে। এর আগে আমরা একটি সার্ভে করেছিলাম। সে জরিপে ৩৮৫ জনকে অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করেছিলাম। এখনও একটি সার্ভে চলছে। এতে অবৈধ দখলদারদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। একাজ শেষ হলে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কাজ শুরু করবো।’