X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশাল বোর্ডে উত্তরপত্র জালিয়াতিতে জড়িত ১৩ পরীক্ষক!

সালেহ টিটু, বরিশাল
২৪ আগস্ট ২০১৯, ১৫:১২আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০১৯, ১৫:২০

বরিশাল শিক্ষা বোর্ড বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে উত্তরপত্র জালিয়াতি করে জিপিএ-৫ পাইয়ে দেওয়া বাণিজ্যের সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি ১৩ পরীক্ষকও জড়িত বলে বোর্ডের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এসব পরীক্ষকদের নাম এখনই প্রকাশ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ইউনুস। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের কেউই পার পাবে না বলেও হুঁশিয়ার করেন তিনি।

জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে গত রবিবার শিক্ষাবোর্ড তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান করা হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের বরিশাল আঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মো. মোয়াজ্জেম হোসেনকে। অন্য দুই সদস্য হলেন— শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক লিয়াকত হোসেন সিকদার ও বিদ্যালয় পরিদর্শক আব্বাস উদ্দীন। সাত কার্যদিবসের মধ্যে কমিটির রিপোর্ট দেওয়ার কথা রয়েছে। 

কমিটির প্রধান প্রফেসর মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘শিক্ষাবোর্ড কোনও একটি বিষয় নিয়ে আমাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করেছে। চিঠিতে সাত কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে তদন্ত করা বোধ হয় সম্ভব হবে না। কারণ, আমাদের আরও অনেক কাজ আছে। আরও সময় নিতে হবে।’

অন্যদিকে, গত মঙ্গলবার জালিয়াতির ঘটনায় একটি বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

বোর্ডের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশাল শিক্ষাবোর্ডে উত্তরপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জিপিএ-৫, এমনকি ফেল করাদের পাস করিয়ে দেওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। এর সঙ্গে কর্মচারী-কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন। একই দফতরে দীর্ঘ সময় থাকার কারণে খুব সহজেই তারা এ কাজটি করছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। এর সঙ্গে অনেক পরীক্ষকরাও জড়িত আছেন। এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় যে ১৮ জন পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র জালিয়াতি ধরা পড়েছে— সেখানে শুধু গোবিন্দ চন্দ্র পালই নয়, ১৩ জন পরীক্ষকও জড়িত থাকতে পারে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরীক্ষার্থীদের খাতা কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক অথবা তার একজন প্রতিনিধি বরিশালে নিয়ে আসেন। খাতাগুলো রাখা হয় শিক্ষাবোর্ডের নিচ তলায় স্ক্রিপ্ট রুমে। বরিশাল শিক্ষাবোর্ডে স্ক্রিপ্ট রুম দুটি। এর একটিতে সিসি ক্যামেরা আছে, অপরটিতে নেই। দুটি কক্ষেই খাতা রিসিভ করা হয়। এরপর খাতাগুলো পরীক্ষকদের মধ্যে বণ্টনের জন্য প্রস্তুত করা হয়। পরে পরীক্ষকদের ডেকে প্রত্যেককে বিষয়ভিত্তিক ২০০ থেকে ২৫০টি খাতা দেওয়া হয়।
স্ক্রিপ্ট রুমের সবকিছুর তদারকির দায়িত্বে ছিলেন শিক্ষাবোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুণ কুমার গাইন। নির্দেশনায় ছিলেন সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ কে আজাদ ফারুক। তাদের নেতৃত্বে কাজ করেছেন সেকশন অফিসার শহিদুল ইসলাম, রেকর্ড সাপ্লায়ার গোবিন্দ চন্দ্র পাল, এবিএম মিজানুর রহমান, বাবুল হোসেন, মজিবর রহমান, ইউসুফ হোসেন, মনির হোসেন, শংকর রায়, নিতাই চন্দ্র, মিলন ও সুমন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আছেন যারা দৈনিক মজুরিভিত্তিক কাজ করেন।

জানা যায়, প্রত্যেকের দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া আছে। কেন্দ্র থেকে খাতা আসার পরে তা এন্ট্রি করার দায়িত্ব গোবিন্দ চন্দ্র পাল ও মজিবর রহমানের। অফিস সহকারী মিজানুর রহমান ও ইউসুফ হোসেন খাতাগুলো আলাদা করে বস্তায় ভরেন (প্রত্যেক বস্তায় ২০০ থেকে ২৫০টি খাতা)। এরপর বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষকদের শিক্ষাবোর্ডে আসতে বলা হয়। পরীক্ষকদের মধ্যে খাতা বণ্টনের সময় প্রতিটি বস্তায় খাতাগুলো ঠিক অছে—কি নেই, কে কতগুলো খাতা পাবে, তা তদারকি করেন সেকশন অফিসার শহিদুল ইসলাম।

অরুন কুমার গাইন দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে একই স্থানে রয়েছেন। পরীক্ষক, নিরীক্ষক এবং প্রধান পরীক্ষকদের তালিকা করেন তিনি। এরপর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অনুমোদন দেন। এবার উচ্চতর গণিতে যে ১৮ পরীক্ষার্থীর জালিয়াতি ধরা পড়েছে, তাদের খাতা দেখেছেন তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মহিলা কলেজের শিক্ষক মনিমোহন। তিনি ১০ বছর ধরে গণিত বিষয়ের পরীক্ষক। নিয়মানুযায়ী ৫৮ বছর পর্যন্ত একজন শিক্ষক পরীক্ষক হতে পারবেন। মনিমোহনের চাকরি আছে আর মাত্র তিন মাস। তিনি এ বছরের ৩০ নভেম্বর অবসরে যাবেন। পরীক্ষকদের যে তালিকা সেখানে মনিমোহনের নাম নেই। তাহলে কীভাবে তিনি এবারও পরীক্ষক হলেন?

এ বিষয়ে পরীক্ষক মনিমোহন বলেন, ‘আমি তো পরীক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করিনি। কেন আমাকে খাতা দেওয়া হলো এ প্রশ্ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে করুন।’

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, এ বছর যে ১৮ পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র জালিয়াতি করেছে, তাদের ১৩টি বিষয়ের সব পরীক্ষকই বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুণ কুমার গাইনের আস্থাভাজন। পরীক্ষকদের মধ্যে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের খাতা কীভাবে ওই ১৩ পরীক্ষকের কাছেই গেলো এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ খাতা তো একটি কেন্দ্রের নয়। তাহলে ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্রের খাতা কীভাবে একই পরীক্ষকের কাছে যেতে পারে?

শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ইউনুস বলেন, ‘১৮ পরীক্ষার্থী তাদের খাতায় কিছু না লিখেই জমা দিয়েছে। প্রতিটি খাতায় একটি লাল কালির দাগ দেওয়া ছিল। এর ফলে গোবিন্দ সহজেই খাতাগুলো বের করে বাইরে পাঠায়। এরপর পরীক্ষার্থীরা উত্তরপত্র দেখে হুবহু খাতায় তুলে পুনরায় জমা দিয়েছে।’ যদি খাতায় লাল দাগ থাকে সেটা প্রথমেই নজরে আসার কথা পরীক্ষকের। কারণ তিনি খাতা দেখে নম্বর দেন। তার আগে তো কেউ খাতায় লাল দাগ দিতে পারেন না। যখনই তারা লাল দাগ দেখবেন তখনই তো তাদের সন্দেহ হওয়ার কথা। কিন্তু কোনও পরীক্ষকই বিষয়টি বোর্ড চেয়ারম্যানকে অবহিত করেননি। শুধু তাই নয় শিক্ষাবোর্ড যে উত্তরপত্র করেছে, সেই উত্তরপত্র প্রত্যেক পরীক্ষকদের কাছে রয়েছে। এতে পরীক্ষকদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়।

পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র শিক্ষকদের উত্তরপত্রের সঙ্গে হুবহু মিল থাকায় বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষকদের ভাবা উচিত ছিল। এ বিষয়ে উচ্চতর গণিতের পরীক্ষক মনিমোহন বলেন, ‘খাতা দেখার জন্য সময় এত কম থাকে যে, আমরা অত সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারি না। বিচার-বিশ্লেষণের জন্য নিরীক্ষক রয়েছেন।’

উচ্চতর গণিতের প্রধান পরীক্ষক পিরোজপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পরীক্ষার্থীদের গঠন এক হতে পারে কিন্তু ভাষাগত দিক থেকে একই ধরনের হওয়ার কথা নয়। পরীক্ষকদের কাছে প্রথমেই বিষয়টি ধরা পড়া উচিত ছিল।’

এ ব্যাপারে শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিচ্ছন্নভাবে কথা বলা ঠিক হবে না। আমরা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছি। তারা রিপোর্ট দেওয়ার পরে বিস্তারিত জানাবো।’

প্রসঙ্গত, এ বছর উচ্চতর গণিত বিষয়ে উত্তরপত্র জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। এতে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ পরীক্ষার্থীর ২০১৯ সালের পরীক্ষা বাতিল করা হয় এবং আগামী তিন বছর পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয় বোর্ড কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে এর সঙ্গে জড়িত বোর্ডের রেকর্ড সাপ্লাইয়ার গোবিন্দ্র চন্দ্র পালকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এখন আরও কেউ এর সঙ্গে জড়িত কিনা তা খুঁজে বের করার জন্য গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।

 

 

/আইএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা