X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

টর্চার সেল ‘১১১৯’

দুলাল আব্দুল্লাহ, রাজশাহী
০৫ নভেম্বর ২০১৯, ০৭:৪১আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০১৯, ১৮:০৮

রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিতের পর পুকুরে ফেলে দেওয়ার ঘটনার সূত্র ধরে আরও তথ্য বের হয়ে আসছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি, রাজশাহী সরকারি পলিটেকনিকের সব ধরনের উন্নয়ন কাজের টেন্ডার, মেয়েদের যৌন হয়রানি, নবীনবরণসহ নানা অজুহাতে চাঁদাবাজি, পরীক্ষায় পাস করে দেওয়ার নামেও চাঁদাবাজিতে জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়া তাদের মতের বাইরে কোনও শিক্ষার্থী অবস্থান নিলেই তাকে ‘১১১৯’ নম্বর কক্ষে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। রাজশাহী পলিটেকনিকে ছাত্রলীগ যেন এক আতঙ্কের নাম।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের ভয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। ছাত্রলীগ নেতাদের দেওয়া প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলেই ছাত্রীদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। আবার যখন-তখন ক্লাসের মধ্যে ঢুকে শিক্ষার্থীদের জোর করে ডেকে নিয়ে এসে মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। এসবের প্রতিবাদ জানালেই ছাত্রদের ১১১৯ নম্বর কক্ষে ধরে নিয়ে টর্চার করা হয়। এসব কর্মকাণ্ডের আড়ালে নেতৃত্ব দেয় ছাত্রলীগ পলিটেকনিক শাখার সভাপতি মেহেদী হাসান রিগেন ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম। আর সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে থাকে যুগ্ম সম্পাদক কামাল হোসেন সৌরভ, পঞ্চম পর্বের মুরাদ হোসেন, সাবেক ছাত্র শান্ত ওরফে পাওয়ার, সাবেক ছাত্র বনি, সাবেক ছাত্র হাসিবুল ইসলাম শান্ত, সাবেক ছাত্র সালমান ওরফে টনি, সপ্তম পর্বের ছাত্র হাসিবুল, সাবেক ছাত্র মারুফ, সাবেক ছাত্র আবু সায়খান অন্তু, সচিব, মেহেদী হাসান, ওমর ও সাফিন। এদেরমধ্যে বেশিরভাগই স্থানীয় যাদের ছাত্রত্বও নাই অধিকাংশের। এমনকি সভাপতি রিগেন ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদুলেরও ছাত্রত্ব নাই। কিন্তু, স্থানীয় নেদাদের সঙ্গে হাত করে গত তিন বছর ধরে এরা এখনও পলিটেকনিক ছাত্রলীগের রাজনীতি ধরে রেখেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, বছর খানেক আগেও ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক নূরুল্লাহকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঞ্ছিত করে পুকুরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু, ওই সময় তাদের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি বলে বিষয়টি ধামাচাপ পড়ে যায়।

অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রকি কুমার ঘোষ বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ছাত্রলীগের একজনকে চিহ্নিত করতে পেরেছি। অন্যদের চিনি না। সোমবার মহানগর কমিটি থেকে গঠিত তদন্ত দল পলিটেকনিকের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের কাছে জানতে গিয়েছিল। আর অন্য কোনও নেতা-কর্মী এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা। তাদের ব্যাপারে আমরা সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেবো। এছাড়াও টর্চার সেলসহ শিক্ষক সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেসব অভিযোগ উঠছে। তার খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে রাজশাহীতে ছাত্রলীগের কোনও দুর্নাম ছিল না। কিন্তু, এই ঘটনা আমাদেরকেও খুব আঘাত করেছে। শিক্ষককে সম্মানের চোখেই দেখা উচিত।’  

এদিকে অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে নাম থাকা আট আসামির কাউকেই সোমবার (৪ নভেম্বর) সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবে রবিবার রাতে আরও  চারজন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর আগে শনিবার রাতে পাঁচ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। এনিয়ে মোট ৯ জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। আদালতে ৯ জনকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ। তবে তাদের রিমান্ডের শুনানির দিন ধার্য হয়নি।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (সদর) গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘সোমবার দুপুর আড়াইটায় চার জন আসামিকে আদালতে সোপর্দ করা হলে বিচারক তাদেরকে জেল হাজতে পাঠান।’ 

অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিতের প্রতিবাদে মানববন্ধন এখন পর্যন্ত মামলার এজাহারে নাম থাকা আট আসামি গ্রেফতার না হওয়ার গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন,‘সবাই আমাদের কাছে মূল আসামি। অধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা উল্লেখিত ব্যক্তিদের নাম জানতেন। বাকিদের তখন মনে করতে পারছিলেন না। তবে যে নয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদেরকে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা শনাক্ত করার পর গ্রেফতার করা হচ্ছে। আমরা কাউকেই ছাড়বো না। সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।’

রবিবার রাত থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া চার আসামি হলো- নগরীর চন্দ্রিমা থানার আসাম কলোনি এলাকার রবিউল ইসলামের ছেলে মেহেদী হাসান আশিক (২২), শাহ আলমের ছেলে মেহেদী হাসান হিরা (২৩), ছোটবনগ্রাম এলাকার খন্দকার আলমগীরের ছেলে নজরুল ইসলাম (২৩) ও বোয়ালিয়া থানার সাধুর মোড় এলাকার নোমানের ছেলে নাবিউল উৎস (২০)।

শনিবার রাত থেকে রবিবার ভোর পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া আসামিরা হলো- সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী থানার আব্দুল মালেকের ছেলে সোহেল রানা (২০), নড়াইল জেলার নড়াগাছী থানার ফরিদ আলীর ছেলে আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, নওগাঁর মান্দার থানার আফসার আলীর ছেলে সাফি শাহারিয়ার (২৪), নীলফামারী জেলার ধোপাডাঙ্গা এলাকার গোপাল রায়ের ছেলে বাঁধন রায় (১৯) ও রাজশাহী নগরীর চন্দ্রিমা থানার আসাম কলোনি এলাকার রেজাউল করিমের ছেলে রিপন আলী (২০)।

শনিবার রাতে অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদের ওপর হামলার ঘটনায় মহানগরীর চন্দ্রিমা থানায় ৮ জনের নাম উল্লেখ ও ৫০ জন অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়।

প্রতিষ্ঠানটির সিসিটিভির ফুটেজ দেখে কয়েকজনকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেছেন শিক্ষকরা। তারা হলো-ঘটনার নেতৃত্বদানকারী কম্পিউটার বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ও পলিটেকনিক ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন সৌরভ, ইলেকট্রনিক্স পঞ্চম পর্বের শিক্ষার্থী মুরাদ, পাওয়ার বিভাগের সাবেক ছাত্র শান্ত, ইলেকট্রনিক্স বিভাগের সাবেক ছাত্র বনি, মেকাটনিক্স বিভাগের সাবেক ছাত্র হাসিবুল ইসলাম শান্ত, ইলেক্টো-মেডিক্যাল বিভাগের সাবেক ছাত্র সালমান টনি, একই বিভাগের সপ্তম পর্বের ছাত্র হাবিবুল ও কম্পিউটার বিভাগের সাবেক ছাত্র মারুফ।

সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ক্যাম্পাস চত্বরে ছয় দফা দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেছে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের নেতারা আন্দোলনকারীদের ফোনে ও ফেসবুকের মাধ্যমে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এই কারণে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম ছিল।

এদিকে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর থেকে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি সোমবার সকাল থেকেই ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও পুকুরের পানির গভীরতাও পরিমাপ করেছেন। এছাড়া ইনস্টিটিউটের ১১১৯ নম্বর কক্ষে অবস্থিত ছাত্রলীগের টর্চার সেলও পরিদর্শন করেছেন। তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তা বলেন, এখনও আমরা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। সবার সঙ্গে কথা বলে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি।

রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগ গঠিত ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটিও সোমবার সকালে ইনস্টিটিউটে এসে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

উল্লেখ্য, শনিবার (২ নভেম্বর) দুপুরে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্যাম্পাসে অধ্যক্ষ প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এই ঘটনায় শনিবার রাতে অধ্যক্ষ ৫০ জনের বিরুদ্ধে নগরীর চন্দ্রিমা থানায় মামলা দায়ের করেন। রবিবার অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিতের ঘটনায় ছাত্রলীগের পলিটেকনিক শাখার যুগ্ম সম্পাদক কামাল হোসেন সৌরভকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

আরও খবর...
সাঁতার না জানলে অধ্যক্ষের প্রাণনাশের আশঙ্কা ছিল: তদন্ত কমিটি

রাস্তা থেকে ধরে পুকুরে ধাক্কা: ৫০ জনকে আসামি করে অধ্যক্ষের মামলা

 

/এনআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রবিনিয়ো-সোহেল-এমফনের নৈপুণ্যে কিংস সেমিফাইনালে
রবিনিয়ো-সোহেল-এমফনের নৈপুণ্যে কিংস সেমিফাইনালে
রেমিট্যান্স বিতরণ নিয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংক ও নগদের চুক্তি
রেমিট্যান্স বিতরণ নিয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংক ও নগদের চুক্তি
উপজেলা নির্বাচন: মনোনয়নপত্রের হার্ড কপি জমা বাধ্যতামূলক নয়
উপজেলা নির্বাচন: মনোনয়নপত্রের হার্ড কপি জমা বাধ্যতামূলক নয়
খাবার না খাওয়ায় বাবার ‘চড়’, মাথায় আঘাত পেয়ে শিশুর মৃত্যু
খাবার না খাওয়ায় বাবার ‘চড়’, মাথায় আঘাত পেয়ে শিশুর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’