X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০
জন্মদিনে স্মরণ

নিরাসক্ত নিমগ্ন শিল্পী লাকী আখান্দ

শান্তনু বিশ্বাস
০৮ জুন ২০১৭, ১৪:২৪আপডেট : ০৮ জুন ২০১৭, ১৫:১১


লাকী আখান্দ বাংলা গানের ভিত্তি ভূমিটা খুব শক্ত। বয়স চার শতক। বিবর্তনের নানামুখী দোলায় সে আজকের সময় পর্যন্ত এসে থেমেছে। নির্মাণ ও সৃষ্টি করেছে ধ্বনিময়তার এক বর্ণিল বিচিত্র পরম্পরা। বিশ্বসংগীতকে সঙ্গে নিয়ে লোকসংগীত, নগরসংগীত ও রাগসংগীতের রসায়নে তৈরি হয়েছে গান, যে গানকে আমরা নানা অভিধায়, নানা নামে অভিহিত করি।

গানের প্রদর্শনশালা আছে, আর্কাইভ আছে কিন্তু স্মৃতির চাইতে বড় ধারক বোধহয় আর কিছু নেই। স্মৃতির ভেতর বেঁচে থাকে গান, আর থাকে বলে আমরা তাকে স্মৃতিবাহিত বলে থাকি। এমন বহু লোকগান বা পল্লী বা বাউল গান ছিল যা মুখে মুখে একজন থেকে আরেকজন তুলে নিয়ে গেয়েছেন এবং তা বহুযুগ ধরে প্রবাহিত হয়েছে। ওর‌্যাল ট্র্যাডিশনের এই ধারা বহমান শতকের পর শতকে। আর এটাই বুঝিয়ে দেয় গানের সঙ্গে শ্রুতির, শ্রুতির সঙ্গে স্মৃতির আছে এক নিগূঢ় সম্পর্ক।

শান্তনু বিশ্বাস লাকী আখান্দের কথা বলতে গেলে কবীর সুমনের একটা কথা মনে পড়ে যায়। তিনি তার বাবার কথা, যে বাবা রীতিমতো সংগীত গুণী ছিলেন, আকাশবাণীতে গাইতেন, গান শেখাতেন, তার কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘তোকে ছেলেবেলা থেকে যে এত গান শেখার ব্যবস্থা করেছিলাম সেটা তুই সংগীতকে পেশা করবি সে জন্য নয়, বরং তুই একজন ভাল শ্রোতা হয়ে উঠবি বলে।’ শ্রোতার উপলব্ধি ও বোধের ভেতর, তার স্মৃতির অলিন্দে গানও বাঁচে, বাঁচে শিল্পীও। কী সেই রসায়ন যা এমন করতে পারে? খুবই কঠিন তা বলা। তবে বাউল, লোকসংগীত যে এতদিন গ্রাহ্য হয়ে আছে, আছে রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান এবং আরও অনেক বাংলা গান তার থেকে একটা সূত্র আমরা হয়তো খুঁজে পেতে পারি। সেই বিশ্লেষণ এই লেখার বিষয় নয়।

লাকী আখান্দ শোবিজের বড় কুফল জনপ্রিয়তা। সে প্রিন্ট হোক, অনলাইন হোক বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কাজ হোক, সে একটাই কাজ করে। কাউকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তুলে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলা। সবাই না হোক, বেশিরভাগ শিল্পীদের তারকা হওয়ার, লোকপ্রিয় হওয়ার প্রগাঢ় সুপ্ত ইচ্ছে থাকে। তার সঙ্গে শিল্প নির্মাণ বা সৃষ্টির কোনও সর্ম্পক নেই। আর কিছু কিছু সৃষ্টিমুখী মানুষ চলে অন্যপথে। তার শিল্পের প্রতি ভেতর থেকে উৎসারিত হয় এক প্রচণ্ড তাগিদ, থাকে গভীর দায়বোধ, গহীন ও প্রবল ভালবাসা এবং যথাসর্বস্ব দিয়ে তাকে প্রকাশ করার নিবিড় আকাঙ্ক্ষা। এই সমস্ত কিছুর মিশ্রণে সৃষ্টি হয় এমন কিছু যা একাধারে লোকপ্রিয়ও হয় আবার কালাতিক্রম্যও। যেমন ধরুন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’- এই গানটি বাঙালি জাতির আরাধ্য গান হয়ে উঠেছে। আপেল মাহমুদ আজীবন বেঁচে থাকবেন ওই ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানটির জন্য বা আবু জাফরের লেখা ও সুরে ফরিদা পারভীনের গাওয়া ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়, উল্লেখ করা যায় অনেক গীতিকার ও সুরস্রষ্টা বা শিল্পী- যারা বাংলা গানে অক্ষয় হয়ে থাকবেন। মিডিয়া যতই ডুগডুগি বাজাক, যতই অপরিহার্য ভেবে চেপে বসুক আমাদের মাঝে, সার্থক সৃষ্টি আগ্নেয়গিরির মতো জেগে উঠে ছড়িয়ে দেবে প্রাণছোঁয়া উত্তাপ সবার মাঝে। এখন আধুনিক গান বলে যে বাংলা গান হচ্ছে শুনে মনে হয় সে যেন মোকাম হারিয়ে ফেলেছে। পিছলে খুঁড়িয়ে ভঙ্গুর চলনে একেবারেই দিশেহারা। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে কথাটা বললাম।

লাকী আখান্দ (৭ জুন, ১৯৫৬ - ২১ এপ্রিল, ২০১৭) লাকী আখান্দের বিশেষত্ব ওইখানে, যেখানে তিনি সার্বজনীন শ্রুতিকে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। বুদ্ধির সঙ্গে মেধা, মেধার সঙ্গে গভীর সংগীতবোধ। আর তাই তার সৃষ্ট গানকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়। বিশ্বসংগীতকে বাংলা চিরায়ত গানের মেলোডিক কাঠামোর সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়েছেন যে তাকে বাংলা গানই মনে হয়। অকারণ মাইনর নোটের স্বেচ্ছাচারিতায় তা অচেনা হয়ে ওঠে না। উচ্চকিত আর অনুচ্চের পরিমিতি বোধ তার সুরের  শরীরে লাবণ্য দিয়েছে, দিয়েছে প্রাণময় সুষমা। তাই সেই শ্রুতি আমাদের স্মৃতির গভীরে সঞ্চারিত হয়, বেজে চলে গুন গুন করে। সময়ের দাবি বলে একটা কথা আছে, তার মানে এই নয় যে, সে দাবি মানতে গিয়ে ভিনদেশি আধুনিকতাকে অন্ধের মতো, কার্যকারণহীন অযৌক্তিকভাবে অনুকরণ করতে হবে। লাকী আখান্দের সুরারোপিত গানে সময়ের দায় মেটাবার, আধুনিক হয়ে ওঠার প্রচুর উপকরণ  রয়েছে যা খুব সহজ নয় কিংবা লাকী আখান্দের মতো সংগীতমেধা ও মননতীব্র শিল্পীদের জন্য হয়তো সহজ। সংগীতের প্রতি গভীর দায়বোধ ও ভালবাসা তার সুরে, তার গানে বিপুল বৈচিত্র এনেছে। তার সংগীত মানসের একটা আভিজাত্য ছিল। বাজারি হতে দেননি কখনও। তিনি তার সৃষ্টিকে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন মূলধারার বাংলা গানের সঙ্গে সময়ের দাবিকে মান্য করে। তা না হলে একবার ভাবুন দুরারোগ্য ব্যাধি যখন ক্ষয় করছে তাকে একটু একটু করে যখন নিঃশেষ হচ্ছেন অল্প অল্প করে তখনও সংগীতের হাত তিনি ছাড়েননি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পেলিয়েটিভ কেয়ার ইউনিট, যে ইউনিটে দুরারোগ্য রোগীদেরই কেবল চিকিৎসা হয়, যেখানে লাকী আখান্দ তার শেষ সময়টুকু কাটিয়েছেন, সেই পেলিয়েটিভ কেয়ার ইউনিট নিয়ে নাজমুল হুদা একটা গান লিখলেন, ভীষণ অসুস্থ কিন্তু সুরের প্রতি, গানের প্রতি একনিষ্ঠ এই শিল্পী সুর বসালেন তাতে। বন্ধু টিংকু বললেন, গানটি আমাকে দিয়ে গাওয়াতে, লাকী ভাইয়েরও চাওয়া সেই ২০০৩ থেকে, একটি গান আমাকে দিয়ে গাওয়াবেন। জীবনের সন্ধিক্ষণে এসে সেই ইচ্ছে পূরণ হলো, আমার তো বটেই, তারও। গানটা তিনি শুনেছিলেন। শুনেছি গানটা শুনে তিনি খুশি হয়েছিলেন। এখন তা ধারণ করার অপেক্ষা। হলে শোনার সুযোগ হবে সবার। বাংলা গানের শ্রোতা বলতে এক দীর্ঘ পরম্পরা।
কত সমৃদ্ধ তার শ্রুতি, কত এগিয়ে তিনি থাকেন। গানের বিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে, রুচির শৈথিল্য বর্জন করেছেন সযত্নে। নিজেকে সমকালীন করেছেন সব সময়। সেই শ্রোতাকে সঙ্গে নিয়ে গানের অগ্রযাত্রা। সেই শ্রোতার কাছে পৌঁছবার তার ভেতর সঞ্চারিত হওয়ার নিরলস শ্রম একেবারে কৈশোর থেকে ৬১ বছর পর্যন্ত নিমগ্ন হয়ে করেছেন লাকী আখান্দ। তিনি নেই, কিন্তু তার প্রাণটি বাজছে তার গানে, সর্বত্র, সবার প্রাণে প্রাণে। এভাবে সময়কে অতিক্রম করে বেঁচে থাকেন লাকী আখান্দের মত দু’একজন কীর্তিমান সংগীতশিল্পী। মিউজিয়ামে নয়, আর্কাইভে নয়, মুগ্ধ শ্রোতার ভালবাসায় সিক্ত গভীর কোনও প্রদেশে, স্মৃতির অতলে।

লেখক: সংগীতশিল্পী
*** ৭ জুন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লাকী আখান্দের জন্মদিন। সদ্য প্রয়াত এ শিল্পীর জন্মদিনকে ঘিরে এ লেখাটি প্রকাশিত হলো

/এমএম/

সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং
পুষ্পা: আসবে তৃতীয় কিস্তি!
পুষ্পা: আসবে তৃতীয় কিস্তি!