X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘রাষ্ট্র মানি না নিজের ভাষাকে ভুলে'

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২০:০৪আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২১:০২

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ভেতর পৃথিবীর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ঘটে গেছে। এরমধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকরণ। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ১০০ বছর আগে এই তরঙ্গের কথা বলেছিলেন। ১০০ বছর পরে তার কথাই সত্য প্রমাণিত হলো। পৃথিবীর জন্য সুখবর হলো, এতদিন পর্যন্ত মহাকাশ গবেষণা হত আলো দিয়ে এখন থেকে হবে তরঙ্গ দিয়ে। ফলে কৃষ্ণগহ্বরের অনেক অজানা রহস্য এখন উদঘাটন করা অধিকতর সহজ হয়ে যাবে।
আমাদের জন্য সুখবর হলো, লাইগোর যে গবেষক দল এই তরঙ্গ অবিষ্কার করেছেন, সেই দলের দুইজন বিজ্ঞানী (ড. দীপঙ্কর তালুকদার, ড. সেলিম শাহরিয়ার) বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে একজন অধ্যাপক সেলিম শাহরিয়ার আবার দলটির দলনেতা। খবরটা শুনেই গর্বে বুকটা ভরে গেল! আমাদের দুই বাঙালি ভাই, আমাদেরই মতো কালো চামড়া, এই দেশে কিছু সম্ভব নয় আগেভাগেই বুঝতে পারা দুই বাঙালি ভাই! ব্যাপারটা কিন্তু খানিকটা সেইরকমই দাঁড়িয়েছে। ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান’ (২০০৭) ছবিতে ফ্লুইড সিম্যুলশনের কাজ করে অস্কার বিজয়ী নাফিস বিন জাফর একজন প্রবাসী বাঙালি। ভাবার চেষ্টা করি, এই অসামান্য মেধাবী মানুষগুলো দেশের টানে বাংলাদেশেই থেকে গেলে ঘটনাটা কি হতে পারতো! লাইগোর গবেষক দলের সদস্য বিজ্ঞানী ড. দীপঙ্কর তালুকদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে স্নাতকে প্রথম বিভাগে প্রথম, এবং স্নাতকোত্তরে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় হয়ে তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ইংরেজি মাধ্যমের দুটি স্কুলে। তিনি হয়তো সেই স্কুলেই থাকতেন বা কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকতা করতেন, জড়িত হতে বাধ্য হতেন সাদা-নীল দলের রাজনিতীতে! পাশাপাশি হয়তো বিজ্ঞানমনস্ক লেখালেখি করে মৌলবাদীদের নেক নজরে এসে কোনও এক ফুটপাতে বা কর্মক্ষেত্রে নিভৃতে প্রাণ দিতেন আততায়ীর হাতে। আর আমরা পেতাম মানব বন্ধনের আরও একটা উপলক্ষ। অধ্যাপক সেলিম শাহরিয়ার হয়তো দেশের প্রথমসারির কোনও এক টেলিফোন অপারেটর কোম্পানিতে মোটা বেতনে কাজ করতেন, আর বিদেশি বসদের দ্বারা প্রায়শই বঞ্চিত হবার বঞ্চনা নিয়ে জীবন পার করে দিতেন। আর নাফিস তার স্বপ্নের প্রকল্পগুলো নিয়ে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত প্রযোজকদের পেছনে ধরনা দিতে দিতে একদিন হতাশ হয়ে লেগে পড়তেন আউট সোর্সিংয়ে কাজে!

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে মোটামুটি এইরকম বাস্তবতায় এসে আমরা দাঁড়িয়েছি। এখন পর্যন্ত আমাদের জাতীয় গৌরবের বিষয় ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে মোটামুটি উল্লেখযোগ্যহারে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এরমধ্যে কিছু আমাদের মনে দাগ কেটেছে, কিছু হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। অদ্ভুতভাবে ভাষা আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে তেমন কোনও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। আমার জানামতে এ যাবতকালে মাত্র দুটি বাংলা চলচ্চিত্রে ভাষা আন্দোলনের বিষয়বস্তু উঠে এসেছে, চলচ্চিত্র দুটির একটি হলো জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’, আরেকটি শহিদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘বাংলা’। আরও যদি কোনও ছবি থেকেও থাকে তা নিশ্চয়ই অধিক সংখ্যক চলচ্চিত্রের দাবি রাখতে সক্ষম নয়।

