X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১
মুকুল এসেছে কিন্তু বিক্রি হয়নি বেশিরভাগ বাগান

আম পাড়ার সময়সীমা পরিবর্তনের দাবি চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাষিদের

আনোয়ার হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
০২ মার্চ ২০১৬, ০৭:৪৫আপডেট : ০২ মার্চ ২০১৬, ১০:৩৯

আমের মুকুল আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের চারিদিকেই এখন গাছে গাছে মুকুলের সমারোহ। মুকুলের ম-ম গন্ধে সুরভিত আমবাগানগুলো। সোনা রং ধারণ করে বাগানগুলো যেন সেজেছে নতুন সাজে। সারিবদ্ধ গাছে ভরপুর আমের মুকুল, যেন শোভা ছড়াচ্ছে তার নিজস্ব মহিমায়। হাসির ঝিলিক এখন আমচাষিদের মুখে। চলতি আম মৌসুমে দেরিতে হলেও আবহাওয়া এখন অনুকূলে থাকায় এরই মধ্যে ৯০ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছে। সেই মুকলের পরিচর্যা আর পোকার আক্রমণ ঠেকাতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন আম চাষিরা। আর ভালো ফলনের জন্য কৃষি বিভাগ থেকেও দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন নিদের্শনা।
ল্যাংড়া, ফজলি, গোপাল ভোগ, খিরসাপাত, মোহনভোগসহ বিভিন্ন জাতের আমের ফলন হয় এখানে। আর মুকুল ধরে রাখতে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ছিটিয়ে গাছের বাড়তি যত্ন নিচ্ছেন চাষিরা। যত বেশি মুকুল রক্ষা করা যাবে আমের ফলন তত বেশি হবে। তবে ফলন ভালো করতে মুকুল ও গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করলেও উদ্বিগ্ন আম চাষিরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, পর পর গত দু’বছর জেলায় প্রচুর আম উৎপাদন হলেও বাজারজাতকরণে প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতায়  ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছিলো তাদের। তারা বলছেন, গত বছর গাছ থেকে আম নামানোর সময়সীমা বেঁধে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। এতে চরমভাবে আর্থিক ক্ষতির শিকার হন আম চাষি, বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। আর এই সুযোগে দেশীয় আম নামানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ভারত থেকে আম আমদানি করেছিল। এতে দেশীয় ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর অনাকাঙ্ক্ষিত এ পরিস্থিতিতে এবারও যেন আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের পড়তে না হয়, এমন সিদ্ধান্ত না নেওয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন, জেলার আম চাষি, বাগান মালিক ও ব্যবসায়ী এবং সংগঠনের নেতারা।

আমের মুকুল দেশের সিংহভাগ আম উৎপাদিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় । কিন্তু ২০১৪ সালে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের হরতাল, ২০১৫ সালে টানা অবরোধ-হরতালের প্রভাবে আমব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়ে। বিশেষ করে আম বেশী উৎপন্নকারী এলাকা শিবগঞ্জ ও কানসাটে ট্রাকে পেট্রোল বোমা ছুড়ে একাধিক চালক ও হেলপারসহ ট্রাক পোড়ানোর ঘটনায় জেলার বাইরের আম ব্যাপারীরা কম আসায় এখানকার ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১ জুনের আগে পোক্ত আম পাড়ার ওপর জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা ও কার্বাইড-ফরমালিন আতঙ্কে আমব্যবসায়ীরা আমের দাম না পেয়ে কয়েকশ’ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েন। কেননা, প্রাকৃতিকভাবে নির্দিষ্ট সময়ে আম পেঁকে যায়। অথচ স্থানীয় প্রশাসন জোরপূর্বক গাছ থেকে আম ভাঙার সময় বেঁধে দেওয়ায় ঐসময় একসঙ্গে আম পেকে যায় এবং বাজারে ব্যাপক আমের আমদানি হওয়ায় আম নামমাত্র দামে বিক্রি হয়। এমনকি প্রচণ্ড গরমে বিপুল আম পচেও নষ্ট হয়। এছাড়া ঢাকার অভিমুখে নেওয়ার পথে গাজীপুরে ফরমালিনের অজুহাতে আম পরীক্ষার নামে অনেক ট্রাকের আম বুলড্রেজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়। অথচ পরে ফরমালিন পরীক্ষার যন্ত্রটি ত্রুটিপূর্ণ বলে উচ্চ আদালত রুলিং দেয়। ত্রুটিপূর্ণ ওই ফরমালিন মেশিনে পরীক্ষার নামে চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার আম ক্ষতি হয় বলে আমব্যবসায়ী মো. বাহরাম আলী জানান, যদিও এর কোনও ক্ষতিপূরণ ব্যবসায়ীরা পাননি।

