রেজাউল করিম বাবলু, বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনের সংসদ সদস্য। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, চাকরি দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকলেও হলফনামায় সে তথ্য গোপন করেছেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদালতে এ অভিযোগ প্রমাণ হলে সংসদ সদস্য পদ হারাতে পারেন এমপি বাবলু।
বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করে প্রতারণার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি কখনও রেজাউল করিম বাবলু, কখনও শওকত আলী বাবলু, কখনও শওকত আলী গোলবাগী বাবলু, আবার কখনও রেজাউল করিম গোলবাগী ওরফে শওকত আলী গোলবাগী বাবলু নাম ধারণ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৭ আসনে রেজাউল করিম বাবলু ওরফে শওকত আলী গোলবাগী বাবলু স্বতন্ত্র প্রার্থী (ট্রাক মার্কা) হন। ওই আসনে বিএনপির প্রার্থী না থাকায় বাবলুকে সমর্থন দেয় তারা। ফলে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে হারিয়ে এক লাখ ৯০ হাজার ২৯৯ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বাবলু। নির্বাচনি হলফনামায় তিনি পেশা সাংবাদিকতা ও ব্যবসা উল্লেখ করেন। কৃষিকাজ ও ব্যবসা থেকে বছরে আয় দেখান পাঁচ হাজার টাকা। এই হিসাবে তার মাসিক আয় দাঁড়ায় ৪১৭ টাকা। অথচ নির্বাচিত হওয়ার দুই মাসের মাথায় তিনি ৩২ লাখ টাকা দামের গাড়ি কিনে আলোচনায় আসেন।
তবে বাবলু দাবি করেন, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করতে যাওয়ার জন্য ধনী বন্ধুরা তাকে গাড়িটি কিনে দেন, এমনকি তারা গাড়িটির রেজিস্ট্রেশনও করে দিয়েছেন। এলাকাবাসী জানান, স্থানীয় ইটভাটার মালিকদের ব্যবসায় সুবিধা দেওয়ার কথা বলে বাবলু এমপি ওই গাড়িটি ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০০৭ সালে নিজের প্রতিষ্ঠিত কারিগরি বিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ঘুষ নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে এক ব্যক্তি মামলা করেছিলেন। তবে এমপি বাবলু নির্বাচনি হলফনামায় ৩ (ক) ও ৩ (খ)-তে তার বিরুদ্ধে মামলা থাকার তথ্য গোপন করেন।
ওই মামলার বাদী শাজাহানপুর উপজেলার পোয়ালগাছা গ্রামের শিক্ষক আবু হায়াত জানান, বাবলু ২০০৬ সালে উপজেলা সদরে নিজের গড়া মাঝিরা কারিগরি বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের নামে দু’জনের কাছ থেকে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা করে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা ঘুষ নেন। এই দুজনের একজন হলেন আবুল হায়াত নিজেই।
শিক্ষক আবু হায়াত বলেন, ‘নিয়োগ দিতে না পারলেও এমপি বাবলু আজও সেই টাকা ফেরত দেননি। এ ব্যাপারে তিনি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তার (বাবলুর) বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের জন্য শাজাহানপুর থানায় আসে। বর্তমানে মামলাটি বগুড়ার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
আবু হায়াত আরও জানান, এমপি বাবলু নিজের স্বার্থে একেক স্থানে একেক নাম ব্যবহার করেন। কারিগরি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় সভাপতি হিসেবে তার নাম ছিল ‘শওকত আলী গোলবাগী বাবলু, এমপি হওয়ার পর তার নাম দেখা যাচ্ছে ‘রেজাউল করিম বাবলু’।
অভিযোগের বিষয়ে রেজাউল করিম বাবলু ওরফে শওকত আলী গোলবাগী বাবলু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তার সার্টিফিকেটে নাম রেজাউল করিম বাবলু। আর ওই মামলার আসামি শওকত আলী গোলবাগী বাবলু। তাই তিনি ওই মামলার আসামি না হওয়ায় হলফনামায় তা উল্লেখ করেননি।’
তবে পৌনে পাঁচ শতাংশ জমির রেজিস্ট্রি দলিলে তার নাম শওকত আলী গোলবাগী বাবলু হওয়ার সত্যতা পাওয়া যায়। ২০০৩ সালের ২০ এপ্রিল সম্পাদিত ওই দলিলে (দাগ ১২১৬, হাল দাগ ১৩৭৭) দেখা যায়, এমপি বাবলু ডোমনপুকুর মৌজার শাহনাজ বেগম নমিতা, আছমা বেগম, আছিয়া বেগম ও রাজিয়া সুলতানের কাছ থেকে স্ত্রী বিউটি বেগম ও নিজের নামে জমি কেনেন। বগুড়া জেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে সংরক্ষিত ওই দলিলে দেখা যায়, জমির ক্রেতা ‘মো. রেজাউল করিম গোলবাগী ওরফে শওকত আলী গোলবাগী বাবলু’ উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া শাজাহানপুর প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবেও তার নাম শওকত আলী গোলবাগী। সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রেস ক্লাবের পক্ষে এই নামে তাকে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়।
বগুড়া জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মাহবুব আলম শাহ বলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী পরাজিত প্রার্থী বা অন্য কেউ আদালতের আশ্রয় নিয়ে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে তথ্য গোপনকারী হিসেবে সংসদ সদস্য পদ হারাবেন।’
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) বগুড়া সম্পাদক কে জি এম ফারুক বলেন, ‘হলফনামায় তথ্য গোপন করে আইন অমান্য ও জনগণের সঙ্গে তিনি প্রতারণা করেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে যে কেউ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।’