X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধে যা হারিয়েছে পাকিস্তানি চলচ্চিত্র!

শাহেরীন আরাফাত
১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ০০:০২আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:২৫
image

১৬ ডিসেম্বর, ৪৫ বছর আগের এই দিনে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে পাকিস্তানকে পরাজিত করে জন্ম নেয় নতুন একটি দেশ, বাংলাদেশ। এই ঘটনা পাকিস্তানে কেবল মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক পর্যায়েই ধস নিয়ে আসেনি। বরং তা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পর্যায়েও ভয়াবহ আঘাত হেনেছিল। ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প যেভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, তা ওই আঘাতেরই একটি উদাহরণ। বস্তুত, তখন থেকেই দেশটির চলচ্চিত্র জগতে এক শূন্যতা বিরাজ করছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প কী হারিয়েছে, তা নিয়ে সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসিফ নুরানি দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডন-এ এক অনবদ্য বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। আসিফ নুরানি ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইংরেজি ম্যাগাজিন ‘ইস্টার্ন ফিল্ম’-এর সম্পাদক ছিলেন। ওই বিশ্লেষণের চুম্বক অংশ বাংলা ট্রিবিউন পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো-


জহির রায়হান পরিচালিত ‘সংগম’ ছবির পোস্টার পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম নক্ষত্র জহির রায়হান। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তার ভাই সাংবাদিক ও লেখক শহীদুল্লা কায়সার নিখোঁজ হন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাকেও আটক করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পরও তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
১৯৭২ সালে জানুয়ারির শেষের দিকে জহির রায়হার ভাইয়ের খোঁজে বের হন। মিরপুর থেকে তিনিও নিখোঁজ হন।
জহির রায়হান ছিলেন অখণ্ড পাকিস্তানের অত্যন্ত শক্তিশালী চলচ্চিত্র নির্মাতা। ১৯৫৯ সালে উর্দু/বাংলা ছবি ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে। ছবিটি লিখেছিলেন পাকিস্তানের প্রখ্যাত কবি ও লেখক ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। পরিচালনায় ছিলেন এ.জে কারদার। পরবর্তীতে, জহির রায়হানের প্রযোজনা ও পরিচালনায় নির্মিত হয় পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সংগম’ (১৯৬৪), পরের বছর নির্মাণ করেন ‘বাহানা’। যা পাকিস্তানের প্রথম ‘ওয়াইড স্ক্রিন’ ছবি।
শুধু উর্দু নয়, বাংলা ছবি নির্মাণেও সমান দক্ষ ছিলেন জহির রায়হান। ১৯৬১ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘কখনো আসেনি’। এর পরের বছর ‘সোনার কাজল’ এবং ১৯৬৩ সালে নির্মাণ করেন ‘কাঁচের দেয়াল’, এই ছবিটির জন্য তাকে ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ‘আইয়ুব শাহী’র বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্যাটায়ার ‘জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)’ ছবিটির জন্য তিনি আজীবন মনে থাকবেন। ছবিটির সত্যজিৎ রায়ের প্রশংসাও পেয়েছিল।
জহির রায়হানকে হারানোটা ছিল, পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে আসা আঘাতের একটি দিক। অপরদিকে, বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়ার কারণে চলচ্চিত্র শিল্পের এক বিশাল বাজার ও উৎপাদন ক্ষেত্রও হারিয়েছে দেশটির চলচ্চিত্র শিল্প।
দুই.
ঢাকায় ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিএফডিসি) স্টুডিও স্থাপনের ফলে নতুন উদীয়মান নির্মাতারা সামনে আসেন। ১৯৬৩ সালে পূর্ব বাংলায় যেখানে মাত্র ৫টি ছবি নির্মিত হয়েছিল, পরের বছরই তা দাঁড়ায় ১৬টিতে।
১৯৭১ সালে পুরো পাকিস্তানে ৪০০টি ছবি নির্মিত হয়েছিল। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশই নির্মিত হয় তৎকালীন পূর্ব বাংলায়। ১৯৭১ সালে এখান থেকে নির্মিত হয় ১১৪টি ছবি, যার মধ্যে ৩টি উর্দু ছবি।
আসিফ নুরানি তার বিশ্লেষণী লেখায় বলেন, পাকিস্তানের চলচ্চিত্র নির্মাতারা মৌখিকভাবে বহুবার চলচ্চিত্র শিল্পে আসা এসব আঘাত সম্পর্কে কথা বলেছেন। কিন্তু তা লিখিত হয়নি।
পাকিস্তানের চলচ্চিত্র যখন এসব আঘাত কাটিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছিল, তখনই জেনারেল জিয়াউল হকের সেনাশাসনের সময় আসে আরেক আঘাত। যে ক্ষত আজ পর্যন্ত বয়ে চলেছে পাকিস্তান। ‘চান্দা’ ছবিতে শবনম ও রহমান

উর্দু ছবি নির্মাণেও পূর্ব বাংলার অবদান অনস্বীকার্য। পূর্ব বাংলায় নির্মিত উল্লেখযোগ্য উর্দু ছবির মধ্যে রয়েছে ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘বন্ধন’, ‘মিলন’, ‘ইন্ধন’, ‘সংগম’, ‘কাজল’, ‘নওয়াব সিরাজুদ্দৌলা’ এবং ‘চাকৌরি’।

১৯৬২ সালের ৩ আগস্ট এখান থেকে প্রথম উর্দু ছবি ‘চান্দা’ মুক্তি পায়। প্রখ্যাত প্রযোজক আনিস দোসানি পূর্ব বাংলার পরিচালক এহতেশাম ও মুস্তাফিজের সঙ্গে কয়েক ছবি নির্মাণ করেন। জহির রায়হানের ‘জাগো হুয়া সাভেরা (১৯৫৯)’ এবং শওকত হাশমির ‘হামসফর (১৯৬০)’ পশ্চিম পাকিস্তানি ছবি হলেও এগুলোর বড় অংশের শুটিং হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে।

তৎকালীন পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের মান সম্পর্কে বলা যেতে পারে, তার নন্দনতত্ত্ব ঢাকার বাংলা ছবির মতোই ছিল। আর এর একটা বড় উদাহরণ ‘চান্দা’ ছবিটি। শুরুতে তা দর্শকদের কাছে তেমন জনপ্রিয় না হলেও, কয়েকদিনের মধ্যেই ছবিটিতে ‘হাউসফুল’ শো দেখা যায়। ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে চলে ২৫ সপ্তাহ ধরে।  

হিন্দু সম্প্রদায়ে জন্ম নেওয়া ‘ঝরনা’র অভিষেক ঘটে এই ছবিতে, দ্বিতীয় নায়িকা হিসেবে অভিনয়ের মাধ্যমে। পরবর্তীতে, এই তরুণী ‘শবনম’ নামে সুপারস্টার আখ্যা পান। তিনি ‘চান্দা’য় পার্শ্ব চিরিত্রে অভিনয়ের জন্য নিগার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ‘ইন্ধন’ ছবির দৃশ্য

পরের বছর শবনম-রহমান অভিনীত ‘তালাশ’ মুক্তি পায়। তখন এই জুটি খ্যাতির আকাশে। এতে সংগীত দেন রবিন ঘোষ। ছবিটি ৫০ সপ্তাহ ধরে চলে প্রেক্ষাগৃহে।

১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় প্রখ্যাত উর্দু লেখক হাজরা মনসুরের লেখা গল্প অবলম্বনে নির্মিত ছবি ‘আখরি স্টেশন’। ছবিতে মানসিক রোগীর চরিত্রে অভিনয় করেন শবনম। তার অভিনয় বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়।

খান আতাউর রহমান, বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী এক মানুষটি একাধারে প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্য লেখক, কাহিনিকার, গীতিকার, সংগীত নির্দেশক এবং অভিনেতা। পাকিস্তানি ছবিতে তার অবদান অনস্বীকার্য।

যেসব ছবিতে তিনি অনন্য অবদান রেখেছেন, তার মধ্যে রয়েছে ‘নওয়াব সিরাজুদ্দৌলা (১৯৬৭)’, ‘সোয়ে নদিয়া জাগে পানি (১৯৬৮)’, যা একই সঙ্গে বাংলা ও উর্দু ভাষায় মুক্তি পেয়েছিল। ছবির অভিনেত্রী কবরী উর্দু বলতে না পারায়, উর্দু ভার্সনে গলা দিয়েছিলেন খান আতার বন্ধুর মেয়ে নাজমা নিয়াজি। তালাশ ছবির একটি দৃশ্য

তিন.

