শৈশব থেকে প্রায় শ’দুয়েক সিনেমা-নাটক-বিজ্ঞাপনে কাজ করে হঠাৎ করেই হলেন এক দশকের আড়াল! কেন? অভিমান, সংসার নাকি বাবার শূন্যতায় নীল। এসব সূত্র ধরে এই সময়ে বসে ঐন্দ্রিলা আহমেদের অতীত এবং সম্ভাব্য আগামী নিয়ে কিছু কথা হলো বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে-
বাংলা ট্রিবিউন: ফিরে এসে ভালোই চমকে দিলেন। আপনার ফেরা নিয়ে উৎসাহের কমতি নেই মিডিয়ারও।
ঐন্দ্রিলা: আমার প্রতি মিডিয়ার ভালোবাসা বরাবরই ছিল। তবে সেটা সম্ভবত আব্বুর (বুলবুল আহমেদ) কারণেই। এ ক্ষেত্রে আমার কৃতিত্ব সামান্যই। আসলে আব্বুকে এই মিডিয়া এত বেশি ভালোবাসতেন, সম্মান করতেন- তারই ছায়া এখনও পাচ্ছি আমি। এবার ফেরার পর এত এত মানুষের উৎসাহ আর অফার পেয়েছি, সেটা আমি নিজেও ভাবিনি। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।
বাংলা ট্রিবিউন: ফেরার পর এক মাসে দুটি নাটকের কাজ করলেন। দুটোতেই সঙ্গে পেয়েছেন অপূর্বকে। পূর্ব পরিকল্পিত নয় তো!
ঐন্দ্রিলা: একদমই না। পুরোটাই কাকতাল। ইনফ্যাক্ট আমার তৃতীয় কাজটিও অপূর্বর সঙ্গেই করার কথা ছিল। তবে সেটি এখন আর হচ্ছে না। আসলে এর সঠিক উত্তর নির্মাতারাই ভালো দিতে পারবেন। আমি শুধু এটুকু বলছি, লম্বা বিরতির পর নাটকের সেটে কাজ করতে গিয়ে বেশ স্বস্তি পেয়েছি। নির্মাতা-সহশিল্পীরা দারুণ সহযোগিতা করেছেন আমায়। আমরা এতটা হেল্পফুল, তেমন ধারণা ছিলো না। সহশিল্পী হিসেবে অপূর্ব সত্যিই ভালো।
বাংলা ট্রিবিউন: সংসারের খবর একটু জেনে নিই।
ঐন্দ্রিলা: বাচ্চা, হাজবেন্ড সব আছে আমার। সংসার জীবনে আমি খুব সুখী একটা মানুষ। আমার দুটি সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে।
বাংলা ট্রিবিউন: দুটি নাটকে কাজ করলেন। নতুন কাজের খবর জানতে চাই।
ঐন্দ্রিলা: রুবেল হাসানের ‘বিলাভড’ আর মাবরুর রশীদ বান্নাহর ‘সাংসারিক ভালোবাসা’ করলাম। এ বছর সম্ভবত এই দুটি কাজেই সীমাবদ্ধ থাকছি। সত্যি বলছি, আমি ইচ্ছে করলে রোজ ব্যস্ত থাকতে পারি। কিন্তু করছি না। আমার ফেরার নিউজ বের হওয়ার পর প্রায় সবাই আমাকে কাজে নেওয়ার ইচ্ছে জানিয়েছেন। অনেক চিত্রনাট্য জমে গেছে। আমাকে নিয়ে সবার প্রত্যাশা অনেক হাই। তাই ফিরে এসেই তাড়াহুড়া করতে চাই না। আমি অবশ্য এমনটা কখনওই করিনি। একসঙ্গে অনেক কাজ করতে পারিও না। ফলে আমি আগের মতোই আস্তে ধীরে বেছে বেছে পছন্দসই কাজ করতে চাই।
বাংলা ট্রিবিউন: একটু পেছনে যাই। লম্বা সময় নাটকের বাইরে। প্রায় দশ বছর হবে। কেন!
ঐন্দ্রিলা: আপনাদের কাছে দীর্ঘ সময়। আমার কাছে নয়। আপনারা বলছেন আমি চুপ ছিলাম। আমি বলছি, বরং বেশি সরব ছিলাম। আমার জীবনে এই মাঝের সময়টুকুতে অনেক কিছু হয়ে গেছে।
বাংলা ট্রিবিউন: তা তো বটেই, একজন বুলবুল আহমেদের চলে যাওয়া তো পুরো মিডিয়ার জন্যই বড় বিচ্ছেদের ঘটনা।
ঐন্দ্রিলা: আব্বু যে আমার জীবনে কী ছিলেন, সেটা বোঝানো যাবে না। আব্বু মারা যাওয়ার পর গত এক বছর আমি একটু স্বাভাবিক আছি। এখনও আব্বুর বিষয়ে কেউ কোনও কথা তুললে আমি কেঁদে ফেলি। আসলে আমি ছোটবেলা থেকে আব্বুর বাইরে নিজেকে কখনোই কিছু ভাবতে পারিনি। আমাদের রাতদিন প্রায় ২৪ ঘণ্টা একসঙ্গেই কাটতো। তার শুটিং, তার অফিস, তার মিটিং- সবখানে আমি ছিলাম সঙ্গী। উনি চলে যাওয়ার পর আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে একা মানুষ বলে আবিষ্কার করলাম।
বাংলা ট্রিবিউন: মূলত এই জন্যই কি অভিনয় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন?
ঐন্দ্রিলা: এভাবে বলাটাও ঠিক নয়। আপসেট ছিলাম, তবে এই সময়ে আমি আরও অনেকগুলো কাজ করেছি আব্বুর শোক কাটাতে। আব্বুকে নিয়ে ডকুমেন্টারির কাজ আগেই শুরু করলাম, এরপর বায়োগ্রাফি লিখলাম। বায়োগ্রাফি লিখতেই তো প্রায় তিন বছর সময় নিয়েছি। আমি আসলে মাঝের দশ বছর এভাবেই আব্বুর সঙ্গে ছিলাম। তার কিছু ইচ্ছে ছিল, সেসব পূরণেরও চেষ্টা করেছি।
বাংলা ট্রিবিউন: ইচ্ছে! আপনার সম্পর্কে নন্দিত অভিনেতা বুলবুল আহমেদ প্রায়শই বলতেন, ‘ঐন্দ্রিলাকে যখন পর্দায় দেখি, খুব ভালো লাগে। মনে হয় ও আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।’ অভিনয় থেকে দূরে সরে তাঁর এই ইচ্ছেটি তো আঘাতপ্রাপ্ত হলো।
ঐন্দ্রিলা: একদমই না। আব্বুর ইচ্ছেতে আঘাত করার এক ফোঁটা সুযোগও নেই। অন্তত আমার জীবদ্দশায়। আমি সিটি কলেজ থেকে মার্কেটিংয়ে অনার্স করেছি। কিন্তু আব্বু মনে মনে চাইতেন, আমি অভিনয়-নির্মাণের সঙ্গেই থাকি। তিনি চাইতেন, আমি এসব বিষয়ে পড়াশুনা করি। আব্বুর সেই চাওয়া পূর্ণ করার জন্যই এরমধ্যে আমি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়ার ওপর মাস্টার্স সম্পন্ন করি।
বাংলা ট্রিবিউন: তাই বলুন…
ঐন্দ্রিলা: বলছি, শুনুন। এখানে আমি অনেক ভালো রেজাল্ট করি। থ্রি পয়েন্ট সেভেন সিক্স পাই আউট অব ফোর-এ। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে লেকচারার হিসেবে যোগ দেওয়ার অফার করেছে। কিন্তু আমি সেটা করিনি। বাবার ইচ্ছা পূরণের জন্যই।
বাংলা ট্রিবিউন: মাঝে অভিনয় না করলেও আপনাকে বেশ কিছু অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় দেখা গেছে। এটা কেন?
ঐন্দ্রিলা: যে ক’টি করেছি সবই বিশেষ প্রোগ্রাম। সময় কাটানোর জন্য করেছি। অবশ্য পরে মনে হলো, আমি তো উপস্থাপিকা না। আব্বু তো আমাকে উপস্থাপক হতে বলেননি কখনও। আমার আসলে অভিনয়টাই করা উচিত। এসব ভেবে পরে ছেড়ে দিয়েছি উপস্থাপনা।
বাংলা ট্রিবিউন: তো এবারের পরিকল্পনা কী?
ঐন্দ্রিলা: কাজ করবো। ভালো কাজ করবো। আগেও তাই করেছি। যার কারণে আমার প্রতি সবার এক্সপেকটেশন বেশি এখনও। ওটাই ধরে রাখতে চাই।
বাংলা ট্রিবিউন: ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়ার ওপর লেখাপড়া করে শুধু অভিনয়টাই করবেন?
ঐন্দ্রিলা: মজার কথা বলি, আব্বুকে নিয়ে বায়োগ্রাফি লিখতে গিয়ে আমার হাত খুলে যায় একটা সময়। তখন পরপর কয়েকটা স্ক্রিপ্টও লিখি! জানি না কেমন হয়েছে, তবে আমি হ্যাপি। সম্প্রতি বেশ ক’জন নির্মাতা আমার চিত্রনাট্য দেখেছেন। এরমধ্যে একটা স্ক্রিপ্ট একজন নির্মাতা নিয়েও গিয়েছেন। আশা করছি, অভিনয়ের পাশাপাশি চিত্রনাট্যটা কনটিনিউ করবো।
বাংলা ট্রিবিউন: তার মানে নির্মাণের কোনও ইচ্ছে নেই! আপনার আব্বু কিন্তু নির্মাণেও সোনালি দাগ রেখে গেছেন। তাছাড়া আপনি তো এসব দেখেই বড় হয়েছেন। লেখাপড়াও করলেন এ নিয়ে।
ঐন্দ্রিলা: এটা ঠিক, এসবের মধ্য দিয়েই আমার বেড়ে ওঠা। তাছাড়া এই বিষয়ে মাস্টার্স করার পর এখন আমি ক্যামেরা, লাইট, এডিটিংয়ের বিষয়গুলো প্র্যাকটিক্যালি বুঝি। তবে এখনই আমি মেকিং নিয়ে ভাবতে চাই না। কারণ, অভিনয়ের সঙ্গে পরিচালনার সংঘাত তৈরি করতে চাই না। অবশ্যই নির্মাণ করবো। তবে লম্বা প্রস্তুতি শেষে।
বাংলা ট্রিবিউন: একটা ভুলই হয়ে গেল। আপনার জন্ম আর বেড়ে ওঠাই তো সিনেমার সংসারে। অথচ শুরু থেকে নাটক নাটক নাটক প্রসঙ্গ চলছে…।
ঐন্দ্রিলা: ঠিকই। মনে পড়ে খেলার মাঠ বলতে আমি জানতাম চার দেওয়ালের ঐ বিশাল এফডিসিটাকে। ওখানেই খাওয়া, ঘুমানো। আব্বুর সুবাদে কত কত কিংবদন্তি মানুষের কোলে, কাঁধে চেপে সেই সোনালি শৈশবগুলো কাটিয়েছি এফডিসি চত্বরে। এই তো আমাকে কাঁদার অজুহাত তৈরি করে দিলেন…।
বাংলা ট্রিবিউন: এর জন্য দুঃখিত। একেবারেই শেষ জিজ্ঞাসা। সিনেমার দিন ফিরছে হয় তো। আপনিও ফিরেছেন অভিনয়ে। এই পর্বে সিনেমায় অভিনয় করার কিংবা নায়িকা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে কি?
ঐন্দ্রিলা: (এবার অট্টহাসি) কী করবো, বুঝতে পারছি না। সিনেমার অফার অলরেডি দুজন দিয়েছেন। সত্যি করে বলি, আমার বাবা আপাদমস্তক সিনেমার মানুষ ছিলেন। শৈশবে আমি প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই ফিল্মের। সাদাকালো ছবির যুগ তখন। আগেই বলেছি, বড় হয়েছি এফডিসির সেটে। ওটাই ছিল খেলার মাঠ। সিনেমা কেন নয়! ভালো অফার পেলে অবশ্যই সিনেমায় অভিনয় করবো।
বাংলা ট্রিবিউন: শেষের লাইনটি একেবারেই পুরনো। কালে কালে সব টিভি নায়িকাই এভাবে বলে থাকেন। আমরা আমাদের আলাপের শেষের দিকে আছি। সিনেমায় অভিনয় প্রসঙ্গে আপনার নিজস্ব মন্তব্য চাই।
ঐন্দ্রিলা: আচ্ছা। ওকে। বুঝতে পেরেছি। সত্যি সত্যি বলছি, আমি রাইমা সেনের খুব ভক্ত। তার মতো চরিত্র পেলে অথবা কলকাতা টাইপের (অফট্র্যাকে) কোনও সিনেমার অফার পেলে অবশ্যই করবো। করবো মানে, আমি অপেক্ষায় থাকলাম।
বাংলা ট্রিবিউন: অপেক্ষার অবসান হোক দ্রুত।
ঐন্দ্রিলা: ওকে...। ধন্যবাদ।