X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংগীতশিল্পীর বয়ানে নির্মাতা অনন্য মামুন গ্রেফতারের বর্ণনা

ওয়ালিউল বিশ্বাস
২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৬:২৮আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:০৫

মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে বিমানে এইচএম রানার সেলফিতে সহশিল্পীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আড়ালে মানব পাচারের অভিযোগে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা অনন্য মামুনকে গ্রেফতার করেছে মালয়েশিয়ান পুলিশ। দেশটির রাজধানী কুয়ালালামপুরের এলপি নামের একটি ভবন থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
কুয়ালালামপুরে ‘সিনেমাটিক বাংলাদেশি নাইটস’ নামের কনসার্টে অংশ নিতে মামুনের আয়োজনে বাংলাদেশ থেকে ৪৮ জনের একটি দল দেশটিতে গিয়েছিল। যেখানে ছিলেন তারকা কণ্ঠশিল্পী, ব্যান্ড, নির্মাতা, সাংবাদিক এবং চিত্রনায়ক-নায়িকা।
আসলে কী ঘটেছিল, তার পুরোটা জানা গেল সংগীতশিল্পী এইচএম রানার কাছে। তিনিও সেই কনসার্টে অংশ নেন এবং ঘটনার সময়কার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। আদম পাচারের অভিযোগে নির্মাতা মামুন গ্রেফতারের বিষয়টি জানতে চাইলে রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন বিস্তারিত। তার বয়ানে তুলে ধরা হলো পুরো ঘটনা-
অনন্য মামুন মামুন গ্রেফতারের নিউজগুলোতে পুরো সত্যটা আসছে না। আমরা যে অ্যাপার্টমেন্টে ছিলাম সেখানেই ঘটনাটি ঘটে। পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি। অনন্য মামুন যে এমন একটি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, তার কোনও কিছুই জানতাম না। আমি যে অ্যাপার্টমেন্টে ছিলাম সেখানেই রাখা হয়েছিল পাচার হওয়া মানুষদের। আমি ছিলাম ১৬ তলায়। আর নায়ক ইমন-নিরব ও উপস্থাপক দেবাশীষ বিশ্বাস ছিলেন সম্ভবত ১৯ তলায়। পুরো ভবনটি ২৬ তলা। বাকিরা অন্য একটি হোটেলে ছিলেন। 
পাচার হওয়া যে মানুষদের আনা হয়েছিল তারা ছিলেন ২০ তলায়। তাদের দুই দিন ধরে আটকে রেখেছিল। এই দুই দিনে  তাদের কোনও খাবারই দেওয়া হয়নি। মানুষ খাবার ছাড়া কতক্ষণ থাকতে পারে? একটা সময় এ মানুষগুলো অ্যাপার্টমেন্ট ভাঙচুর শুরু করেন। তখনই অ্যাপার্টমেন্ট কর্তৃপক্ষ পুলিশকে খবর দেয়। আর পুলিশ এসেই বিষয়টি বুঝতে পারে।
ঘটনাটি শুরু হয় ২৪ তারিখ ভোর থেকে। ২৩ তারিখ রাতে কনসার্টের পর আমি বেশ ক্লান্ত ছিলাম। তাই পরদিন আর রুম থেকে বের হয়নি। দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমাই। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা। আমার রুমে ছিলেন আমান (চিত্রনায়ক) ভাই, মিষ্টি (চিত্রনায়িকা) আপু ও তার মা। ঘুম থেকে উঠে দেখি, রুমে কেউ নেই। লিফটের কার্ড পাচ্ছিলাম না। আমি তখন অনন্য মামুনের সহকারী মানে যারা এ ট্যুর ম্যানেজ করছেন তাদের একজন রাকিবকে মেসেঞ্জারে ফোন দিই। রাকিবই এই আদমগুলোর টিকিটের ব্যবস্থা করেছেন বলে পরে জানতে পারি। ফোন দেওয়ার পর রাকিব আমাকে বলেন, ‘২০ তলায় আসেন।’ আমি হেঁটে হেঁটে ২০ তলায় উঠি। এরমধ্যে অনন্য মামুনের প্রধান সহকারী মিরাজ সেখানে আমাকে দেখে বলেন, ‘ইস্ রানা ভাই আপনি কেন এর মধ্যে এলেন?’ তখনই পেছন থেকে একজন আমাকে বলে ওঠে, ‘গো ইনসাইড।’ আমি প্রশ্ন করলাম, হোয়াই? তিনি বললেন, ‘নো টক, গো ইনসাইড।’
ভেতরে গিয়ে দেখি, সাদা পোশাকে সাত-আটজন বসে আছেন। বুঝলাম, তারা পুলিশের লোক। আমার পরিচয় জানতে চাইলেন তারা। তারপর বললেন, ‘ঐ রুমে যাও। কিছুক্ষণ পর তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ মিরাজ এসে বলে, ‘সমস্যা হবে না ভাই। ওরা খুবই ফ্রেন্ডলি।’ এরপর আমি, রাকিব আর মিরাজ পাশের রুমে বসলাম। আমি তখন খুব রেগে গিয়ে বললাম, আমাকে ফাঁসানোর মানে কী? তুমি তো বলতেও পারতে, এখানে এমন ঝামেলা চলছে। রাতে আমার ফ্লাইট আমি চলে যেতে পারতাম। আমাকে কেন ঝামেলার মধ্যে ফেললে?
রাত গড়ানোর পর সমস্যাটা আরও জটিল হয়। সায়েম নামের একজন জানায়, ১০ হাজার রিঙ্গিত দিলে এ সমস্যার সমাধান হবে। রাকিব ও মিরাজ তখন মামুনকে ফোন দেয়। মামুন বলেন, ‘আমি কিছু জানি না, ম্যানেজ করে নেন না ভাই।’ পুরো উল্টা কথা!     
এরমধ্যে যতবারই ফোন দেওয়া হয়, মামুন ফোন কেটে দেন বা ধরেন না। তারা আবারও বলে, মামুন এলে দুই লাখ টাকা দিলেই ছেড়ে দেবে। অন্যদিকে মামুন শুধু সময় ক্ষেপণ করেন।
প্রায় তিন ঘণ্টা পর মামুন আসেন। তিনি যখন ঢুকছেন তখন বাজে রাত পৌনে ১টা। রাকিব ও মিরাজ খুব উচ্ছ্বসিত যে, এখান থেকে ছাড়া পেয়েই তারা বড়দিনের পার্টি করবে!
মামুনের সঙ্গে একটি মহিলা ও একজন ছেলেও আসেন। মহিলাটা হলেন, কনসার্টের অ্যারেঞ্জার আর ছেলেটির নাম শিবা। সে নাকি মালয়েশিয়ার ডন! এ তথ্যটি রাকিবই আমাকে দেয়।
মামুন ঢোকার ২০ মিনিটের মধ্যে মারের আওয়াজ আসতে থাকে। এরমধ্যে আমাদের ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমি খুব টেনশনে পড়ে গেলাম। এরমধ্যে মামুনকে ফোন দেওয়া হলো। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘মারবে কেন!’
তখন আমার মনে প্রশ্ন হলো, যদি টাকা দিয়ে সমাধান করা হয়, তাহলে মারবে কেন?
