X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘লা লা ল্যান্ড’ যে কারণে ইতিহাসের পথে

জনি হক
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০০:০৩আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:৪১

লা লা ল্যান্ড-এর একটি দৃশ্যে এমা স্টোন ও রায়ান গসলিং অবিশ্বাস্য! অপূর্ব! চমৎকার! ‘লা লা ল্যান্ড’ নিয়ে সমালোচকরা প্রশংসা করতে গিয়ে এসব বিশেষণই ব্যবহার করছেন ঘুরেফিরে। হলিউডের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানগুলোও শাসন করেছে ড্যামিয়েন শেজেল পরিচালিত বহুল প্রশংসিত এই ছবিটি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি (১৪টি) অস্কার মনোনয়ন পাওয়ার রেকর্ডধারী ‘টাইটানিক’ (১৯৯৭) ও ‘অল অ্যাবাউট ইভ’ (১৯৫০) ছবির পাশে যুক্ত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ‘লা লা ল্যান্ড’ ।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, রোমান্টিক-কমেডি ধাঁচের ছবিগুলোর কদর দেখা যায় না অস্কারে। বলা যায় মনোনয়ন পেতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় এগুলোকে। কিন্তু সংগীতনির্ভর প্রেমের ছবি ‘লা লা ল্যান্ড’ সেই চেনা চিত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। বদলে দিয়েছে সব। এটাও জানিয়ে দিয়েছে যে, সংগীতনির্ভর ছবির বেলায় ভিন্ন সুরে গান করতে জানে হলিউড।
এই ছবি অস্কারে রেকর্ডসংখ্যক মনোনয়ন পাওয়ার জন্য যোগ্য বলেই মনে করেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র সমালোচকরা। আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল এমন সব বিভাগেই মনোনীত হয়েছে এটি। এর মধ্যে সেরা মৌলিক গান বিভাগ থেকেই এসেছে দুটি মনোনয়ন। সেরা চলচ্চিত্র, পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, চিত্রনাট্য বিভাগেও মনোনীত হয়েছে এটি।
অস্কারে রোমান্টিক-কমেডি ধাঁচের ছবির মধ্যে সবশেষ ১৯৭৮ সালে ‘অ্যানি হল’ সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতেছিল। এরপর থেকে পুরস্কার তো দূরে থাক, এ ঘরানার ছবি মনোনয়নই পেয়েছে খুব কম। ১৯৯৫ সালে ‘ফোর ওয়েডিংস অ্যান্ড অ্যা ফিউনেরাল’ সেরা চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল।
এমা স্টোন ও রায়ান গসলিং দুই দশক ধরে রোমান্টিক-কমেডি ঘরানাকে উপেক্ষা করা হয়েছে অস্কারে। এদিক দিয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন এই আয়োজনের দুর্নাম আছে। বিশেষ করে কোনও কমেডি ছবিই সাধারণত পাত্তা পায় না অস্কারে। এ কারণে ২০০৮ সালের অস্কার অনুষ্ঠানে অভিনেতা জ্যাক ব্ল্যাক রসিকতার সুরেই বলেছিলেন, ‘একজন কমেডিয়ানের জন্য অস্কার জেতার একমাত্র পথ হলো ড্রামায় চলে যাওয়া!’ তাই রোমান্টিক-কমেডি ঘরানা মানেই বাদ- এটাই হয়ে আছে অ্যাকাডেমির কুসংস্কার। সেটা বদলে দিলো রায়ান গসলিং ও এমা স্টোন জুটির ‘লা লা ল্যান্ড’।
মিউজিক্যাল ঘরানার ছবিগুলোও অস্কারে উপেক্ষিত থাকে। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের ৮৯ বছরের ইতিহাসে মাত্র ১০টি সংগীতনির্ভর ছবি সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার জিতেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘দ্য সাউন্ড অব মিউজিক’, ‘শিকাগো’, ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’ প্রভৃতি। ‘দ্য উইজার্ড অব ওজ’ (১৯৩৯) থেকে ‘সিংগিন ইন দ্য রেইন’ (১৯৫২), বহু বছর ধরে অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস উপেক্ষা করছে সংগীতনির্ভর ছবিকে। কিন্তু হৃদয়গ্রাহী শিল্পমানের সুবাদে অস্কার ভোটারদের মন জয় করেছে ‘লা লা ল্যান্ড’। সেকেলে ধ্যান-ধারণার চিত্র ফিরিয়ে আনা একটি ছবির এমন সাফল্য পাওয়াটা অদ্ভুত হিসেবেও দেখছেন অনেক সমালোচক।
সবশেষ ২০০২ সালে অস্কারে মিউজিক্যাল ঘরানার ছবির মধ্যে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জয় করা ‘শিকাগো’র সহ-প্রযোজক ক্রেগ জ্যাডান কয়েকদিন আগে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, “নতুন প্রেসিডেন্টের কারণে আমেরিকা এখন দুঃখ ভারাক্রান্ত। এই অবস্থা ভুলে থাকার মতো একমাত্র ছবি ‘লা লা ল্যান্ড’। এর সুবাদে বছরটা আবার মিউজিক্যাল হয়ে উঠলো। আমার তো মনে হয়, প্রত্যেকেই এখন মিউজিক্যাল ছবি নির্মাণে মনোযোগী হচ্ছেন।”

‘লা লা ল্যান্ড’-এর সাফল্যের সুবাদে হলিউডের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপলব্ধি বদলেছে। তারা এখন টেলিভিশনের সংগীতনির্ভর সিরিজ অবলম্বনে ছবি তৈরির পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, এ ধরনের ছবির ক্ষেত্রে বেশি বাজেট, প্রথম সারির তারকা ও দীর্ঘ মহড়া করতে হয় গায়ক, যন্ত্রশিল্পী ও নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে। তবে আশার কথা হলো, ‘লা লা ল্যান্ড’-এর বাজেট ৩ কোটি ডলার হলেও ইতোমধ্যে এটি আয় করেছে ৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
গত মাসে ‘অস্কারের পূর্বাভাস’ হিসেবে খ্যাত গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডসের ইতিহাসে প্রথম ছবি হিসেবে সাতটি বিভাগে পুরস্কৃত হয়ে রেকর্ড গড়ে ‘লা লা ল্যান্ড’। এর গল্পে একই স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ানো দুই তরুণ-তরুণীরকে ঘিরে সাজানো ছবিটির প্রাণবন্ত প্রথম ঘণ্টার কাহিনিই পুরস্কারের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। দেখা হওয়ার পর তরুণ-তরুণীর একে অপরের প্রতি আকর্ষণ, অতঃপর প্রেমের বুনন- এমন চেনা গল্প নেই এখানে।
পরিচালক ড্যামিয়েন শেজেল তার ছবির মূল দুই চরিত্র মিয়া ও সেবাস্টিয়ানের পরিচয় ঘটিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে ট্রাফিক জ্যামের একঘেয়েমিতে থাকার সময়। এর কিছু সময় পর এক রেস্তোরাঁয় জ্যাজ পিয়ানোবাদক সেবাস্টিয়ানের পরিবেশনা দেখে মুগ্ধ হয় মিয়া। কিন্তু তখনই চাকরিচ্যুত হয়ে বিষণ্ন মন নিয়ে রাস্তায় নেমে হাঁটতে থাকে সেবাস্টিয়ান। এ পরিস্থিতিতে একুশ শতকের রোমান্টিক-কমেডি ধাঁচের ছবিগুলোতে সাধারণত প্রধান নায়ক-নায়িকা মদ্যপ হয়ে শারীরিক সম্পর্কে ডুবে যেতো এবং নিজ নিজ বন্ধুমহলে গিয়ে বিব্রতকর ভুল করে ফেলায় মনের সব দুঃখের কথা বলে বিলাপ করতো।
লা লা ল্যান্ড-এর একটি দৃশ্যে এমা স্টোন ও রায়ান গসলিং কিন্তু ড্যামিয়েন শেজেল ছবিটির প্রথম ভাগে মিয়া ও সেবাস্টিয়ানের স্ব স্ব ক্যারিয়ার ও আবেগ-অনুভূতিগুলো প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মূলত এজন্যই দর্শকদের মন ছুঁয়েছে। অনেকক্ষণ পর মিয়া ও সেবাস্টিয়ান প্রথমবার আড্ডায় মিলিত হওয়ার পর দর্শকরা ধরেই নিয়েছিল, এবার নির্ঘাত প্রেমে পড়বে তারা! কিন্তু তা হয়নি। আরেকটি দৃশ্য আছে এমন- এক পুল পার্টিতে সেবাস্টিয়ান আশির দশকের জনপ্রিয় একটি গান পরিবেশনের সময় তাকে উপহাস করে মিয়া। পরে সেবাস্টিয়ানের তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনায় বাজানো জ্যাজ সংগীতের তালে তার নাচ দেখে বোঝা গেছে, ছেলেটিকে সৃজনশীল হওয়ার উদ্দীপনা যোগাতেই আগে ব্যাঙ্গাত্মক আচরণ করেছে মেয়েটি।
‘লা লা ল্যান্ড’-এ হলিউডে পায়ের তলায় শক্ত মাটি খুঁজে বেড়ানো উঠতি অভিনেত্রী মিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন এমা স্টোন। অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চেষ্টার কোনও কমতি নেই তার। একের পর এক অডিশন দিয়ে যাচ্ছে সে। এর ফাঁকে হলিউডে স্টুডিও এলাকায় অবস্থিত একটি কফি শপে কাজ করে। অন্যদিকে খেয়ালি জ্যাজ সংগীতশিল্পী সেবাস্টিয়ানের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রায়ান গসলিং। পেশার প্রতি সে পুরো অন্তঃপ্রাণ। তবে গোঁয়ার্তুমির কারণে পেশায় উন্নতি করতে পারেনি। তার স্বপ্ন হলো একদিন নিজের একটি জ্যাজ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা।
সেবাস্টিয়ানের সুবাদে মিয়া ক্রমে জ্যাজ সংগীতকে ভালোবাসতে শুরু করে। একদিন আরেকটি অডিশনে ব্যর্থ হওয়ার পর নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে মিয়া। তবে সেবাস্টিয়ান জানে, মিয়া একদিন সাফল্য পাবেই। সে মিয়াকে আরেকবার চেষ্টা করার জন্য রাজি করিয়ে ফেলে। কিন্তু মিয়া দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় যখন সেবাস্টিয়ান একটি জনপ্রিয় ব্যান্ডে কিবোর্ড বাদকের কাজ পায়! কারণ তার ধারণা, ছেলেটি হয়তো এবার তাকে ছেড়ে চলে যাবে!
