গ্রামের নাম মনমতের চর। নামের ভেতরে লুকিয়ে আছে দুঃখ দারিদ্র্যের শোকগাথা। খরচার হাওরবেষ্টিত গ্রামটিতে ৯০ পরিবারের বাস। সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত গ্রামটি। জেলা শহরের দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার হলেও গ্রামটিতে জেলার সবচেয়ে গরিব মানুষের বাস। গ্রামের প্রায় সবাই কৃষিকাজ ও দিনমজুরি করে সংসার চালান। গ্রামটিতে আয়তনের তুলনায় লোকসংখ্যা দ্বিগুণ। ছোট ঘরে একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকেন পরিবারের অনেক সদস্য। বসতঘরের চালে টিন থাকলেও বেড়া ইকরের (ছনের মতো এক ধরনের লম্বা ঘাস), এর ওপরে মাটির প্রলেপ। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে বেড়ে উঠছে গ্রামের শিশুরা। এদের বেশিরভাগই পুষ্টিহীনতার শিকার।
গ্রামের ৮৫ বছর বয়সী শশী মোহন দাস বলেন, ‘একসময় তার চলার মতো জমি জিরাত ছিল। তিন ছেলে ও চার মেয়ে নিয়ে তার পরিবার। এখন তাদের সন্তানাদিসহ পরিবারের লোকসংখ্যা ১৪ ছাড়িয়েছে। তিন ছেলের মধ্যে একজন সিলেটের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিতে কাজ করে সংসার চালায়। আরেক ছেলে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কাজ করার ক্ষমতা হারিয়েছে। সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য ছেলের ওপর নির্ভর করতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, বারবার ফসলহানির কারণে তিনি জমি-জিরাত বিক্রি করে বাচ্চাদের ভরণপোষণ করেছেন। এখন বসতভিটা ছাড়া আর কোনও সহায় সম্পদ নেই। গত ৫ বছর ধরে ৫০ হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে তাকে। কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় বাড়ির বৌ-ঝিরা ইচ্ছে থাকার পরও কোনও কাজ করতে পারে না। তাই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তাদের।
একই বয়সের বিনোদ বিহারি দাস বলেন, ‘মনমতের চর গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ ভূমিহীন। কেউ কেউ বর্গাচাষ করে কিছু ধান পায়। প্রথমে গ্রামের নাম ছিল এওলারচর। পরে মনমতের চর নাম হয়েছে। গ্রামবাসী পাকা সড়ক, বিদ্যুৎ সব পেয়েছেন। কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হওয়ায় বছরের পর বছর দরিদ্রতার কষাঘাতে নিষ্পেষিত হচ্ছেন তারা। দুই দশক আগেও গ্রামে কোনও শিক্ষিত মানুষ ছিল না। এখন ৩০ জনের মতো শিক্ষিত লোক রয়েছে। এছাড়া ৫০ জনের বেশি কিশোর-কিশোরী স্কুলে যায়।
শশী মোহন দাসের ছেলে চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, নদীতে বালি-পাথর পরিবহন বন্ধ হলে গ্রামের সবাই কর্মহীন হয়ে পড়েন। অগ্রহায়ণ থেকে পৌষ মাসে গ্রামবাসী কৃষিকাজ করেন। মাঘ থেকে ফাল্গুন মাস মাটি কাটার কাজ করেন। বৈশাখ মাসে আবারও হাওরে ধান কাটেন। বৈশাখ মাসে আয়-রোজগার ভালোই হয়। কিন্তু হাওরে পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নদীনির্ভর জীবনের। নদীতে কার্গো বার্জ থাকলে চুলায় আগুন জ্বলে, নইলে উনুন শূন্য থাকে। একজন দিনমজুর বালি-পাথরের কাজ করে দৈনিক ৩০০ টাকা আয় করতে পারেন।
বড়ঘাট লাল মাহমুদ উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী বন্যা রানী দাস জানায়, বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার হেঁটে সে নিয়মিত স্কুলে আসা-যাওয়া করে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতটা খারাপ যে বর্ষাকালে ছাতা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য তার অভিভাবকের নেই। তাই বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে স্কুলে যেতে হয়।
ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী বৃষ্টি রানী দাস জানায়, তাদের গ্রামের নাইন টেনের (নবম-দশম শ্রেণির) ছাত্ররা শুক্রবারে সুরমা নদীতে বালি পাথর লোড-আনলোডের কাজ করে। আর স্কুলে বন্ধ হলেও কাজ করে। কিন্তু নারীদের কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থা নেই। তারা ইচ্ছে থাকার পরও কোনও কাজ করতে পারে না।
গৃহিণী শীলা রানী দাস বলেন, গ্রামের নারীরা সংসারের অভাব-অনটন ঘোচাতে কাজ করতে চায়। কিন্তু যেখানে পুরুষদেরই কোনও কর্মসংস্থান নেই, সেখানে নারীরা কীভাবে কাজ করবে? তাই অভাব অনটন তাদের নিত্যসঙ্গী। যদি বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রশিক্ষণ দিয়ে ঋণদানের ব্যবস্থা করতো তাহলে গ্রামের চেহারা বদলে যেত।
গৌরারং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফুল মিয়া বলেন, মনমতের চর গ্রামের মানুষের অভাব দূর করতে বিশেষ প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন। তা ইউনিয়ন পরিষদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। গ্রামের বেকারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ঋণ দিলে তারা দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, তার ইউনিয়নের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষ মনমতের চরে বাস করেন। গ্রামের অভাব দূর করতে তিনি সবার সহযোগিতা চেয়েছেন।