গ্রেফতার হওয়া মামুনের দুই সহযোগী মিরাজ ও রাকিব তার পরপরই মামুনের ফোন বন্ধ হয়ে যায়। তখন বুঝলাম, এটা ছিল পুলিশের পলিসি। মামুনকে ধরার জন্য এভাবেই টাকার কথা বলে ফাঁদ পাতা হয়েছিল। রাত তখন সোয়া ২টা। এরমধ্যে এক মহিলা পুলিশ এসে ভিসা চায়। রাকিব ও মিরাজের কাছে পাসপোর্ট নাই। আমি বলালাম আমার ফ্লাইট আছে। তিনি বললেন, ‘তুমি যেই হও না কেন, এই রুমে যারা আছে তারা কেউই যেতে পারবে না। পুলিশ তদন্ত করে মামলা দেওয়া হবে।’
এরপর আমাদের ফোনগুলো নিয়ে যায়। আর আমাদের একতলা উপরের ডুপ্লেক্স রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে মামুনকে নেওয়া হয়েছিল আগেই। যদিও আমরা গিয়ে দেখি মামুন সেখানে নেই! ওখানে ১০-১২ জন বসা। কোমরে শিকল পরানো। সঙ্গে ওই দুইজন ছেলে (শিবা) ও মেয়ে (আয়োজক) বসা।  তাদেরও হ্যান্ডকাফ পরানো।
আবারও পাসপোর্ট চাইল তারা। না পেয়ে তারা গালাগালি করতে লাগলো যে, পাসপোর্ট ছাড়া মালয়েশিয়া কেন এসেছে? মিরাজ ও রাকিবকে হ্যান্ডক্যাফ পরানো হয়। আমার মাথা তখনও ব্ল্যাঙ্ক! হঠাৎ মনে পড়লো, আমার কাছে তো পাসপোর্ট আছে। আমি বললাম, আমার কাছে পাসপোর্ট আছে। আমার ট্রাভেলের সব কাগজ আমার কাঁধের ছোট ব্যাগ থেকে দিলাম। তারা আমাকে নিয়ে বসল। এরপর কাগজ দেখল। বলল, ‘ইউ ওয়েট অ্যান্ড কাম উইথ মি।’ এরপর নিচে নামল (২০ তলায়)। আমার কাগজ নিয়ে তারা আলাদাভাবে চেক করল। আমি আমার পরিচয় জানালাম। বললাম, বাংলাদেশের গায়ক আমি। তারা সেটার প্রমাণ চাইল। আমি গত কনসার্টের  ভিডিওগুলো দেখালাম। কনসার্টে ইন্টারভিউয়ের ছবি দেখালাম। তখন তারা কিছুটা নরম হলো। বলল, ‘তুমি যেতে পার। তোমার ফ্লাইট তো ছয়টায়। চাইলে এখনও তা ধরতে পার।’

সেই কনসার্টের পোস্টার শেষে হ্যান্ডশেক করে ১৬তলা থেকে লাগেজ নিয়ে আমাকে একেবারে ভবনের নিচে নিয়ে আসে তারা। তখন দেখি, অনন্য মামুনকে ৭-৮জন পুলিশ ঘিরে আছে। তার হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো।
মামুন আমাকে দেখে বলেন, ‘রানা ভাই আপনাকে ছেড়ে দিয়েছে!’
আমি বললাম, ‘এসব কী বলেন, আমি এখানে কী জন্য এসেছি? আর এই বিপদেই বা কেন ফেললেন!’
তিনি অনুরোধ করতে থাকেন, দেশে ফিরে আমি যেন কাউকে কিছু না বলি। দেশের লোকজন যেন না জানে। আমি তার কথা না শুনে হেঁটে বাইরে চলে এসে কোনও রকম একটা ট্যাক্সিতে উঠি। এরপর দেশে ফেরা।
এখন বুঝলাম, আদম ব্যবসার এ ঘটনা পুরো পরিকল্পিত। এমনকি এখনও মামুনের ফেসবুক চালু। এটা চালাচ্ছেন তার স্ত্রী। মামুন নাকি আগেই বলেছিলেন, যদি গ্রেফতার হয় তবে যেন তার স্ত্রী ফেসবুক চালু রাখেন। এগুলো সব সেই রাতে রাকিব আমাকে বলেন।

/এম/এমএম/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং
পুষ্পা: আসবে তৃতীয় কিস্তি!
পুষ্পা: আসবে তৃতীয় কিস্তি!