আম বাগান

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জেলায় আম মৌসুমে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার আমের ব্যবসা হয় এবং ৬ মাসে ২ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর বাগান মালিকরা তাদের বিক্রিত আমবাগানের টাকা দিয়ে সংসারসহ বাড়তি খরচ করে থাকে। ইতোমধ্যে জেলার সর্ববৃহৎ আমের বাজার কানসাট আম ব্যবসায়ী সমিতি, ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশন, চেম্বার অব কমার্স, ম্যাংগো প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন চলতি বছরে আম ভাঙার সময় বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা এবং প্রশাসনের অহেতুক হয়রানি বন্ধে বিভিন্ন ফোরামে জোরালো দাবি তুলেছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানান, প্রাকৃতিকভাবে আম পেকে থাকে, কিন্তু গতবার জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পোক্ত আম পাড়ার সময় বেঁধে দেওয়ায় অনেক আমচাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবছর এ সিদ্ধান্তটি বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করার আশ্বাস দেন তিনি। 

নবাগত জেলা প্রশাসক মো. জাহিদুল ইসলাম জনান, জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল আম । এ আম নিয়ে অনেকেই গত বছর ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছিলেন। তাই এবার জেলা আম পরিবীক্ষণ কমিটির সামনের সভায় আমব্যবসায়ীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আম বাগান ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক চুটু বলেন, এবছর যদি আম ভাঙার ক্ষেত্রে আবারও সময় বেঁধে দেওয়া হয়, তাহলে সব ব্যবসায়ী, আমচাষীসহ সবাইকে নিয়ে গণঅন্দোলন গড়ে তোলা হবে। তবে তারা ইতিমধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য, কৃষি বিভাগ, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসহ আম সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আমচাষীদের লোকসানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মতবিনিময় শুরু করেছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ বলেছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুমিষ্ট আম নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। চলতি বছরে যাতে আমচাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য তাদের পক্ষ থেকে কৃষিমন্ত্রী, এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন ফোরামে যোগাযোগ শুরু করেছেন। 

ম্যাংগো প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনিরুল ইসলাম বলেন, গত বছরের আম মৌসুমে  জেলা প্রশাসনের একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালালেও, কোথাও ফরমালিন বা কার্বাইড মিশ্রিত আম জব্দ করতে পারেনি। তারপরও ফরমালিন আতঙ্কে ভোক্তাদের আমের ব্যাপারে অনাগ্রহ তৈরি হওয়ায় এ জেলার আমব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

কানসাট আম আড়তদার ব্যবসায়ী সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী এমদাদুল হক জানান, প্রতিবছর এসময় বাগান ২/৩ বার হাত বদল হয়ে থাকলেও এখন পর্যন্ত একবারও বিক্রি না হওয়ায় বাগানমালিকরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

নবাবগঞ্জ আম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. সেরাজুল ইসলাম জানান, এ জেলার অহংকার হচ্ছে আম।  আর এখানকার আমচাষীরা বরাবরই ফরমালিন বা কার্বাইড মিশ্রিত করে না। তারা সৎভাবে যুগযুগ ধরে আম ব্যবসা করে আসছে। অথচ একটি মহলের হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে গত বছর প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা আমচাষীদের লোকসান গুনতে হয়। এ কারণেই চলতি বছর এখন পর্যন্ত অধিকাংশ আমবাগান বেচাকেনা না হওয়ায় এখানকার মানুষজন আর্থিকভাবে ভালো নেই। এমনকি আম নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী। 

আমের মুকুল এদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফল গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সরফ উদ্দীন জানান,‘আম নামানোর কোনও সময় হয় না, এটা আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। একেক জাতের আম একেক সময় পাকে।  তাই আমের বাজারজাতকরণের সময় পাকা আম পাড়ার ওপর সময়সীমা বেঁধে দেয়া সমীচীন নয়।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সাজদার রহমান জানান, এবছর আমের অফ এয়ার হওয়া সত্ত্বেও, বাগানগুলোতে মুকুলে মুকুলে ছেয়ে গেছে। জেলার ৫টি উপজেলার ২৪ হাজার ৪শ ৬০ হেক্টর জমিতে ১৮ লক্ষ ৫৮ হাজার ৭শ’ ৭০ টি গাছ রয়েছে। এবার ২ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন প্রতিটি বাগানে আমচাষীরা মুকুলে যাতে ছত্রাক জাতীয় রোগে আক্রান্ত না হয়, সেজন্য কীটনাশক স্প্রে করে গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছে। জানুয়ারি মাসে ১৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়াসহ এ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আমের উৎপাদন এবারও বাম্পার হবে বলেই মনে করছেন কৃষি বিভাগ।

/টিএন/আপ-এনএস/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী