X
সোমবার, ২০ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দুঃখ-কষ্টের দিন শেষ নাসিমার

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র, সুনামগঞ্জ
২০ মার্চ ২০২৩, ১৯:৩৯আপডেট : ২০ মার্চ ২০২৩, ১৯:৩৯

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় মুজিব পল্লীতে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছেন জীবন সংগ্রামী নাসিমা খাতুন। বছরের পর বছর দুঃখে-কষ্টে বসবাসের পর অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া একখণ্ড জমি ও ঘর পেয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে কষ্টের দিন শেষ হলো তার।

আশির দশকের কথা। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পদ্মা তীরের বিষকাঠালী গ্রামের হাবিবুর রহমান ও পিয়ারা খাতুনের তিন সন্তানের মধ্যে নাসিমা খাতুন বড়। বাবা ছিলেন দিনমজুর আর মা গৃহিণী। হাইমচর থানার গন্ডামারা উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৯৭ সালে সন্তোষপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

বিয়ের পর অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। পরে আনোয়ার সৌদি আরব যাওয়ার কথা বলে নাসিমার মায়ের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নেন। সৌদি যাওয়ার পরে নাসিমার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন আনোয়ার। ইতোমধ্যে পদ্মার ভাঙনে নাসিমাদের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। 

২০০০ সালে নাসিমার পরিবার চলে আসে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামে। সেখানে থিতু হয়। ২০০৫ সালে পোশাক কারখানায় কাজের জন্য নাসিমাকে ঢাকায় নিয়ে যান তার বাবা। মগবাজারে একটি পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেন নাসিমা। শুরু হয় জীবন সংগ্রাম।

পোশাক কারখানায় চাকরির সময় ২০০৫ সালে ফরিদপুরের ইয়াদ আলীকে বিয়ে করেন। বিয়ের আগে নাসিমা জানতেন না ইয়াদ মাদকাসক্ত। তার বেতন মদ ও জুয়া খেলে শেষ করতেন ইয়াদ। প্রতিবাদ করলে নির্যাতন করতেন। তবু সব সহ্য করেছেন। এরই মধ্যে দুই সন্তানের মা হন। শুরু হয় সংসারে টানাপোড়েন। মাদকাসক্ত স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন নাসিমা। একপর্যায়ে স্বামীকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেন। তখন আবারও শুরু হয় স্বামীর নির্যাতন। এ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জে গিয়ে একটি পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেন। পরে জানতে পারেন ইয়াদ আবারও বিয়ে করেছেন। সেইসঙ্গে নাসিমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

নাসিমা খাতুন জানিয়েছেন, বিয়ের পর নাসিমা ও তার ছেলেমেয়ের খোঁজ নেননি ইয়াদ। ছেলেমেয়েকে মানুষ করার জন্য নিজেই চেষ্টা চালিয়ে যান। নারায়ণগঞ্জের তারাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে মেয়ে সুরমা আক্তার মুন্নিকে ভর্তি করে দেন। মেধাবী হওয়ায় কষ্ট করে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যান। এমনও দিন গেছে, সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কারখানায় কাজ করে বাসায় এসে দেখেছেন ছেলেমেয়ে রান্নাঘরের চুলার পাশে ঘুমিয়ে আছে। শেষমেশ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ছয় বছরের মুন্নি ও আড়াই বছরের ছেলে মিঠুকে নানার বাড়ি জগন্নাথপুরে পাঠিয়ে দেন। নানার বাড়িতেও দুই সন্তান নির্যাতন এবং অবহেলার শিকার হন।

তিনি আরও জানিয়েছেন, সন্তানদের কথা ভেবে চলে আসেন বিশ্বম্ভরপুরে। সেখানে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে দর্জির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। পাশাপাশি মেয়ে মুন্নিকে বিশ্বম্ভরপুরের দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। পরে সবুজ কুড়ি বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। ওই বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পায় মুন্নি। এরপর কাটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করেন। ২০২৩ সালে এই বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে মুন্নি।

সুরমা আক্তার মুন্নি জানায়, প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে সকাল ৭টা পর্যন্ত লেখাপড়া করে স্কুলে যাই। বাড়ি ফিরে বিকালে তিন ঘণ্টা সেলাইয়ের কাজ করে আবার পড়তে বসি। সেলাইয়ের সব কাজ জানি। সেলাইয়ের কাজ করে যা আয় তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চালান মা। তবে ঘর ভাড়া নিয়ে সবসময় আমাদের ঝামেলায় পড়তে হতো। ঘর ভাড়া দিলে আর সংসার চালানোর খরচ থাকতো না মায়ের কাছে। বছরের পর বছর এভাবে কেটেছে আমাদের। অবশেষে সরকারি ঘর পাওয়ায় সেই কষ্ট দূর হয়েছে। 

মুন্নি আরও জানায়, ছোট ভাই সোহরাব হোসেন মিঠু কাটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। তার ও আমার স্কুলের শিক্ষকরা সবসময় বইখাতা ও কলম দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেন। কেউ কেউ অর্থ-সহায়তাও দিয়েছেন। এজন্য এতদূর আসতে পেরেছি আমরা।

কাটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেনজির আহমদ মানিক বলেন, ‘মুন্নিকে আমরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করি। ভবিষ্যতেও সহায়তা করবো। স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য তাকে বাইসাইকেল কিনে দেওয়া হয়েছে।’

চার বছর ধরে মুন্নিকে বিনা খরচে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন বলে জানালেন একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হাসনাত কবীর স্বপন। তিনি বলেন, ‘বিদ্যালয় থেকে মুন্নির বেতন মওকুফ করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস, মুন্নি আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’  

/এসএন/এএম/
সম্পর্কিত
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের বাসিন্দারা পানিবন্দি
এখন আর পাহাড়ের পাদদেশে নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে না জরিনাকে
‘বেঁচে থাকার শক্তি জুগিয়েছে এই ঘর, শেখ হাসিনার কাছে আমরা চিরঋণী’
সর্বশেষ খবর
চোর সন্দেহে যুবককে গাছে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা
চোর সন্দেহে যুবককে গাছে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা
কারাগারে আশফাক ও ইশরাক, ফখরুলের নিন্দা
কারাগারে আশফাক ও ইশরাক, ফখরুলের নিন্দা
এক কনস্টেবলের ৬২ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ
এক কনস্টেবলের ৬২ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে যমুনার নতুন শোরুম
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে যমুনার নতুন শোরুম
সর্বাধিক পঠিত
রাইসির হেলিকপ্টারের অবস্থান ‘শনাক্ত’, সুসংবাদের প্রত্যাশা
রাইসির হেলিকপ্টারের অবস্থান ‘শনাক্ত’, সুসংবাদের প্রত্যাশা
ঋণ খেলাপের দায়ে স্ত্রী-ছেলেসহ স্টিল মিল মালিকের কারাদণ্ড
ঋণ খেলাপের দায়ে স্ত্রী-ছেলেসহ স্টিল মিল মালিকের কারাদণ্ড
জাপানিদের স্বাস্থ্যকর এই ৭ অভ্যাসের কথা জানতেন?
জাপানিদের স্বাস্থ্যকর এই ৭ অভ্যাসের কথা জানতেন?
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত
কী থাকছে হিমায়িত মাংস আমদানি নীতিমালায়
কী থাকছে হিমায়িত মাংস আমদানি নীতিমালায়