১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটি ভাষা আন্দোলনের বুনিয়াদের ওপর নির্মিত প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র। একটি পরিবারের একরোখা কর্তৃত্তপরায়ণ গৃহকত্রীর দ্বারা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রতিনিয়ত নিপিড়ীত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিকজান্তা আইয়ুব খানের দুঃশাসনের তুলনামুলক মেটাফরিক প্রেজেন্টেশনের ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’। এই চলচ্চিত্রের শুরুরদিকেই ২১ ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরির যে দৃশ্যায়ন দেখানো হয়েছে, সেই একটিমাত্র দৃশ্যের ভেতর বাঙালি জাতীর সংগ্রাম আর বঞ্চনার দৃশ্য এত জোরালোভাবে মূর্ত হয়েছে যে, তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। মিছিলে তৎকালীন সামরিকজান্তার নিপীড়ন অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র খুব অনাবদ্যভাবে ফুটে উঠেছে। মজুরের কাঁধে সাধ্যের অতীত খাজনার বোঝা সম্বলিত ইলাস্ট্রেশন, প্ল্যাকার্ডে লেখা সাম্রাজ্যাবাদ রুখে দাও, কৃষক-মজদুর এক হও, অমর ২১শে। এবং এই সমস্ত বক্তব্য সম্বোলিত প্ল্যাকার্ড নেপথ্যে রেখে প্রেমিক-প্রেমিকার স্বাভাবিক কথোপকথনের দৃশ্যায়ন তৎকালীন সংগ্রামী জীবনাচরনের বাস্তবাতা সুচারুরূপে তুলে ধরার পাশাপাশি একজন তুখোড় সিনেম্যাটিক প্রজ্ঞার চলচ্চিত্র নির্মাতাকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। 

এই ছবিতেই সর্বপ্রথম আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গাওয়া হয়। এই চলচ্চিত্রে গানের ব্যবহারে রয়েছে শতভাগ প্রাসঙ্গিকতা এবং মুন্সিয়ানা। ‘দুনিয়ার গরিবকে আজ জাগিয়ে দাও/শ্বেতপাথরের মহল আমার চাই না, আমাকে মাটির কুটির বানিয়ে দাও’ বা ‘কারার ঐ লৌহকপাট’-এর মতো শক্তিশালী গানের ব্যবহার রয়েছে এই চলচ্চিত্রে। এমন কোনও বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে না যার মনে রাজবন্দিদের শিকলবাঁধা পায়ের তালে তালে কারার ‘ঐ লৌহকপাট’ গানটি দাগ কাটেনি। খান আতাউর রহমানের অনাবদ্য সংগীত পরিচালনায় এই চলচ্চিত্রের আরোএকটি গুরুত্বপূর্ণ গান- ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’ নিজের ঘরে গান গাইবার অনুমতি না থাকায় বাড়ির ছাদে হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে এই গানটির প্রতীকী উপস্থাপনায় মুর্ত হয় আপামর নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। পরবর্তীতে এই পরিবারের আরও দুই ভাইয়ের বিয়ে হলে ক্রমেই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে নিপীড়ক গৃহকর্তৃীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এটিও আইয়ুব সরকারের দমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের উত্থানের একটি প্রতিকী উপস্থাপনা। পাকিস্তানি সামরিকজান্তার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে এই জাতীয় বিষয়বস্তুর চলচ্চিত্রায়ণ এক দুঃসাহসী পদক্ষেপই বটে। তথাপিও খটকা লাগে একজন বাঙালি নারীকে আইয়ুব খান সমতুল্য নিপীড়কের ভুমিকায় দেখতে। কারণ অতি নগন্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া একজন নারী মূলত পারিবারিক এবং সামাজিক উভয় দিক দিয়ে নিজেই নিপিড়ীত, তাকে নিপীড়কের ভূমিকায় না দেখিয়ে অন্য কোনও মেটাফোর তৈরি করা গেলে হয়তো সেটি আরোবেশি আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হতো। জহির রায়হান ও ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ছবির পোস্টার

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘বাংলা’ চলচ্চিত্রটি আমার দেখা হয়নি, তাই সেটি নিয়ে তেমন কোনও মন্তব্য করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার এই লেখাটির জন্য চলচ্চিত্র সমালোচনা খুব বেশি জরুরিও নয়।

আজকে আমার অনুসন্ধানের বিষয় কেন উল্লেখযোগ্য হারে ভাষা আন্দোলনভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হলো না, বা হচ্ছে না! আমরা সকলেই জানি, চলচ্চিত্র হলো মেধাভিত্তিক কর্ম। যদি আবারও ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের উল্লেখ করি এবং এই চলচ্চিত্রের টিম ওয়ার্কের প্রসঙ্গে দৃকপাত করি, তাহলে যে নামগুলো আসে- জহির রায়হান (কাহিনি,চিত্রনাট্য ও পরিচালনা), আফজাল চৌধুরী (চিত্রগ্রহণ), আমজাদ হোসেন (চিত্রনাট্য ও সংলাপ), খান আতাউর রহমান (সংগীত পরিচলনা)। এই মানুষগুলোর ইন্টেলেকচুয়াল হাইট আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা, তাদের কাছে এমন একটা কালাত্তীর্ণ ছবি আমরা আশা করতেই পারি। পরবর্তী সময়ে জহির রায়হান ২১ ফ্রেব্রুয়ারি নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন । তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার সেটি নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। আমজাদ হোসেন ও ‘শহীদ আসাদ’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটিও একই কারণে শেষ মেষ আর নির্মিত হয়নি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে আর কোন ছবি তৈরি হলো না, সেটি একটি বিস্ময়কর ঘটনা! এই অনুসন্ধানের গভীরে ঢোকার আগে খানিকটা হলেও আমাদের মূলধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের ধরন সম্পর্কে দৃকপাত করা প্রয়োজন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা আমাদের অধিকাংশ চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিবেদন এবং চলচ্চিত্রায়নের পার্থক্য করতে সক্ষম হননি। যে কারণে আমাদের চলচ্চিত্রে ঘটনা থাকে বটে, কিন্তু ফিকশনের বড় অভাব।

 কয়েকটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের সাথে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা যাক। স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত একটি অনবদ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য ইমপায়ার অব দ্য সান’। ১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হলিউডভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি স্বাভাবিকভাবেই সুবিশাল অর্থনৈতিক বরাদ্দের একটি ছবি, যা বাংলাদেশি বাস্তবতায় নির্মাণ অসম্ভব। আমরা সেই প্রত্যাশাও করি না। কিন্তু ঐ যে শুরুতেই যে ফিকশনের কথা বলেছি সেটি এই চলচ্চিত্রের প্রথম শট থেকেই বর্তমান।  প্রথম শটেই দেখি জাপানি সৈনিক অধ্যুষিত চীনের সাংহাই শহরের কোনও এক গির্জা থেকে শিশু কণ্ঠে অপেরা শোনা যাচ্ছে আর নদীর জলে ভাসছে অসংখ্য জীর্ণ কফিন। কফিনগুলো জলে ভাসতে ভাসতে একটা ফেরীর গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে। ফেরীতে অসংখ্য জীবন্ত মানুষ। গা হিম হয়ে যাওয়া একটা দৃশ্য! ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায় জাপানি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত অভিজাত ব্রিটিশ পরিবারের ক্লান্ত বিধ্বস্ত শিশু জিমি গ্রাহাম তার প্রিয় সুটকেস- যাতে সংগৃহীত আছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের নানা স্মৃতি, সেটি সে সেই একই জলে ভাসিয়ে দেয়, যা কিনা প্রথম দৃশ্যে দেখা কফিনের দৃশ্যের অর্থই বহন করে। এই দৃশ্যটি নির্মাণে অনেক অর্থ ব্যয়ের দরকার হয়নি, দরকার হয়েছে একটা সাধারণ কাহিনিতে ফিকশন যোগ করার কল্পনা ক্ষমতার। একজন প্রতিবেদক এই ঘটনটা বয়ান করতে গেলে এই ফিকশন টুকু থাকতো না, সেটি প্রতিবেদকের দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না ! এই একই চলচ্চিত্রের শুরুতে দেখি অভিজাত ব্রিটিশ পরিবারের কেতাদুরস্ত প্যাকার্ড গাড়ির লোগোর শির উন্নত (গতির দেবী) ধাতব পাখিটির শট। ছবির শেষের দিকে নানতাও ফুটবল স্টেডিয়ামে উদ্ধার হওয়া অভিজাতদের পরিত্যক্ত সম্পদের স্তুপে সেই একই প্যাকার্ড গাড়ির শটটির পুনরাবৃত্তি হয়, পার্থক্য কেবল গাড়িটির সেই আগের মতো ঝা চকচকে কেতাদুরস্ত চেহারাটি আর নেই, শির উন্নত ইস্পাতের গতির দেবী পাখিটিও মলিন! বিনা সংলাপে এর চেয়ে নাটকীয় উপস্থাপনা আর কিই বা হতে পারে!

বাংলাদেশি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র মানেই দর্শক আগাম হিসাব করে নিতে পারেন যে মুক্তিযোদ্ধারা শীতের হীম করা রাতে কচুড়িপানার জলে নাক ডুবিয়ে অপারেশনে যাবেন, কয়েকজন যুদ্ধে শহীদ হবেন, সহোযোদ্ধারা আহত মুক্তি যোদ্ধাকে কাঁধে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করবেন। নায়কের ফেলে আসা প্রেমিকা হয়তো ধর্ষিতা হবেন, নায়ক হয়তো পরবর্তী সময়ে শহীদ হবেন, অথবা যুদ্ধে অঙ্গহানীর পরে ফিরে আসবেন রাজ্যের শুন্যতা নিয়ে। দর্শক আগাম এই দৃশ্যগুলো সহসাই অনুমান করে নিতে পারেন কারণ গল্পগুলো সবসময়েই গৎবাঁধা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়। কিছুদিন আগে একটি টেলিভিশন টক শোতে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলছিলেন অধিকাংশ বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতার মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকা এবং কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ না দেখার অনভজ্ঞিতাই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রকে একটা গৎবাধা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রবণতা সৃষ্টি করেছে। আমারও একই মত। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস অবিকৃত রেখে সিনেম্যাটিক উপস্থাপনা আমরা ঠিক শিখে উঠতে পারিনি! জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমনি’ (১৯৯৪) চলচ্চিত্রে পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি সেই বিবেচনায় অনেক উপরে তুলে রাখা যায়, যথেষ্ট সিনেম্যাটিক দৃশ্য হয়ে ওঠার কারণে দর্শক আজও দম বন্ধ করে দৃশ্যটি দেখেন বলেই আমার বিশ্বাস। একই চলচ্চিত্রে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর যখন পরিচিত ইংরেজি গানের শিস বাজাতে বাজাতে একজন মুক্তিযোদ্ধার আঙুল কেটে ফেলেন সেটিও ছিল রোমহর্ষক এক দৃশ্য।

চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১জন’ চলচ্চিত্রের ‘সবকাটা জানালা খুলে দাও না’ গানটির দৃশ্যায়ন এখনও নিঃসন্দেহে মানুষের মনে দাগ কেটে আছে! খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ (১৯৭৩) চলচিত্রে যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলার বিপথগামী তরুণ সমাজকে ফিরে এসে দেশ গঠনের প্রক্রিযায় অংশগ্রহণের ইতিবাচক আহবানের উপস্থাপনাটিও ছিল অনবদ্য। এছাড়া ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘আলোর মিছিল’ চলচ্চিত্র দুটিকেও নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান চলচ্চিত্র হিসেবে এগিয়ে রাখা যায়। নারায়ন ঘোষ মিতা পরিচালিত ১৯৭৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আলোর মিছিল’ চলচ্চিত্রে ছাত্রনেতা শহীদ আশরাফ চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের একটি সংলাপ ‘দেশটা যেন স্বাধীন হয়েছে কিছু মানুষের বড়লোক হবার জন্যে’ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে এক কথাতেই বুঝিয়ে দেয়।

তথাপি, ভাষা আন্দোলনভিত্তিক চলচ্চিত্র অতি নগণ্য। যেহেতু চলচ্চিত্রকে আমরা প্রতিবেদকের চোখে দেখে অভ্যস্থ, নিকটঅতীতে সমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ একঅর্থে আমাদের জন্য সহজতর ছিল। কারণ ভূরি ভূরি অ্যাকশন, ধর্ষণ, বিরাঙ্গনাদের বঞ্চনার ইতিহাস আমরা সকলেই কম-বেশি জানি। খুব একটা কল্পনার বেগ না নিয়েও দিব্যি একটা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র বানিয়ে ফেলা যায়। অথচ উচ্চবিত্তের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা আজাদ বন্দি অবস্থায় তার মা দেখা করতে গেলে ছেলে তার কাছে ভাত খেতে চেয়ে ভাত পায়নি বলে যে বাকি জীবন তিনি আর ভাত খেলেন না, অথবা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে ছেলে রুমীকে তার সহোযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন, সেই বিষয়বস্তু নিয়ে আজও কোনও চলচ্চিত্র নির্মিত হলো না। কারণ খোলা চোখে মুক্তিযুদ্ধের যে ছবি দেখা যায়, এই কাহিনিগুলোকে ঠিক সেইভাবে ডিল করার অবকাশ নেই। এই কাহিনিগুলোর মনস্তাত্ত্বিক দিক অনেক বেশি। একটিও গোলাগুলির দৃশ্য না দেখিয়ে, একটিও ধর্ষণের দৃশ্য না দেখিয়ে এই বিষয়বস্তুর উপরে বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব! কিন্তু আমরা সেই ভাবনাটি ভাবতে অপারগ। মোদ্দাকথা হলো, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা নিয়ে সেই অর্থে কোনও চলচ্চিত্রই নির্মিত হয়নি বাংলাদেশে। বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝানোর জন্য আরো দুটি যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের উদাহরণ দিতেই হয়। ‘জ্যাকব দ্যা লায়ার’ (১৯৯৯) পিটার কাসোভিজ পরিচালিত চলচ্চিত্রটি ১৯৩৯-১৯৪৪ জার্মান নিয়ন্ত্রিত পোলিশ গেঁতো’র (জার্মান নিয়ন্ত্রিত পলিশ বসতি) নিপীড়িত ইহুদিদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে নির্মিত। এই চলচ্চিত্রে দেখা যায় ইহুদি পোলিশ দোকানি জ্যাকব কে কার্ফিউ অমান্য করার অপরাধে জার্মান ক্যাম্পে তলব করা হয়। তাকে জেরা করার একপর্যায়ে তার কানে দূর থেকে জার্মান রেডিওর খবর ভেসে আসে। ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে এই রেডিও শোনার ব্যপারটি তাকে কল্পনা প্রসূত একটি রেডিওর কথা প্রচার করতে উৎসাহিত করে। প্রথমে সে তার এক বন্ধুর কাছে এই কাল্পনিক রেডিওর গল্প করে। সে বলে যে তার কাছে একটা রেডিও লুকানো আছে, সেই রেডিওতে সে শুনেছে যে রাশিয়ান যোদ্ধারা তাদেরকে উদ্ধার করতে আসছে। নাজি বাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে তখন রেডিও বা সংবাদপত্র নিষিদ্ধ। তাই জ্যাকবের রেডিও শোনার জন্য গোপনে মানুষ জড়ো হয়। জ্যাকব আড়ালে গিয়ে একটা চোঙ্গার মধ্যে রেডিওর খবরের মতো বলতে থাকে, রাশিয়ান সৈনিকরা ট্রেনে চেপে অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। জ্যাকবের এই কাল্পনিক রেডিওর খবর শুনে মানুষ মুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী হয়, এমনকি একজন অবুঝ শিশুও সেই মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে সেই রেডিও শোনে, জ্যাকবের সরল উদ্দেশ্যও ছিল তাই। এই রেডিওর খবর নাজি বাহিনীর কানে চলে গেলে নাজি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয় গোটা পোলিশ গেঁতো। কেউ তবুও তাদের স্বপ্ন দেখানোর নায়ক জ্যাকব এর নাম বলে না। একপর্যায়ে জ্যাকব নিজেই আত্মসমর্পন করে। কিন্তু রেডিও দেখাতে না পারার অপরাধে তার উপর চলে সীমাহীন নির্যাতন। কিন্তু জ্যাকব রেডিও দেখাবে কোথা থেকে, এটি যে কল্পনার রেডিও!

বসনিয়ান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে প্রেডর‌্যাগ এ্যান্টোনিজেভিক নির্মিত ‘সেভিয়র’ (১৯৯৮) চলচ্চিত্রে দেখা যায় সার্বীয় এক নারী ভেরা আর তার সদ্যপ্রসূত সন্তানকে নিয়ে নিরাপদ জাতিসংঘ মিশনের দিকে পালাতে থাকা আমেরিকান মার্সিনারী (যেকোনও দলের জন্য না হয়ে নিজের জন্য যুদ্ধ করে) গাই নামধারী যশুয়া রোজ এর কাছে একটা পরিত্যক্ত বোটের ভেতরে নিজের শিশুকন্যাকে লুকিয়ে রেখে বাসের খোঁজে গিয়ে ক্রোয়েশিয়ান ডিফেন্স কাউন্সিলের সৈনিকদের হাতে ধরা পড়ে। তাকে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ক্রোয়েশীয় যোদ্ধারা অযথা গুলি খরচ করবে না বলে প্রথমে একেকজনকে পানির কাছে দাঁড় করিয়ে কাঠের তৈরি মুগুর দিয়ে মাথায় আঘাত করে মারতে থাকে। ভেরার মাথায় আঘাত করার মুহূর্ত ঘনিয়ে আসতে আসতে বোটে লুকানো শিশুটি কেঁদে ওঠে! কান্নার সূত্র ধরে শিশুটিকে এবং তার সঙ্গে থাকা গাইকে যাতে সৈনিকরা ধরে ফেলতে না পারে তাই ভেরা মৃত্যুর আগমুহুর্ত পর্যন্ত ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড়িয়ে করুণ সূরে ঘুমপাড়ানি গান গাইতে থাকেন! শিশুর কান্না থেমে যায়, মায়ের মাথার উপরে নেমে আসে ভারী কাঠের মুগুরের আঘাত!

এখন হয়তো ভাষা আন্দোলনভিত্তিক চলচ্চিত্র কেন নির্মিত হয় না এটা নিয়ে আলোচনা একটু সহজতর হবে। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক। এর সঙ্গে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তনি সাংস্কৃতিক আগ্রসন, ছাত্রদের পক্ষ থেকে সেটিকে অনুধাবন করা এবং একত্রিত হয়ে সেটির প্রতিবাদ করা এবং সর্বপরি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এই ঘটনা প্রবাহের মধ্যে অনেক গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ নিহিত ছিল। ব্রিটিশ পরাধীনতার যুগে ১৯১৮ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সর্বপ্রথম বাংলা ভাষাকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের জোর দাবি তোলেন। ১৯২১ সালে সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার লিখিত দাবি বৃটিশ শাসকদের কাছে পৌঁছে দেন। সেই সূত্র ধরেই দৈনিক আজাদ পত্রিকা ১৯৩৭ সালের ২৩ এপ্রিল ‘ভারতের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানোর পরে বিষয়টি ক্রমেই আপামর বাঙালির দৃষ্টিগোচর হয়। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১১ মার্চ সারা দেশ জুড়ে সফল হরতালের ফলে ১৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিসহ ৮ দফা দাবি মেনে নিয়ে একটি চুক্তি সাক্ষর করেন। কিন্তু ২১ মার্চ মোহম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্সের ভাষণে বলেন, উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ছাত্ররা ‘নো, নো’ বলে প্রতিবাদ জানান। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে অভিনব কায়দায় ভুখা মিছিল করার সময়ে গ্রেফতার হন মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শামসুল হক। পরবর্তী সময়ে ভাসানী এবং শামসুল হককে মুক্তি দেওয়া হলেও মুজিবকে বিপদজনক ব্যক্তি আখ্যা দিয়ে আটকে রাখা হয়। ১৯৫১ সালের ২৮ মার্চ ঢাকার বুড়িগঙ্গার নদীবক্ষে নৌকার ওপর জন্ম হয় প্রগতিশীল যুব প্রতিষ্ঠান পূর্বপাকিস্তান যুবলীগের। এই প্রগতিশীল সংগঠনটির অসামান্য অবদান ছিল ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করে ঢাকা মেডিকেলের প্রধান ফটকের সামনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারদের প্রাণ দেওয়ার ঘটনা তো সকলেরই জানা। ১৯৫৩ সালে প্রথম শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এই খবর পেয়ে ১৯৫৩’র ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রদেরকে সেক্রেটারিয়েটে তলব করে সাবধান করে দেওয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতা ইব্রাহিম তাহা পাকিস্তানি জেনারেল আদমের চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন-‘আমরা আন্দোলন কেন করি? জেনে খুশি হবেন আপনার পোষা কুকুরটি একদিনে যত মাংস খায়, পুরো সপ্তাহে তা আমরা পাই না’।

এই প্রসংগে পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কবির সুমনের এই দশকের একটি গানের কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেল- ‘বাংলা ভাষাকে বলছে আঞ্চলিক, হিন্দি রাষ্ট্র মতবাদ গড়ে তুলে, দরকার হলে আমিও খুব প্রাদেশিক, রাষ্ট্র মানি না নিজের ভাষাকে ভুলে, রাষ্ট্র মানি না নিজের ভাষাকে ভুলে’ বলবার জন্য চেতনার সঙ্গে অনেক গভীর ইন্টেলেকচুয়ালিটির দরকার হয়। সিনেমা নিয়ে লিখতে গিয়ে ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস উপস্থাপন করলাম একটা কারণেই যাতে পাঠক বুঝতে পারেন কি পরিমানে সিনেম্যাটিক এলিমেন্টস আছে আমাদের ভাষা আন্দোলনে ।

আমাকে ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছবি বানাতে দিলে নিশ্চিতভাবে আমার সিনেমায় বুড়িগঙ্গায় ভাসমান অবস্থায় প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন তৈরি করার ঘটনা, বা ভুখা মিছিল, রোজ গার্ডেনে ভাসানী-মুজিবের গোপন বৈঠকে ন্যাপ প্রতিষ্ঠা অথবা ইব্রাহিম তাহার কুকুরের সঙ্গে মানুষের অধিকারের তুলনা করার সংলাপটি থাকতো। আমাদের ভাষা আন্দেলোন সার্বজনীন হয়ে ওঠার আগে সম্মুখভাগে ছিল শিক্ষিত ছাত্রসমাজ। তারা চোখে আঙুল দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো মাতৃভাষা আমাদের মৌলিক অধিকার। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অতি সূক্ষ্ম পার্থক্য বোধ করি এটাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বললেন। ৪৭, ৫২, ৬৯-এর পর্যায়ক্রমিক বঞ্চনা আর নিপীড়নের শিকার বাঙালি জাতির ক্ষোভ তখন যথেষ্ট দাঁনাবেধে উঠেছে। এরইমধ্যে ২৫ মার্চের কালোরাত্রিতে পাকিস্তনি হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যাই আপামর জনসাধারণের করণীয় নির্ধারণ করে দিল। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে শহীদ রুমী, আজাদের মতো সুশিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারের মুক্তিযোদ্ধা পেতে আমাদের খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। মুষ্টিমেয় কিছু বিশ্বাসঘাতক ছাড়া ৭ কোটি বাঙালিই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতার বীজ বপন হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালেই। আর সে জন্যই মুক্তি যুদ্ধে ব্যর্থ পাকবাহিনী চিরতরে বাঙালি জাতিকে মেধাশুন্য করে দেওয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নির্বিচারে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজকে হত্যা করলো। ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমার বক্তব্যের এটিই বোধকরি সব থেকে জোরালো সমর্থনের উদাহরণ।

ফিরে আসি ভাষা আন্দোলনভিত্তিক চলচ্চিত্রের শুন্যতা প্রসঙ্গে। নানারকম যুক্তি উপস্থাপন করে আমি চেষ্টা করেছি এটা বুঝাতে যে, একধরনের ইন্টেলেকচুয়ালিটির সংকট থেকেই হয়তো চলচ্চিত্র নির্মাতারা ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে খুব একটা আগ্রহী হয়ে ওঠেননি। এবার আসা যাক সরকারি উদ্যোগ প্রসঙ্গে। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে আমাদের লড়াই চলছিল স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ক্রমবর্ধমান নিপীড়ণে কোনঠাঁসা জাতি তখন বড়জোর একটা শহীদ মিনার ভাঙলে রাতারাতি আরও একটা শহীদ মিনার গড়ার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছেন, কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সেইভাবে জড়াতে সক্ষম হননি, তাছাড়া সেই সময়ে বাঙালি জাতির আক্ষরিক অর্থে নিজস্ব কোনও সরকারই ছিল না, সুতরাং ভাষা আন্দোলনভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি পৃষ্ঠোপোষকতার প্রশ্ন বাতুলতা মাত্র ! স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে সদ্যসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ তখন সব থেকে টাটকা চলচ্চিত্র উপকরণ, তৎকালীন সরকারেরও ছিল এই বিষয়ে অকুণ্ঠ সমর্থন। সুতরাং ভাষা আন্দোলনের দূরতম স্মৃতি তখন খুব বেশি গুরুত্ব পেতে সক্ষম হয়নি। এরপর নানারকম রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অসংখ্যবার মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতয়ায় আসায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণই বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, সেখানে ভাষা আন্দোলনভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন তো সুদূর পরাহত! বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির সরকার ক্ষমতায় রয়েছেন। খুব সাহস নিয়ে বলতে গেলে ইতিবাচক অর্থে হলেও এই সরকারের সব থেকে বড় রাজনৈতিক হাতিয়ার এই মুক্তিযুদ্ধ। ভাষা আন্দোলনের গৌরবের একক দাবিদার হয়ে ওঠা এই সরকারের পক্ষে অতোটা সহজতর নয়, সেটি ঐতিহাসিকভাবে ধোপে টিকবে না। সুতরাং চলচ্চিত্রে পৃষ্ঠোপষকতার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধই অগ্রগণ্য। নির্মাতারাও পুনরায় আগ্রহী হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে। কিন্তু জীবন থেকে নেওয়া চলচ্চিত্রের টিমের যে ইন্টেলেকচুয়াল হাইটের উদাহরণ আমি দিয়েছি, সেই টিম ওয়ার্ক পাবো কোথায়! আমি আবারও হলফ করে বলতে পারি চলচ্চিত্রে যথেষ্ট নাটকীয়তা না থাকলে কেবলমাত্র চেতনার দোহাই দিয়ে দর্শককে হলে আনা যাবে না। দর্শকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করা গেলে আজীবন সরকারি অনুদানে কেবলমাত্র আর্কাইভড হওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র নির্মিত হবে! মনে রাখতে হবে সরকারি অনুদান কোনও দান নয় যে, সেটির জন্য কোনোধরনের জবাবদিহিতার প্রয়োজন হবে না। সরকারের পকেটের সমস্ত টাকা জনগনের, আমরা সেই জনগনের কাছে দায়বদ্ধ। একবিংশ শতকের ঠিক এই প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ১০০ বছরে পৃথিবী আমূল পাল্টে যাবে। ভূ-গর্ভের ২৩-২৫ হাজার ফুট নিচে থাকবে বহুতল বাবল ভবন। চাইলেই একটা বুঁদবুদের মতো এই ভবনগুলোকে একস্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে। থ্রিডি প্রিন্টার থেকে নিজের পছন্দের খাবার ডাউনলোড করে খাওয়া যাবে। এমনই এক ক্রান্তিকালে সুয়োরানি দুয়োরানির গল্পে সমৃদ্ধ বাংলাদেশে আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে সুগভীর বুদ্ধিবৃত্তিক চলচ্চিত্রায়নের সেটিই সব থেকে বড় প্রশ্ন!

লেখক: নির্মাতা
[email protected]


/এম/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

 

সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
প্রেম নাকি বিয়ে, মুখ খুললেন ইলিয়ানা
প্রেম নাকি বিয়ে, মুখ খুললেন ইলিয়ানা
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী