কৃষিকাজ ও মাছ ধরা ছাড়া হাওর এলাকায় বিকল্প কাজের সুযোগ নেই। বছরের ৬-৭ মাস হাওরে পানি থাকে। এসময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন হাওরের লোকজন। পানি সরে যাওয়ার পর ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় কৃষিকাজ, চলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এপ্রিল-মে মাসে ধান কাটা, মাড়াই, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতের কাজ চলে। এরপর হাওরে পানি আসা শুরু হয়। তখন কোনও কাজ থাকে না। অনেকে কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যান। তারপরও বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ বাড়িতে থেকে অলস সময় কাটান। ফলে দরিদ্রতার দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারে না হাওরবাসী।
বর্ষাকালে বাড়ির চারপাশে পানি থাকায় হাওরের বাড়ির আয়তন ছোট হয়ে যায়। এ সময় শাকসবজি চাষের জায়গা থাকে না বাড়িগুলোয়। কৃষি কাজের ব্যবহৃত গবাদি পশু বসত ঘরের পাশে ছোট্ট টিন শেড ঘরে আড় তৈরি করে বেঁধে রাখা হয় জুন-নভেম্বর মাস পর্যন্ত। ঘরে থাকা খড় খাওয়ানো হয় পশুগুলোকে।
জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের ৮১ বছর বয়সী আব্দুল জলিল মিয়া বলেন, ‘আগের আর এখনের দিন এক নয়। কালের পরিক্রমায় হাওর এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে কৃষক জমির ফসল ঘরে তুলে স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। এখন ফসল তোলার পর বিকল্প কাজের জন্য সিলেটের ভোলাগঞ্জ, বিছানাকান্দি, জাফলং যান। আবার কিছু মানুষ চট্টগ্রাম, গাজীপুর, টাঙ্গাইলসহ উজানের জেলাগুলোয় গিয়ে কৃষিকাজ করেন।’
তিনি বলেন, কৃষি কাজ শেষে নিজ নিজ এলাকায় কাজের সুযোগ থাকলে এলাকার মানুষ কখনও গরিব থাকতো না। বর্ষাকালে বেকার লোক বেশি থাকায় মজুরি ও কাজ কম থাকে। তাই বৈশাখে গোলায় তোলা ধান বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়। এজন্য তাদের আয় বলতে কিছু থাকে না।
ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামের যুবক নূর মিয়া বলেন, সাড়ে তিন হাল (৪১ কেয়ার) জমিত বোরো আবাদ করে এ বছর তার পরিবার ৪০০ মণ ধান পেয়েছে। এ থেকে সংসারের খরচ, আগামী বছরের কৃষি কাজের খরচ, কৃষি শ্রমিকের মজুরি, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচসহ যাবতীয় খরচ মেটাতে হয়। তাই আগামী বোরো মৌসুমের ধান কেটে ঘরে তোলার আগেই ভাণ্ডার খালি হয়ে যাবে।
বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রাসেল আহমদ বলেন, হাওর এলাকার মানুষ সম্পূর্ণ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখানে সারাবছর কৃষি কাজের সুযোগ নেই। মানুষ বছরে একবার উৎপাদন করে আর সারাবছর সেই ফসলের ওপর নির্ভর করে চলে। তাই বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত হাওরবাসীর তেমন অভাবে পড়ে না। কিন্তু কার্তিকের শুরু থেকে নতুন ফসল ওঠার আগ পর্যন্ত তাদের কষ্ট হয়।
তিনি বলেন, হাওর এলাকার যুবক সমাজকে কাজে লাগাতে হলে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে।
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ পরিমল কান্তি দে বলেন, হাওর এলাকায় দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না। ছেলেমেয়েরা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে জীবনমুখী কার্যকর কোনও শিক্ষা পাচ্ছে না। তাই শিক্ষিত হলেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না। কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে তারা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখতে পারছে না। এমনকি পরিবারের আয় উন্নতিতে তাদের কোনও ভূমিকা নেই। তাই হাওর এলাকায় কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে বেকার যুব সমাজকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এ বিষয়ে জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ বলেন, হাওর এলাকার মানুষকে অতিমাত্রায় কৃষি নির্ভরতা থেকে মুক্তি দিতে হবে। কারণ একমাত্র কৃষির ওপর নির্ভশীল হয়ে থাকার জন্য দরিদ্রতা বিমোচন হচ্ছে না। হাওরে ধান আবাদের পাশাপাশি বিকল্প ফসল উৎপাদনের কথা ভাবতে হবে। এছাড়া অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা। যার সরসরি প্রভাব পড়ছে হাওরবাসীর অর্থনৈতিক জীবনে। তাই হাওর এলাকার সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ভালোভাবে তৈরি করতে হবে। যেন সারাবছর কৃষক তার পণ্য উৎপাদন করে বিপণন করতে পারেন।
সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, ‘হাওর এলাকায় বর্তমান সরকারের আমলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। অনেক ব্রিজ, কালভার্ট, তৈরি করা হচ্ছে। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হবে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে হাওরবাসীর দরিদ্রতা বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।’