X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় কিয়ারোস্তামি, বিদায় মায়েস্ত্রো

প্রসূন রহমান, অতিথি লেখক
০৫ জুলাই ২০১৬, ১২:০৮আপডেট : ০৬ জুলাই ২০১৬, ১৩:১৭

আব্বাস কিয়ারোস্তামি (১৯৪০-২০১৬, ৪ জুলাই) গতকাল রাত পর্যন্ত সবচেয়ে প্রিয় জীবিত চলচ্চিত্র নির্মাতার নামটি ছিল- আব্বাস কিয়ারোস্তামি। সত্যিকার অর্থে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতার যদি তালিকা হয় তবে তার নামটিই থাকবে সবার শীর্ষে। গতকাল (৪ জুলাই) ক্যানসার তাকে নিয়ে গেছে না ফেরার দেশে।
গত মার্চে যখন প্রথম আক্রান্ত হওয়ার খবরটি আসে তখন থেকেই হারাবার ভয়টা কাজ করছিল মনে। ক্ষীণ আশাও ছিল, হয়তো এ যাত্রায় টিকে যাবেন। প্যারিসে তার চিকিৎসায় ত্রুটি থাকার কারণ ছিল না। কিন্তু শেষাবধি এটাই সত্য, ‘উইন্ড উইল ক্যারি আস’ অল।
অনেকের মতো ‘টেস্ট অব চেরি’ দিয়েই তার কাজের সঙ্গে পরিচয়। ১৯৯৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘পাম ডি অর’ পাওয়ার পরই বিশ্বজোড়া তার খ্যাতির বিচ্ছুরণ। তবে ‘ক্লোজ-আপ’ চলচ্চিত্রটিও আমাদের অনেককে বিমোহিত করেছিল। আর তাকে ভালো করে জানবার সুযোগ হয়েছিল প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদের কাছ থেকে। জানতে পারি ‘মাটির ময়না’ যে বছর কানে পুরস্কার পায়, সে বছর তিনিও ছিলেন সে উৎসবে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অনুরাগীর জন্য কিয়ারোস্তামির একটি সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেছিলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ।
মূলত ‘মাটির ময়না’ দেখার পরেই বাংলোদেশ সম্পর্কেও তার মাঝে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, দেশটা একবার দেখার।মনে পড়ে, তারেক মাসুদ বিভিন্ন উপলক্ষে বেশ কয়েকবার তাকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু শেষাবধি সে সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি তার। বলা বাহুল্য, তারেক মাসুদের প্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতার তালিকায় তিনি শীর্ষে ছিলেন। কিয়ারোস্তামির কাজ নিয়ে তারেক ভাইয়ের যেমন আগ্রহ ছিল, তেমনি আগ্রহ ছিল কাজের ধরন নিয়েও। বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রে অপেশাদার ও অনভিজ্ঞ শিল্পী নিয়ে কাজ করবার ইতিবাচক দিকগুলোকে তারেক ভাইও অনুশীলন করে দেখতে চেয়েছেন এবং আশানুরূপ ফল পেয়েছেন বলেই স্বীকার করতেন।
কিয়ারোস্তামিকে নিয়ে তারেক মাসুদের নিজের নিমগ্ন পাঠ ছিল বলেই ২০১০ সালের অক্টোবরে ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির আয়োজনে আব্বাস কিয়ারোস্তামির কাজের উপর ৩ দিনের একটি কর্মশালা পরিচালনা করেন তিনি। ‘অ্যা নিউ থট এন্ড ল্যাংগুয়েজ অব সিনেমা’ শিরোনামের ঐ কর্মশালা পরিচালনায় তার সহযোগী থাকবার সুযোগে আমার নিজেরও একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠের সুযোগ ঘটে যায়। বলা যায়- তাকে সম্পূর্ণ ভালো লাগার শুরুও তখনই। সেই থেকে অদৃশ্য প্রেমের মতোই সম্পর্ক স্থাপন। সেই থেকে ‘পথের পাঁচালী’র নির্মাতার (সত্যজিৎ রায়) পাশাপাশি তার নামটিরও বুকের মাঝে চিরস্থায়ী গেঁথে যাওয়া। তখন থেকে তার ‘কোকার ট্রিলজি’র গ্রামটি যেন আমারই গ্রাম। তার গাড়ির জানালা দিয়ে আমিও একই ল্যান্ডস্কেপ দেখি। কালো সানগ্লাসটি যেন সদা আমারও চোখে। কিয়ারোস্তামি (১৯৪০-২০১৬, ৪ জুলাই)
৭৬ বছরের জীবনে তার চলচ্চিত্র যাপন ৪০ বছরের বেশি সময়। এই ৪০ বছর সময়ে তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্যসহ তার নির্মাণও প্রায় ৪০টি চলচ্চিত্র। তার মেধা ও সৃজনশীলতার নিজস্ব স্বাক্ষর তার নির্মিত চলচ্চিত্রে আছে। যা পৃথিবীব্যাপী যেমন উদযাপিত  হয়েছে তেমনি গবেষণারও উপাত্ত হয়েছে সবসময়। কাজের সূত্রে চলচ্চিত্র নির্মাতা ছাড়াও তার আরো অনেকগুলো পরিচয় ছিল। তিনি কবি, তিনি চিত্রকর, তিনি চিত্রগ্রাহক, তিনি ইলাস্ট্রেটর, তিনি গ্রাফিক্স ডিজাইনার। শিল্পের সব শাখায় যার দখল থাকে চলচ্চিত্র নির্মাণ তো তারই কাজ।  
তবে তার অর্ন্তজগতের সাথে আমাদের খানিকটা বোঝাপড়ার সুযোগ ঘটে যায় তার কবিতা পড়ার সুযোগ হলে। ‘ওয়াকিং উইথ দ্য উইন্ড’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ আছে তার। মূল ফার্সি থেকে যার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ক্যামব্রিজ: হার্ভাড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০০১ সালে। ছোট ছোট কবিতায় তার ভাবনা ও মনোজগতের দেখা মেলে। তার কবিতা যেন তার সিনেমাটিক দৃষ্টিরই প্রতিসরণ। বিষণ্ন, ধীর, একাকী, প্রকৃতি ও বাস্তবতার রহস্যময় উপপাদ্য।

‘I have come along with the wind,
on the first day of summer
the wind will carry me along
on the last day of fall.’

কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্র নিয়ে আরেক মাস্টার ফিল্মমেকার জ্যঁ লুক গঁদার বলেছিলেন- ‘ফিল্ম বিগিনস উইথ গ্রিফিথ এন্ড অ্যান্ডস উইথ কিয়ারোস্তামি’। আর মার্টিন স্করসিস বলেছিলেন- ‘কিয়ারোস্তামি রিপ্রেজেন্টস দ্য হাইয়েস্ট লেভেল অব আর্টিস্ট্রি ইন দ্য সিনেমা’। এই কথাগুলো যখন কিয়রোস্তামির সামনে উদ্ধৃত করা হয় তখন তিনি মুচকি হেসেছিলেন। বলেছিলেন- ‘এই প্রশংসাবাক্যগুলো হয়তো আমার মৃত্যুর পর বেশি উপযুক্ত হবে’।

চলচ্চিত্র নিয়ে আব্বাস কিয়ারোস্তামিরর একটি কথা আমার নিজের খুব প্রিয়। বলেছিলেন- ‘ফিল্ম ইজ আ চেইন অব লাই হুইচ ইন্টেন্ডিং টু রিচ টু আ গ্রেটার ট্রুথ’। যার বাংলা করলে হয়তো এরকমটা দাঁড়ায়- ‘চলচ্চিত্র হচ্ছে মিথ্যার মালা গেঁথে একটি বৃহৎ সত্যের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা’। একজন মহৎ নির্মাতার এই প্রচেষ্টা হয়তো কখনও শেষ হওয়ার নয়। জীবন তাকে এক সত্য থেকে আরেক সত্যের কাছে বয়ে নিয়ে চলে। 

মায়েস্ত্রো, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। বাংলাদেশ নামের ছোট একটি দেশ থেকেও অনেকেই আপনার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করবে প্রতিদিন।  বিদায় কিয়ারোস্তামি (১৯৪০-২০১৬, ৪ জুলাই)

 *লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
/এম/

সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
অবশেষে মুক্তির বার্তা
অবশেষে মুক্তির বার্তা
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!