আদতে সেকেলে সম্পর্কই এ ছবির আসল জাদু। এজন্যই এটি দর্শকদের কাছে এতো চমকপ্রদ মনে হয়েছে। এমনকি পুরস্কার মৌসুমেও ধারাবাহিক সাফল্য পেয়েছে ‘লা লা ল্যান্ড’। ছবিটির জন্য তিন মাস পিয়ানো বাজানো শিখেছেন তিনি। নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন দক্ষ। পর্দায় চিত্রায়িত পিয়ানোর সব দৃশ্যে তিনি নিজেই বাজিয়েছেন। রায়ান ও এমার বিশ্বাসযোগ্য আর দর্শকের পছন্দসই রসায়নই ‘লা লা ল্যান্ড’-এর প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হওয়ার অন্যতম দিক। এই রসায়নের টোটকা ছিল তাদের বিপরীতমুখী অভিনয়শৈলী। তাদের একজন উদাসীন, অন্যজন আবেগপ্রবণ।

শুধু ডাগর চোখজোড়াই নয়; মিয়া রাগলে কিংবা আনন্দ পেলে, সব অনুভূতিই ফুটে ওঠে তার মুখাবয়বে। অন্যদিকে গসলিং বরাবরই মেকি হাসি কিংবা ভ্রু উঁচু করে থাকেন পর্দায়। কিন্তু ‘লা লা ল্যান্ড’-এ দর্শকরা চেয়েছে, মিয়ার মতো মুক্তমনা আর উদার হোক সেবাস্টিয়ান। এর আগে ‘গ্যাংস্টার স্কোয়াড’ ও ‘ক্রেজি, স্টুপিড, লাভ’ ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন তারা। তবে ‘লা লা ল্যান্ড’-এ তাদের জাদুজুটি দর্শকদের চিরদিন মনে থাকবে বলে মনে করেন বোদ্ধারা।
শুধু অভিনয়শৈলীই নয়, ক্যামেরার সাবলীল কাজ, উজ্জ্বল পোশাক ও শিল্প নির্দেশনা, জাস্টিন হারউইৎজের হৃদয়ছোঁয়া গান; সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে ‘লা  লা ল্যান্ড’ জাদু। হাতে হাত রেখে চমৎকার রসায়ন সাজানো দু’জন মানুষকে ঘিরে অত্যন্ত সুন্দরভাবে কমেডি বানাতে পেরেছেন পরিচালক ড্যামিয়েন শেজেল। একাধিক পুরস্কারজয়ী ‘হুইপ্ল্যাশ’ (২০১৪) ছবির সুবাদে ৩২ বছর বয়সী এই নির্মাতার নাম ছড়িয়েছে। তার পরিচালিত আরেকটি ছবি হলো ‘গাই অ্যান্ড ম্যাডেলিন অন পার্ক বেঞ্চ’ (২০০৯)। ‘লা লা ল্যান্ড’ তৈরির জন্য তিনি সময় নিয়েছেন ছয় বছর। এ ছবিতে পঞ্চাশের দশকের সুরেলা অনুভূতিকে সমকালীন প্রেমের গল্পের সঙ্গে একই মোহনায় মিলিয়েছেন তিনি। তার ভাষ্য, ‘এ ছবিকে আমার আবেগপ্রবণ অভিজ্ঞতা হিসেবেই দেখি। এই সময়ে তরুণ-তরুণীদের কাছে প্রেম কী এবং একজন শিল্পী হওয়া ও স্বপ্নের পেছনে দৌড়ানোর অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে এ ছবিতে।’

পুরস্কার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি অস্কার অনুষ্ঠানে ১৪টি মনোনয়নের মধ্যে ১১টিই জিতে যাবে ‘লা লা ল্যান্ড’! এমন হলে ‘বেন-হার’, ‘টাইটানিক’, ‘লর্ড অব দ্য রিংস: দ্য রিটার্ন অব দ্য কিং’ ছবি তিনটির পাশে যোগ হবে এর নাম। এ তিনটি ছবির ঝুলিতে আছে ১১টি করে অস্কারজয়ের রেকর্ড। দেখা যাক, ড্যামিয়েন শেজেলের প্রেমপত্র মনোনয়নের মতো জয়ের দিক দিয়েও অস্কারে রেকর্ড গড়তে পারে কিনা।
লা লা ল্যান্ড-এর একটি দৃশ্যে রায়ান গসলিং /জেএইচ/এমএম/

সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
১৬ বছর পর জেনস সুমনের ফেরা (ভিডিও)
১৬ বছর পর জেনস সুমনের ফেরা (ভিডিও)
মা হারালেন বেবী নাজনীন
মা হারালেন বেবী নাজনীন
ওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
সিনেমা সমালোচনাওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার