গীতিকার ও সুরকারের পর কণ্ঠশিল্পীসহ অন্যরা একটি গানের মালিক। কিন্তু অনেক শিল্পীই গীতিকার বা সুরকারের অনুমতি ছাড়াই গান আপলোড করছেন। দেশে নেই গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীর কমন প্ল্যাটফর্ম। এদিকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টির পরিধি বেড়ে গেছে। এই বদলে যাওয়ার পরিস্থিতিতে মেধাস্বত্বের চুক্তিগুলোরও হালনাগাদ হওয়া প্রয়োজন।
বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) বিকালে অনলাইন বা ডিজিটাল মাধ্যমে গানের প্রকাশনা ও স্বত্ব নিয়ে অনুষ্ঠিত ‘গান তুমি কার?’ শীর্ষক বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ বৈঠকিতে এসব কথা বলেন বক্তারা। মুন্নী সাহার সঞ্চালনায় বৈঠকিতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার ওমর সাদাত, সংগীতশিল্পী ফোয়াদ নাসের বাবু, কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর, গীতিকবি জুলফিকার রাসেল, ডয়েচে ভেলের সাংবাদিক ও ইউটিউবার হারুন উর রশীদ ও সিডি চয়েসের কর্ণধার জহিরুল ইসলাম সোহেল।
বৈঠকিতে গানের মালিকানা, অধিকার ও সচেতনতা নিয়ে কথা বলেন বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক ও গীতিকবি জুলফিকার রাসেল। তিনি বলেন, ‘এখন ইউটিউবে গান আপলোড হচ্ছে। কিন্তু গানের মালিকরা সবাই কি সে বিষয়ে অবগত? কোম্পানির কাছে এককালীন টাকা নেওয়ার পরও কোনও কোনও শিল্পী গান আপলোড করছেন। একটি গান থেকে এক টাকা আসলেও সেটা গানের প্রতিটি মালিকের (গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী) পাওয়ার কথা। না পেলেও সে বিষয়টি অবগত করা উচিত। তা হচ্ছে কই? অনেক শিল্পী অনুমতি ছাড়াই গান আপলোড করছেন। এগুলো নিন্দনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক।’
সব শিল্পী একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত নয়— এমন মন্তব্য করেন সিডি চয়েসের কর্ণধার জহিরুল ইসলাম সোহেল। তার ভাষ্য, ‘আলোচনা হওয়া উচিত সব শিল্পীর গান নিয়েই। কিন্তু যখন একটা গান হিট হয়, তখনই কথা হয়। এটা দুঃখজনক। রেভিনিউ নিয়ে এ লড়াই আমরা নিজেদের ছোট করছি। এটা আমার ব্যক্তিগত মন্তব্য। আর একটা কথা— গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী সবার একটি প্ল্যাটফর্ম দরকার।’
তার কথায় সম্মতি জানিয়ে ব্যারিস্টার ওমর সাদাত বলেন, ‘আপনারা যদি একটি কমন প্ল্যাটফর্মে আসেন, সিদ্ধান্ত নেন, কে কীভাবে ভাগ পাবেন— তাতে সবার লাভ। নইলে আপনারা মারামারি করবেন, অন্যরা লাভবান হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন বিশ্বের বিভিন্ন অবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টির পরিধি অনেক বেড়ে গেছে।’
এই আইনজীবীর বক্তব্যকে সমর্থন করেন ডয়েচে ভেলের সাংবাদিক ও ইউটিউবার হারুন উর রশীদ। তিনি বলেন, ‘যখন আমি কন্ট্রাক্ট সাইন করবো, তখনকার পরিস্থিতি বুঝেই করবো। একসময় টিভি, রেডিও, ক্যাসেট, সিডি ছিল; এখন এসেছে ইউটিউব বা অন্য মাধ্যম। ফলে পরিস্থিতি বুঝে কন্ট্রাক্ট সাইন করা উচিত। কে ইউটিবিউবে আপলোড করবে, সেটার জন্যও আইন থাকবে। এটা থাকা উচিত।’
এদিকে, এবারের বৈঠকটির সূত্রপাত গত ১৮ অক্টোবর বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত ‘‘গীতিকার-সুরকার-প্রযোজকদের উপেক্ষা করেন কণ্ঠশিল্পীরাই!’ শীর্ষক প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ ধরে। বিষয়টি উপস্থাপন করেন সঞ্চালক মুন্নী সাহা। প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসুবকে প্রতিক্রিয়া জানান কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর। তিনি বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে সরাসারি বৈঠকি করতে আগ্রহী বলে জানান ওই সময়।
তার সেই মন্তব্যকে সম্মান জানিয়েই অনুষ্ঠিত হলো এবারের বৈঠকি ‘গান তুমি কার?’
প্রতিবেদনটি প্রসঙ্গে বৈঠকিতে সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর তার আপত্তি সম্পর্কে বলেন, ‘যে গানগুলোর কথা বলা হয়েছে, তা আমার চ্যানেলে নেই। যাদের রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে, তাদের মন্তব্যের ভিত্তি নেই। সবমিলিয়েই প্রতিবেদনের এ মন্তব্যগুলো নেওয়া মানে আমাকে ইঙ্গিত দেওয়া। একটা কথা, বাংলাদেশে কাইনেটিক মিউজিক দেশের ইউটিউব দেখভাল করে। তারা তো কখনও ব্লক করেনি আমাকে। মানে আমার চ্যানেল ঠিক আছে। অবৈধ কিছু নেই। এখানে আমাকে হেয় করার জন্যই ওই রিপোর্ট করা।’
আসিফের এমন বক্তব্যের জবাবে বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক ও গীতিকবি জুলফিকার রাসেল বলেন, ‘গানের গীতিকার প্রথম মালিক, দ্বিতীয় মালিক সুরকার। তারপর শিল্পীসহ অন্যরা। কিন্তু শিল্পীরা যখন সেই গান ইউটিউব কিংবা বিভিন্ন মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠানে গানটি প্রচারের জন্য দেন, তখন কি গীতিকার সুরকারের অনুমতি নেন? আমাদের এই প্রতিবেদনের মূল বিষয় ছিল এটাই। এখানে কাউকে উদ্দেশ করে কিছু বলা হয়নি।’
প্রতিবেদনটি নিয়ে নিয়ে জুলফিকার রাসেল আরও বলেন, ‘এই রিপোর্টে গান সংশ্লিষ্ট সবার বক্তব্য থাকলেও আসিফ সাহেব কেন প্রতিবাদ জানালেন, আমার জানা নেই। উনি বলেছেন— আসুন, মুখোমুখি কথা বলি। আমিও তার আগ্রহে সায় দিলাম।’
এদিকে, ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে ডয়েচে ভেলের সাংবাদিক হারুন উর রশীদ বলেন, ‘এই প্রতিবেদনটি আমি খুব মনযোগ দিয়ে পড়েছি। আমার মনে হয়েছে এটি সময়োপযোগী একটি প্রতিবেদন। তবে এ বিষয়ে প্রতিবেদনে একজন কপিরাইট আইনজীবীর বক্তব্যও দরকার ছিল বলে আমি মনে করি। তবে এই প্রতিবেদনের সঙ্গে আসিফ ভাইয়ের প্রতিক্রিয়ার কোনও যোগসূত্র আমি পাইনি।’
তবে প্রতিপক্ষ না হয়ে সবাইকে এক ছাতার নিচে আসার আহ্বান জানান দেশের অন্যতম সংগীত পরিচালক ‘ফিডব্যাক’ ব্যান্ডের প্রধান ফোয়াদ নাসের বাবু। বললেন, ‘আমরা ১০-১২ বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছি সবাইকে একই ছাতার নিচে আনতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। যে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছে, সেই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই এক হতে পারছি না আমরা।’
বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে শুরু হওয়া বৈঠকি সরাসরি সম্প্রচার করা হয় এটিএন নিউজে। একই সময়ে বাংলা ট্রিবিউনের ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইট থেকেও এটি লাইভ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-
‘এগুলো নিন্দনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক’
‘আমাকে হেয় করার জন্যই রিপোর্টটি করা’
‘যে লাভবান হচ্ছে সেই আলাদা হয়ে যাচ্ছে’
‘ডিজিটাল প্রকাশনার জন্য নতুন আইন চাই’
‘রেভিনিউ নিয়ে এ লড়াইয়ে আমরা নিজেদের ছোট করছি’