X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

করিডোরে রোহিঙ্গার বসতি, পথ হারিয়ে বিপন্ন বুনো হাতি

আবদুর রহমান, টেকনাফ (কক্সবাজার)
২৫ আগস্ট ২০২০, ১৫:০০আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২০, ০৪:৩১

কক্সবাজারের টেকনাফে মারা যাওয়া বিপন্ন প্রজাতির একটি সাদা হাতি।

কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ও মধুরছড়া ছিল বুনো হাতির নিরাপদ আবাসস্থল। এই করিডোর দিয়ে অবাধে যাতায়াত করতো এসব প্রাণী। কিন্তু  গত তিন বছরে তাদের আবাসস্থল ও যাতায়াতের পথে বসে গেছে রোহিঙ্গাদের বসতি। কাটা পড়েছে খাদ্য হিসেবে বন, বাঁশঝাড়সহ অন্য গাছপালা। রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরায় প্রতিদিন সংকীর্ণ হচ্ছে হাতির আবাসস্থল ও ঘোরাফেরার জায়গা। ফলে পথ হারিয়ে বন্য হাতিরা এখন বিপদে, নানা দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে একের পর এক হাতি।  কক্সবাজার-বান্দরবানের জঙ্গলে থাকা সীমিত সংখ্যক হাতি রোহিঙ্গাদের কারণে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে বিলুপ্তির পথে যায় কিনা সে আশঙ্কা করছেন এখন সংশ্লিষ্টরা।

গত ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এরপর থেকে হাতির চলাচলের রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় এই পর্যন্ত ৯টি বুনো হাতি মারা গেছে।  একই সময়ে বন্য হাতির আক্রমণে ও পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন ১৩ জন রোহিঙ্গাসহ ২২ জন ব্যক্তি। তবে বিভিন্ন দাতা সংস্থার দাবি, হাতির মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

স্থানীয়দের দাবি, রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে নির্বিচারে পাহাড়ের গাছপালা কেটে ফেলার কারণে পাশাপাশি ঘন বন-জঙ্গল সাফ করে ফেলার কারণে আবাস হারিয়ে দিশেহারা হাতির পাল যখন-তখন নেমে আসছে লোকালয়ে। ঘরবাড়ি ও ফসল নষ্টের পাশাপাশি কখনও কখনও পিষ্ট করে মারছে মানুষও। আবার কখনও এসবে অতিষ্ঠ হয়ে হাতিকেই মেরে ফেলছে মানুষ। এ অবস্থায় বনের হাতি বনে রাখতেই সরকার কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতায় আলাদাভাবে ৩১০ একর ‘প্রটেক্টেড এরিয়া ওয়াইল্ড লাইফ করিডোর বনায়ন' নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে করে কমে আসবে হাতির মৃত্যু।

হাতির চলাচলের পথে বসতি গেড়েছে রোহিঙ্গারা। (ফাইল ছবি-হুমায়ুন মাসুদ)

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৮ সাল থেকে চলতি জুন পর্যন্ত ২৩টি হাতি মারা গেছে। অন্যদিকে হাতি ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ফরেস্টের (আইইউসিএন) তথ্য বলছে, চলতি বছরের গত ছয় মাসে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মারা গেছে আটটি হাতি। এর আগে ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগে মারা গেছে ১১টি হাতি এবং কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে মারা গেছে ছয়টি হাতি। বিশেষ করে গত জুন মাসেই লামা, চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং কক্সবাজারের টেকনাফে একটি করে হাতি মারা গেছে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টে নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার পর পাহাড়ের গাছপালা কেটে ফেলার পাশাপাশি ঘন বন-জঙ্গল সাফ করে ৬ হাজার ১৬৪ একর জায়গায় বসতি গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গারা। এর ভেতরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন দাতা সংস্থার অফিসও রয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জ্বালানির প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য ১ হাজার ৮৩৭ একর বনের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৮ হাজার ১ একর পাহাড়, বন-জঙ্গল ধ্বংস করে তাদের দখলে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। তার মধ্যে উখিয়ার বুনো হাতির করিডোর ও আবাসস্থলও ছিল।

কক্সবাজার বন বিভাগ জানিয়েছে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা আসার পর থেকেই বুনো হাতির মৃত্যু সংখ্যা বেড়েছে। ফলে হাতিরক্ষায় সরকার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতায় আলাদাভাবে ৩১০ একর ‘প্রটেক্টেড এরিয়া ওয়াইল্ড লাইফ করিডোর বনায়ন' নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে ১৮৫ একর আয়তনের এলাকায় প্রোটেক্টেড করিডর গড়ে তোলার কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ১২৫ একরের কাজ চলছে, যা আগামী বছরের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এসব বনায়নে বন্যপ্রাণীর খাদ্য হিসেবে জারুল, তেলশুর, ছাপালিশ, বট, কলা, কাঁঠাল, ঢাকি জাম, পুতি জাম, কালো জাম, গর্জন, বর্তা, কদম, বৈলামসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুখাদ্য সংশ্লিষ্ট গাছ এ বনায়নের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

হাতির চলাচলের পথে বসতি গড়েছে রোহিঙ্গারা।

এ বিষয়ে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ন কবির বলেন, ‘হাতিসহ বন্যপ্রাণী রক্ষায় 'প্রটেক্টেড এরিয়া ওয়াইল্ড লাইফ করিডোর' নামে একটি বনায়নের কাজ চলছে। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে, এই অঞ্চলে বন্যহাতির আবাস ও খাবারের কোনও অভাব হবে না। বুনো হাতি আর খাবারের সন্ধানে নির্দিষ্ট এলাকা ছেড়ে কোথাও যাবে না এবং এর মাধ্যমে প্রাণীগুলো রক্ষা পাবে।

কক্সবাজারের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিত সেন বলেন, ‘কক্সবাজার এবং বান্দরবান পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করা হাতির খাদ্য এবং আবাসস্থল বিপন্ন, তাই হাতিরা খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসছে। হাতির নিরাপদ আবাসস্থল এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ওই এলাকার হাতিগুলোর জীবন বিপন্ন হবে।’

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরে ঘন ঘন বন্যহাতির অপমৃত্যুতে কক্সবাজারবাসী শঙ্কিত। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে জেলায় ৮ হাজার একর অধিক বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। পাশাপাশি বন্যহাতির চলাচলের যেসব করিডোর ছিল সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে লক্ষ করা যায় বিগত কয়েক বছরে রোহিঙ্গাসহ ২০ জনের বেশি মানুষ হাতির আক্রমণে মারা গেছে। তাতে আমরা শঙ্কিত।’

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে বনের যে ক্ষতি হয়েছে সেটি পুষিয়ে আনা সম্ভব না। পাশপাশি বন রক্ষায় সরকারি-বেসরকারিভাবে তেমন কোনও উদ্যোগ নেই। যার ফলে এখানে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে, মানুষ এবং জীববৈচিত্র্যের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ একটা মেলবন্ধন ছিল সেইটা কীভাবে ফিরিয়ে আনতে পারি। কীভাবে প্রতিনিয়ত হাতিসহ বন্যপ্রাণীর অপমৃত্যু বন্ধ করা যায় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে। এই বন্যহাতিগুলো সংরক্ষণ করতে হলে হাতির করিডোর পুনরুদ্ধারে কাজ করতে হবে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে হাতি চলাচলের সময় সবাইকে সতর্ক করে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম।

দু’দিন আগে টেকনাফের জাদিমুরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম লিডার নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা যেখানে বসতি করছে সেগুলো হাতির আবাসস্থল ছিল। প্রায় সময় এই খাল দিয়ে হাতির দল চলাফেরা করে থাকে। গতকাল দিনে ও সন্ধ্যায় সেখানে হাতি হানা দিয়েছিল। এসময় আমাদের টিম মানুষদের সতর্ক করে। শিশুদের ঘরে রাখতে মাইকিং করা হয়। পাশপাশি কেউ যাতে হাতির দলের প্রতি কোনও ধরনের ইট পাটকেল না ছোড়ে, সেদিকে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়ে থাকে। যাতে হাতি এবং কোনও রোহিঙ্গা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।’

একইদিনে রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আজীরান বলেন, ‘আমরা যারা পাহাড়ি এলাকায় হাতির আবাসস্থলে ঘর করেছি, তারা বাধ্য হয়েই এখানে থাকছি। প্রতিনিয়ত আমরা হাতির ভয়ে থাকি। প্রতি সপ্তাহ, প্রতি মাসে বন্য হাতি এখানে হানা দেয়। গতকালও এসেছিল। কী করি কোথাও জায়গা  না পেয়ে হাতির জায়গায় ঢুকতে হয়েছে। সরকার যদি অন্য কোথাও নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়, সেখানে যাবো।’

বন বিভাগের টেকনাফ রেঞ্জ কর্মকর্তা সৈয়দ আশিক আহমেদ বলেন, ‘২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে ব্যাপক হারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার পর বন ও পাহাড়ে তাদের আশ্রয়স্থল হওয়ায় হাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের পাশে হাতির মেইন করিডোর ছিল, সেটি রোহিঙ্গারা দখল করেছে। এতে সেখানে হাতির চলাফেরায় বাধা সৃষ্টি এবং খাদ্য আহরণের বনভূমি দখল হয়ে যাওয়ায় খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে বন্যপ্রাণীর। এই জায়গাটি তিন বছর আগে ছিল ঘন বন, এখন হয়ে গেছে লোকালয়। হাতির দল কী করবে?

তিনি বলেন, হাতিরা আবাসস্থল হারিয়ে ফেলে বিভিন্নভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। আবার হাতির চলাফেরার স্থান দিয়ে বিদ্যুৎ লাইন টানা হচ্ছে। হাতিকে রক্ষা করতে হলে বনের পাশে বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করা যাবে না। ইতোমধ্যে বনের হাতি রক্ষায় সরকারিভাবে বনায়নের কাজ চলছে। সেটি শেষ হলে অনেকটা রক্ষা পাবে হাতিসহ বন্যপ্রাণীরা। 

আরও পড়ুন:

রাখাইনে সেফ জোন প্রতিষ্ঠা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে উৎসাহিত করবে 

ইয়াবা চালান, মজুত ও লেনদেনের নিরাপদ ঘাঁটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প! 

শেখ হাসিনার প্রস্তাবনা মেনে মিয়ানমারে ফিরতে চান রোহিঙ্গারা 

করোনার মধ্যে ৩০ হাজার রোহিঙ্গার ঠিকানাসহ তালিকা পাঠিয়েছে মিয়ানমার: পররাষ্ট্রমন্ত্রী 

রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার পথে সব ধরনের বাধা সৃষ্টি করছে মিয়ানমার 

নিরাপত্তাহীনতায় স্থানীয়রা, রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব বাড়ছে 

করিডোরে রোহিঙ্গার বসতি, পথ হারিয়ে বিপন্ন বুনো হাতি 

রোহিঙ্গাদের জন্য হুমকিতে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প: বাড়ছে অপরাধ 

করোনা: প্রবল স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয়রাও

রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে সরকারের চেষ্টা অব্যাহত আছে

সমাবেশের অনুমতি নেই, আজ স্বেচ্ছায় ঘরে থাকবেন রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গা সংকট: কূটনৈতিক ও করোনা জটিলতায় শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন

/টিএন/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
দুই মাসে ব্র্যাক ব্যাংকে আড়াই হাজার কোটি টাকা নিট ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন 
দুই মাসে ব্র্যাক ব্যাংকে আড়াই হাজার কোটি টাকা নিট ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন 
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি হয়নি
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি হয়নি
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা