X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশের আর কোনও ক্ষতি হতে দেবো না

কাজী খলিলুর রহমান
২৪ ডিসেম্বর ২০১৫, ০৯:০০আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫, ০৯:০০

কাজী খলিলুর রহমান১৯৭১ সালে আমার বয়স ১৫ থেকে ১৬ বছর। আমরা এই বয়স পর্যন্ত লেখাপড়া করতাম না, বাবাকে চাষাবাদে সাহায্য করতাম। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, পাকবাহিনী বিভিন্ন এলাকা আক্রমণ করছে, সে কথা জানতাম। ৫ জ্যৈষ্ঠ পাকসেনারা আক্রমণ করে মাদারীপুরের উত্তর দুধখালীর হিন্দু এলাকায়। আক্রমণে প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ।

পাকদের আক্রমণে সাহায্য করে কিছু স্বার্থলোভী বিশ্বাসঘাতক বাঙালিরা রাজাকাররা। পাকিস্তানি বাহিনীর সমর্থকরা পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য একটি সংগঠন করেন। এ সংগঠনের নাম দেন পিস কমিটি। এই পিস কমিটির কাজ ছিল পাক বাহিনীকে হিন্দু বাড়ি দেখিয়ে দেওয়া, ওইসব বাড়ির সম্পদ লুট করা। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান দেখিয়ে দেওয়া। তৎকালীন পিস কমিটির সদস্যরা আড়াল থেকে শিকদার বাড়ি আক্রমণ করতে পাকসেনাদের সাহায্য করে।

শিকদার বাড়ি তখন ফরিদপুর জেলার মধ্য অন্যতম ছিল। বাড়িটা এমন সুন্দর ছিল যে, অনেকেই এই বাড়িটিকে রাজপ্রাসাদ মনে করতেন।  বাড়িতে ১৬টিরও বেশি পাকা দালান ছিল। প্রতিটি দালান দুই ও তিন তলাবিশিষ্ট ছিল। যার কিছু নিদর্শন আজও রয়েছে। বাড়িতে শতাধিক লোকের বসবাস ছিল। সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করছিলেন। হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ের মতো শান্তপ্রিয় মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকবাহিনী। আক্রমণের খবর শুনে হিন্দুপাড়ার লোকেরা হতভম্ব হয়ে পড়লেন। সবাই চারিদিক ছুটতে লাগলেন। তারপরও চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা ৭০ জন হানাদারের আক্রমণে সেদিন প্রাণ হারান ৮৫ বাঙালি। হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দেয় তাদের ঘরবাড়ি। গোলাগুলির শব্দ শুনে আমরা অনেক দূরে পালিয়ে যাই। আক্রমণ শেষে সন্ধ্যার দিকে হিন্দুপাড়ায় এসে লাশ আর লাশ দেখি।  জীবন বাঁচাতে বাড়িতে, জমিতে, জঙ্গলে যে যেখানে পালিয়ে ছিল সবাই লাশ হয়ে যায়। এক জায়গায় ৭টি লাশ একত্রে দেখি। লাশগুলো দেখে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। ভাবতে লাগলাম যে, মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে। এভাবে আমাদের দেশের মানুষকে নির্বিচারে মেরে ফেললে, আমরা ওদের গোলাম হয়ে যাব। আমার মনে সাহস জাগল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার।

আমি খোঁজ করতে থাকি কারা মুক্তিযুদ্ধে যাবেন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে গোপনে একটি দল তৈরি করে ফেলি। আমি যুদ্ধে যাব সে কথা বাড়ির কেউ জানতেন না। এক দিন রাতে কাউকে না বলে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দুধখালী ইউনিয়নের চণ্ডিবর্দী গ্রামের মোকলেস বেপারীর বাড়িতে জমায়েত হই। সেদিন ছিলেন আলাউদ্দিন মাতুব্বর, মালেক মোল্লা, সাহাবদ্দিন হাওলাদার, গনেশ ঘোষ, মোশারেফ মোল্লা, বাচ্চু খলিফা, শাজাহান চৌকিদার, মোকলেস বেপারী ও তালেব হাওলাদার। তাদের মধ্যে সবার ছোট ছিলাম আমি। সেদিন আমরা কিভাবে ভারতে যাব, এ নিয়ে আলোচনা করলাম। রাত ১০টার দিকে আমরা ভারতের উদ্দেশে রওনা দিলাম।

যুদ্ধে যাওয়ার কারণ ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচার বন্ধ করে দাতভাঙা জবাব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা। যুদ্ধে জীবন বিপন্ন হয়, এ কথা জানতাম। কিন্তু ওদের নির্মম অত্যাচারে জীবনের মায়া শেষ হয়ে যায়। জীবনকে বাঁচানোর জন্য আমরা যুদ্ধ করি। ভারতে পৌঁছানোও তখন নিরাপদ ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু। ৫ দিন পর আমরা যশোরে পৌঁছাই। পথিমধ্যে ভিক্ষা করে খাবার সংগ্রহ করে খাই। যশোর থেকে কিভাবে ভারতে যাব, তার পথ খুঁজতে থাকি। সেই দিন রাতে আমরা একটি বাড়িতে রাত্রিযাপন করি। তারা আমাদের রাতের খাবার খাইয়ে রাতভর পাহারা দেন। ফজরের আজানের সময় ঘুম থেকে উঠিয়ে ভারতে যাওয়ার পথ ধরিয়ে দেন। সূর্যের আলো চারদিক ছড়িয়ে পড়ার আগেই আমরা  কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে পৌঁছি। নদী পার হওয়ার নৌকা ছিল ওপারে। আমি নদী সাঁতরে নৌকা এপারে আনি। ভারতে যাওয়ার সহজ পথ ছিল ট্রেন। কিন্তু যশোরের ট্রেন স্টেশন ছিল সম্পূর্ণ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। তাই সে পথে না গিয়ে আমরা জঙ্গলের পথে হাঁটতে শুরু করলাম। অবশেষে আমরা চাঁদপাড়া ক্যাম্পে পৌঁছই।

চাঁদপাড়া ক্যাম্পে আমাদের সঙ্গে মতি উকিলের দেখা হয়। তিনি মাদারীপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধা এনে ভারতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। তিনি আমাদের বললেন, মাতৃভূমির টানে তোমরা যুদ্ধে এসেছ ভালো কথা। যুদ্ধ করা সহজ কাজ নয়, প্রথমে তোমাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক কষ্ট-ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। বিনিময়ে তোমরা কিছুই পাবে না। আমরা বললাম, বিনিময় চাই লাল সবুজের পতাকা। শোষণের হাত থেকে মুক্তি। এই মুক্তির জন্য আমরা সব কিছুই করতে পারি। চাঁদপাড়া ক্যাম্পে আমাদের ২৪ দিন বাঁশের লাঠির সাহায্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখান থেকে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য বীরভূম পাঠানো হয়।

মেজর জলিলের নেতৃত্বে ১২০০ জনকে ট্রেন যোগে সেখানে পাঠানো হয়। হাজারো দামাল ছেলে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য আসে। আমরা যেদিন সেখানে পৌঁছাই, সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ক্যাম্পটি উদ্বোধন করেন। তিনি উদ্বোধনী ভাষণে বাঙালি দামাল ছেলেদের প্রশংসা করে বলেন, তোমরা এত ছোট। তোমারা দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে এসেছো, তার জন্য আমি খুব খুশি। কথাগুলো ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলেছিলেন। তিনি অভয় দিয়ে বললেন, তোমরা তোমাদের কাজ চালিয়ে যাও। ভারত সরকার তোমাদের সহযোগিতা করে যাবে। তোমাদের দেশ নিশ্চয়ই শত্রুমুক্ত হবে। তার ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে ট্রেনিংএর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই। সেনাবাহিনীরা আমাদের নাম নিবন্ধন করে মেডিক্যাল করে। আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়া হয়। আমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হতো ভোর ৪টায়। দেশ-বিদেশের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। অস্ত্রের মধ্যে ছিল থ্রি নট থ্রি, এসএলআর,  এসএমজি, এলএমজি, চায়না, ব্রিটিশিয়ান, রাশিয়ান হেবি মেশিনগান, মর্র্টার, টুইঞ্চ, থ্রিইঞ্চ, কামান, ছোট থাট্রি সিক্স  হ্যান্ড গ্রেনেড, ছোট বোমা, বড়বোমা ও বিভিন্ন ধরনের ডিনামাইড।

প্রতিদিন সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। অল্পদিনের মধ্যেই আমি সব অস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করি। যুদ্ধের প্রশিক্ষণের কষ্টের কথা মনে হলে আজও চোখে পানি এসে যায়। মাতৃভূমির টানে অসহ্য কষ্ট করেছি। এক মাস প্রশিক্ষণের পর আমাদের কোলকাতায় রেস্টহাউজে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণের ক্লান্তি দূর করার জন্য এখানে আমাদের রেস্টে দেওয়া হতো। সেখান থেকে আমাদের দেশে পাঠানো হয়। প্রত্যেককে দেওয়া হয় একটি মেশিন গান, একশত রাউন্ড গুলি, হ্যান্ডবোমা এবং ৫০ টাকা।

দেশে ফিরে আসতে হবে। শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। দুই মাস পর দেশে ফিরেছি বাড়ির খোঁজ কিছুই জানতাম না। বাড়িতে কি সবাই বেঁচে আছে? এ প্রশ্ন বার বার মনে জাগত। দেশে ফিরে আগে মাকে দেখব, না যুদ্ধে যাব—এই চিন্তা করতাম। দেশে ফেরার পথে টেকারহাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে আমাদের প্রথম লড়াই হয়। আমাদের কোনও ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে আসি। বাড়ির সবাই আমাকে দেখে অবাক হয়। তারা ভেবেছিল আমি মারা গেছি। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেন।

দেশে এসে দেশের অবস্থা সর্ম্পকে জানলাম। প্রথমে দেশের রাজাকারদের হত্যা করতে আরম্ভ করলাম। আমরা মাদারীপুরের কুলপদ্মী, টেকেরহাট ও সমাদ্দর থেকে পাকবাহিনীদের বিতাড়িত করি। টেকেরহাট আক্রমণ করার সময় আমি দল থেকে বিছিন্ন হয়ে যাই। বাড়িতে ফেরার পথ হারিয়ে ফেলি। আমার দলের সবাই আগে বাড়ি ফিরে এসে খবর দেন, আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির সবাই কান্নাকাটি শুরু করেন।

সমাদ্দারে দুদিন যুদ্ধের পর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। সেদিন ছিল ১০ ডিসেম্বর। মাদারীপুর স্বাধীন হয় ১০ ডিসেম্বর। বিজয়ের আনন্দে আমরা লাল-সবুজের পতাকা উড়াই। আমাদের কষ্টে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। অপেক্ষায় থাকি স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলার বুকে ওড়ে স্বাধীনতার পতাকা। স্বাধীন বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলাদেশ।

আমাদের কষ্টে অর্জিত বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা বসবাস করছে। দেশদ্রোহীদের আমরা আর দেশের কোনও ক্ষতি করতে দেব না। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার না হলে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরব থাকবে না। বর্তমান সরকারের কাছে দাবি এই বিচার শেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্ব যেন রক্ষা করে।

বর্তমান প্রজন্ম জানে না মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধাদের উচিত বর্তমান প্রজন্মকে যুদ্ধের ইতিহাস জানানো। বর্তমান প্রজন্মের কাছে আমার দাবি, এই কষ্টের বাংলাকে অপশক্তি দ্বারা ক্ষতি হতে দেবেন না। মাকে ভালোবাসার মতো দেশকে ভালোবাসতে হবে।

 

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার।

 

অনুলিখন: জহিরুল ইসলাম খান

 

/এমএনএইচ/আপ-এফএস/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়