মুশতাক গাজদারের অমূল্য গ্রন্থ ‘পাকিস্তানি সিনেমা ১৯৪৭-১৯৯৭’-এ বলা হয়, ‘চান্দা’ থেকে শুরু করে জহির রায়হানের ‘জলতে সুরজ কে নিচে (১৯৭১)’ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় ৪৭টি উর্দু ছবি নির্মিত হয়। যা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে মুক্তি পায়। এখানকার নির্মাণ খরচ কম হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র নির্মাতারা এতে আকৃষ্ট হন।   

বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের আগে বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্র, উভয় পক্ষ থেকেই তারকাদের আদান-প্রদান দেখা যেত। উর্দু ছবির অভিনেত্রী শামীম আরা বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন। জুবাইদা খানম বাংলা ‘আজান (১৯৬১)’ ছবি গান গেয়েছেন। অপরদিকে, বাঙালি অভিনেত্রী নাসিমা খান ‘গীত কাঁহি সংগীত কাঁহি (১৯৬৯)’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিটি বাংলা ও উর্দু ভাষায় মুক্তি পায়।

পূর্ব বাংলা আরেকজন বাঙালি সংগীতশিল্পীর কথা না বললেই নয়, যার উর্দু গায়কি ছিল অসাধারণ। পাকিস্তানি চলচ্চিত্রে তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তিনি বেশ কয়েকটি উর্দু ছবিতে গান গেয়েছেন। তিনি ছবির জন্য উর্দু গানও লিখতেন। তবে তার লেখা গান প্রকাশিত হতো বি.এ. দীপ নামে। তার পূর্বজরা ছিলেন কলকাতার অধিবাসী। তবে বাংলাদেশ গঠনের পর তিনি ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। ২০১৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলাদেশ গঠনের পর শিল্পী, কলা-কুশলীরাও বিভক্ত হয়ে পড়েন। সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী ফেরদৌসী বেগম ঢাকাতেই থেকে যান। অপরদিকে, সংগীত নির্দেশক মুসলেহউদ্দিন পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে না গিয়ে তার স্ত্রী নাহীদ নিয়াজিকে নিয়ে পাড়ি জমান লন্ডনে।

ঢাকায় বসবাসরত ‘নওয়াব সিরাজুদ্দৌলা’র জন্য নিগার অ্যাওয়ার্ড পাওয়া চিত্রনাট্য লেখক নাকি মুস্তফা পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান। কিন্তু সেখানে তিনি তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ করতে সক্ষম হননি।

তবে প্রযোজক আনিস দোসানি ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে খুব একটা খারাপ কাজ করেননি। তিনি প্রখ্যাত পরিচালক পারভেজ মালিকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি ‘আনমোল (১৯৭৩)’, ‘পেহচান (১৯৭৫)’, ‘তালাশ (১৯৭৬)’ এবং ‘গুমনাম (১৯৮৩)’-এর মতো কিছু ভালো ছবিও নির্মাণ করেন। তবে তিনি সবসময় তার ‘হারানো সাম্রাজ্য’ খুঁজে ফিরতেন। ‘ডন’ পত্রিকার প্রচ্ছদ

এখানে আরও দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচির অভিনেতা ও কণ্ঠ শিল্পী নাদিমের অভিষেক হয় ঢাকার বাংলা ছবিতে। অপরদিকে, বাঙলি শিল্পী রুনা লায়লার অভিষেক হয় উর্দু ছবি ‘হাম দোনো (১৯৬৬)’-র মাধ্যমে। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাবার সরকারি চাকরির জন্য রুনা লায়লা পশ্চিম পাকিস্তানেই সংগীত চর্চা করেছেন। পরে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন এবং ঢাকায় বসবাস শুরু করেন।

বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) সৃজনশীল, বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী অভিনেতা, শিল্পী, কলাকুশলীরা পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে যে অবদান রেখেছেন, তার প্রভাব আজও বিদ্যমান। এই অবদানের কোনও বিশেষ স্বীকৃতি না থাকলেও সংশ্লিষ্টদের পক্ষে তা অনুভব করা সম্ভব। তবে ৪৫ বছর আগে পাকিস্তানের ভাঙনের পড়ার পর যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগত, তথা সংস্কৃতিতে, তা আজও মিটে যায়নি। সেই ক্ষতের ধারাবাহিকতা আজও বয়ে চলেছে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্প।

ছবি: ডন
/এসএ/এম/

সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
‘সরলতার প্রতিমা’ খ্যাত গায়ক খালিদ আর নেই
দেশের প্রেক্ষাগৃহে আসছে নোলানের কালজয়ী দুই ছবি
দেশের প্রেক্ষাগৃহে আসছে নোলানের কালজয়ী দুই ছবি
পরীর টলিউড অধ্যায় শুরু
পরীর টলিউড অধ্যায় শুরু
নিজের যে স্বভাব লুকিয়ে রাখেন সারা
নিজের যে স্বভাব লুকিয়ে রাখেন সারা
চাঁদরাতে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে নাটক
চাঁদরাতে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে নাটক