X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারেও মেলে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক

আবদুর রহমান, টেকনাফ
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:২৪আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২০:৩১

অবাধে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন রোহিঙ্গারা ২০০৩ সালে শরণার্থী হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে আসেন মোহাম্মদ আলম। তখন তার বয়স ছিল ৫৩ বছর। পেছনে রেখে এসেছিলেন চার ছেলে ও স্ত্রীকে। পরে এক ছেলে বাংলাদেশে চলে এলেও বাকিরা মিয়ানমারেই বসবাস করছিলেন। বড় ছেলে আজিম ২০১২ সালের সহিংসতার সময় সাগর পাড়ি দিয়ে চলে যান মালয়েশিয়ায়। টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরে বসে বাংলাদেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আলম তার পুরো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। একই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে খবর আদান-প্রদান করছেন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে। তার মতো অনেকেই সীমান্তের দুই পারে একই মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে চলেছেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত ২৫ আগস্ট উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার পরই সরকার নড়েচড়ে বসেছে। কারণ রোহিঙ্গাদের সংগঠিত হওয়ার পেছনে মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতাও একটি অন্যতম কারণ। এরপরই আসতে শুরু করেছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ৩৪টি ক্যাম্পে সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ে রদবদলসহ বিভিন্ন নির্দেশনা। সর্বশেষ (১ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সাত দিনের ভেতর মোবাইল ফোন সংযোগ বন্ধে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী। অবাধে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন রোহিঙ্গারা

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার সীমান্তের টেকনাফ, উখিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ারগুলোর আওতা মিয়ানমারের ভেতরে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ওই রিপোর্টে বলা হয়, এই নেটওয়ার্কের কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের সিমকার্ড ব্যবহার হচ্ছে মিয়ানমারের ভেতরেও। তাই সব অপারেটরের টাওয়ার সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে সুপারিশ করে গোয়েন্দা সংস্থাটি। পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে নেটওয়ার্কের ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে দেওয়ার জন্যও অনুরোধ করা হয়। এ ব্যাপারে পরে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখনও এ বিষয়ে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারে ৫০ থেকে ৬০ হাজার বাংলাদেশি মোবাইল নম্বর ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশটির পেরাংপুল, কাওয়ারবিল, মেরুল্লাসহ সীমান্তের দক্ষিণে প্রায় ১০ কিলোমিটারের মধ্যে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এছাড়া বিকাশের মাধ্যমেও সেখানে লেনদেন করা যায়।

সরেজমিনে টেকনাফের নয়াপাড়া, লেদা, উখিয়ার কুতুপালং বাজার, বালুখালী বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, মোবাইল সিমকার্ড ও ফ্লেক্সিলোডের দোকানগুলোতে সিমকার্ড ও মোবাইল ফোনের রমরমা ব্যবসা চলছে। সেখানে এসে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষরা ভিড় করছেন। সিম বিক্রির ক্ষেত্রে পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি রাখা বাধ্যতামূলক হলেও সেই নিয়ম এখানকার দোকানিরা মানছেন না। সব রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় একই চিত্র। আবার তাদের মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়ার জন্য আশ্রয়শিবিরে গড়ে উঠেছে কিছু দোকানও। প্রতিটি ফোন চার্জের জন্য ১০ থেকে ২০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে আনা সেটে বাংলাদেশি সিম ঢুকিয়ে ব্যবহার করছেন। অনেকে বাংলাদেশ থেকে মোবাইল ফোনের সেট ও সিম দুটোই কিনছেন। আবার কেউ কেউ সেদেশের মোবাইল নেটওয়ার্কও ব্যবহার করছেন এপারে।

উখিয়া ও টেকনাফে নিবন্ধিত ৩৪টি ক্যাম্পের ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার অর্ধেকের হাতেই রয়েছে মোবাইল ফোন। এসব সিম ব্যবহার করে মাদক, সন্ত্রাস, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ উঠেছে কিছু রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে। শুধু মোবাইল সিম নয়, ক্যাম্পগুলোতে থ্রিজি নেটওয়ার্কে ইন্টারনেট ও স্থানীয়ভাবে ব্রডব্যান্ড লাইনও ব্যবহার করছেন রোহিঙ্গারা। আবার রোহিঙ্গা ভাষার ‘আরাকান টাইমস’, ‘রোহিঙ্গা নিউজ’, ‘আরাকান টুডে’, ‘রোহিঙ্গা টিভি’ নামের এসব অনলাইন টিভির খবর প্রচার করছেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক দোকানি বলেন, রোহিঙ্গারা এই দেশে আসার পর পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সিম নিচ্ছেন। দোকানিরা তাদের কাছে থাকা বিভিন্ন স্থানীয় লোকজনের নামে নিবন্ধিত সিম টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করছেন। এছাড়া মিয়ানমারে এদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। ফলে সেখানেও বাংলাদেশে সিম বিক্রি হয়ে থাকে।

উপজেলা ও জেলায় আইনশৃঙ্খলা সভায় স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের কয়েকটি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়ার কথা বারবার উত্থাপন করে এলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। তাছাড়া কয়েকটি মোবাইল অপারেটর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোবাইল টাওয়ারও নির্মাণ করেছে। ফলে গত জুনে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, পাঁচ লাখের বেশি মোবাইল সিম ব্যবহার করছেন রোহিঙ্গারা। অবাধে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন রোহিঙ্গারা

সীমান্তবর্তী স্থানীয়দের অভিযোগ, এখনও মিয়ানমারের ভেতরে ছয়-সাত কিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশি বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ভেতরেও মিয়ানমারের মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এর ফলে সীমান্তে মাদক, মানবপাচারসহ জাতীয় নিরাপত্তার মতো স্পর্শকাতর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এখনই সময় এসেছে, এসব মোবাইল কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। না হলে বড় ধরনের হুমকি হতে পারে দেশের জন্য।

টেকনাফ ক্যাম্পের সর্দার (মাঝি) মোহাম্মদ একরাম বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে তারা মোবাইল সেট নিয়ে আসেন। এখানে অনেকে সিম কিনছেন। তার ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অনেক আত্মীয়স্বজন মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব ও মিয়ানমারে অবস্থান করছেন। ফলে অনেক রোহিঙ্গা স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন।’

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ রবিউল হাসান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কাছে সিম বিক্রি সম্পূর্ণ নিষেধ। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের মোবাইল সিম বিক্রি থামাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা চলছে। তাছাড়া মিয়ানমারে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্কের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবিষয়ক বৈঠকে অনেকবার বিষয়টি তোলা হয়ছে।’ 

কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘অবৈধ সিম বিক্রি রোধে পুলিশের অভিযান চলছে। সীমান্তে মোবাইল নেটওয়ার্কের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’

আরও পড়ুন- রোহিঙ্গাদের মোবাইল সুবিধা বন্ধের নির্দেশ

/এফএস/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভোটকেন্দ্র থেকে টাকাসহ ইউপি চেয়ারম্যান আটক
ভোটকেন্দ্র থেকে টাকাসহ ইউপি চেয়ারম্যান আটক
স্টার্টআপ বাংলাদেশের সঙ্গে এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার ও উইন্ডমিলের চুক্তি
স্টার্টআপ বাংলাদেশের সঙ্গে এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার ও উইন্ডমিলের চুক্তি
হজ কার্যক্রমের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
হজ কার্যক্রমের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
মতলব উত্তরে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার মৃত্যু
মতলব উত্তরে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
কেমন আছেন মিল্টনের আশ্রমে আশ্রিতরা
কেমন আছেন মিল্টনের আশ্রমে আশ্রিতরা