বছরের শুরু আর শেষটাও অ্যাডজাস্ট করে চলতে হচ্ছে বাংলাজয়ী জয়াকে। সতেরোর শেষের অংশটা কাটিয়েছেন ঢাকায় আর আঠারোর শুরুর সকালে (১ জানুয়ারি) ঠিক ঠিক উড়াল দিলেন কলকাতায়। যদিও জীবনটাকে অংকের হিসাবে ফেলতে একেবারেই নারাজ তিনি।
বলছেন, ‘আমি তো বোহেমিয়ান। তাই এই ওড়াউড়ি। হিসাব করে স্থির থাকিনি কখনও। নিজেকে ভুলে ছুটেছি চরিত্রের পেছনে। চরিত্রের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে করতেই আমার সকালগুলো সন্ধ্যায় হারায়।’
ফলও পেয়েছেন।বাংলাদেশের ‘গেরিলা’, ‘চোরাবালি’ ও ‘জিরো ডিগ্রী’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি তিন তিনবার সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘরে তুলেছেন আগেই। যদিও গেল বছর জয়ার কোল উপচে পড়েছে কলকাতা-মুম্বাইকেন্দ্রিক বেশ ক’টি বিশেষ স্বীকৃতি। এবিপি আনন্দ প্রবর্তিত ‘সেরা বাঙালি পুরস্কার’ দিয়ে শুরু। আর শেষ হয়েছে ‘জি সিনে অ্যাওয়ার্ডস’-এর মধ্য দিয়ে। ‘ভালোবাসার শহর’ আর ‘বিসর্জন’ দিয়ে টালিগঞ্জ এখন হয়ে আছে জয়াময়। সেই রেশ থাকছে নতুন বছরেও। থার্টি ফার্স্ট রাতে কলকাতার ব্যাগ গোছানোর ফাঁকে টুকটাক আলাপে মিলেছে তার খোঁজ।
জানালেন, ‘সকালেই কলকাতার ফ্লাইট। বছরের শেষটায় ঢাকায় বেশ আরামের দিন কাটিয়েছি। মাঝে বাচ্চাদের টানে সিলেটেও গিয়েছি। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়। ডাক এসেছে, বছরের প্রথম দিন থেকেই শুরু হচ্ছে আরেকটা জার্নি।’
বছরের প্রথম দিনেই কলকাতায় ডেকেছেন সেখানকার নন্দিত নির্মাতা সৃজিত। যার সঙ্গে জয়া আগেও কাজ করেছেন। কথায় কথায় জানা গেছে ‘রাজকাহানি’র পর সৃজিত এবার জয়াকে নিয়ে নির্মাণ করছেন ‘এক যে ছিল রাজা’। শুটিং শুরু ২ জানুয়ারি থেকে।
এর গল্প ভাওয়াল সন্ন্যাসী তথা ভাওয়াল রাজা মারা যাওয়ার ১২ বছর পর ফিরে আসার গল্প নিয়ে গড়া। এতে জয়া ছাড়াও অভিনয় করছেন অপর্ণা সেন, অজ্ঞন দত্ত, যীশু সেনগুপ্তের মতো তারকারা। যা জয়া অভিনীত ২০১৮ সালের অন্যতম ছবিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদিও এই বিষয়ে এখনই খুব বেশি খুলে বলতে চাইছেন না তিনি।
এটুকু বললেন, ‘আসলে ওখানকার কাজ নিয়ে আগাম বলা মুশকিল। এটা ওদের রীতিতে নেই। যা বলার সব প্ল্যান মোতাবেক অফিশিয়ালি বলতে হয়। এটুকু বলতে পারি, যথারীতি এই কাজটি নিয়েও আমি খুব উৎসাহী। বছরের শুরুটা একটা বড় কাজ দিয়ে হচ্ছে- এটাই আপাতত তৃপ্তির ঢেঁকুর।’
এদিকে নতুন বছরে সৃজিতে ডুব দেওয়ার আগেই ১৭ সালে বাংলাদেশে বেশ ক’টি কাজ শেষ করেছেন জয়া। ‘পুত্র’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘পেয়ারার সুবাস’ ও ‘দেবী’। এভাবেও বলা যায়, গেল বছর জয়া বাংলাদেশে টানা শুটিং করেছেন, শ্রম দিয়েছেন আর কলকাতা থেকে প্রচুর স্বীকৃতি তুলেছেন! তবে এভাবে বলায় জয়া খানিক আপত্তি আছে।
তার বলার ধরনটা এমন, ‘আসলে আমি ওভাবে ভাবি না। মানে, আপনারা বলছেন গেল বছর কলকাতা থেকে প্রচুর পুরস্কার পেয়েছি। ভালো অ্যাচিভমেন্ট হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে প্রতি বছরই অ্যাচিভমেন্টের মনে হয়। কারণ একটা ভালো কাজ করার জন্য প্রতিবছর প্রতিটি ক্ষণই নিজেকে তৈরি করার। ফলে কখনোই আমি বলবো না, এই বছরটা ব্যর্থতার বা ঐ বছরটা অনেক প্রাপ্তির।’
দম নিয়ে বলেন, ‘গেল বছরে আমি বাংলাদেশে প্রচুর কাজ করেছি। সিনেমার জন্য সবচেয়ে বেশি সময় দিয়েছি। অথচ সেগুলো পর্দায় আসেনি কিংবা দেখা যায়নি। অথচ এই কাজগুলোই হয়তো এ বছর কিংবা আসছে বছর সোনা হয়ে ধরা দেবে আমার ক্যারিয়ারে। তেমনি গত বছর যে কাজের জন্য কলকাতা থেকে সম্মাননাগুলো পেয়েছি- সেগুলো তো গত কয়েক বছরের সম্মিলিত ফসল।’
গেল বছর ২৯ জুলাই অভিনয়ের জন্য এবিপি-আনন্দ চ্যানেল আয়োজিত ‘সেরা বাঙালি’র সম্মানজনক স্বীকৃতি পেয়েছেন জয়া আহসান। টলিউডের শীর্ষ নায়ক প্রসেনজিতের হাত থেকে এ পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি অভিনেত্রী যিনি এই সম্মাননা প্রথম ঘরে তোলেন। জয়ার নিচের কথার সঙ্গে এই প্রাপ্তির উদাহরণটা বেশ প্রাসঙ্গিক।
তিনি বলেন, ‘ধরুন, একটা টুকরি আছে। সেখানে অল্প অল্প করে মাটি জমাতে জমাতে টুকরিটা ভরে গেছে। ২০১৭ সালের একাধিক পদক প্রাপ্তি দেখে আমার বেলায় তাই ভরা টুকরিটাই দেখছেন সবাই। কিন্তু এই টুকরিটা একটু একটু করে ভরার জন্য ২০১৬ সালে আমাকে অনেক কাজ করতে হয়েছে। ২০১৫তে আরও কষ্ট করেছি। আর আমার কাছে ১৩ তারিখও (আনলাকি থার্টিন) খুব ইম্পরট্যান্ট, আদরের। প্রত্যেকটা বছর, দিন, ঘণ্টাকে আমি ভালোবাসতে চাই। আমি কখনও শিক্ষক হতে চাই না। স্টুডেন্ট হয়েই থাকতে চাই। তাই আমার কাছে সব বছরের সব দিনই শিখে নেওয়ার।’
সম হারে দুই বাংলা জয় করে চলার মন্ত্র তাহলে এই। কিন্তু এটাও তো ঠিক- কলকাতার অতি উজ্জ্বল জয়াকে ঢাকায় এখনও খানিক ম্লান মনে হয়। অনুযোগ ওঠে, জয়া কলকাতার প্রতি যতটা আন্তরিক, ঢাকার দিকে ততটা নয়। এমনও বলা হয়, জয়া মাঝে মাঝে ঢাকায় বেড়াতে আসেন! এটাও তো ঠিক ‘গেরিলা’ ছাড়া জয়াকে জয়ার মতো করে বাংলাদেশের অন্য একটি ছবিতেও পাওয়া যায়নি!স্বাভাবিক প্রশ্ন- কলকাতার জয়া বাংলাদেশে খেই হারাচ্ছেন কোথায়? দেশ-মুক্তিযুদ্ধকে তো তিনি বরাবরই লালন করেন।
জয়ার বাচনভঙ্গি বরাবরই মাপা মাপা; ‘থিংক পজিটিভ’ টাইপ। আক্ষেপ ভেতরে থাকলেও সেটির হুবহু প্রকাশ ঘটান না কখনও। তবে এ পর্যায়ে বললেন খানিক, কেন কে জানে…, ‘দেখুন আমি যে কাজগুলো বিশ্বাস করি, যে ধারার কাজ করতে চাই সেগুলো নিয়ে সামনে আসা একটু কষ্টকর হয়ে যায়, এখানে। দেশে আমি প্রচুর সময় দিতে চাই, দেই। অনেক কাজও করেছি। কিন্তু অভিনয় করলেই তো সব শেষ না। একটা সিনেমা পর্দায় ওঠার আগ পর্যন্ত অনেকগুলো বিষয় থাকে। সেসব বিষয়ের কারণে বছরের পর বছর আটকে থাকে। মুক্তি আলো দেখে না। গেল বছর চারটি সিনেমার কাজ করেছি। এটা কিন্তু সংখ্যার বিচারে অনেক। সেগুলো আসবে কবে- প্রশ্ন থেকে যায়। তবুও আমি কাজগুলো করেছি মনের টানে। কারণ, আমি শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও দেশের কাজ করতে চাই। তরুণদের সঙ্গে থাকতে চাই। বিশ্বাস করুন, আমি যেখানে যাই, যে কাজটাই করি- বাংলাদেশটাকে মাথায় ধরে রাখি। এর বাইরে আমার আর কোনও পরিচয় নাই।’
নতুন বছরে পা ফেলে জয়া বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে ব্যাপক আশাবাদী। গেল বছরে মুক্তি পাওয়া ‘গহীন বালুচর’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘হালদা’, ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ এবং মুক্তিপ্রতিক্ষীত ‘স্বপ্নজাল’, ‘পুত্র’, ‘পেয়ারার সুবাস’, ‘দেবী’ সিনেমাগুলোকে উদাহরণ হিসেবে টেনে দিলেন জয়া।
বললেন, ‘মেঘ কেটে যাবে। এভাবে এই গতিটা থাকলে বদলে যাবে সব প্রতিবন্ধকতা। আমি তো গেল বছরের ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে আলোর রেখা স্পষ্ট দেখতে পারছি। এ বছরের তালিকাটাও বেশ সমৃদ্ধ। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাবতে ভালো লাগে, গেল বছরের শ্রমের ফল এ বছর আমার ঘরে আসবে। বেশ ক’টি সিনেমা রিলিজ হবে বাংলাদেশে। দেশের দর্শকদের আরও কাছাকাছি হতে পারবো। আমার প্রতি সব অভিযোগ মুছে যাবে, হয়তো।’
২০১৮ সালে বাংলাদেশের সিনেমার মধ্যে নূরুল আলম আতিকের ‘পেয়ারার সুবাস’ এবং নিজের প্রযোজনায় প্রথম সিনেমা ‘দেবী’ নিয়ে বেশি আশাবাদী জয়া আহসান। আর কলকাতার কাজের মধ্যে সৃজিতের ‘এক যে ছিল রাজা’র বাইরেও বেশ ক’টি বড় মাপের কাজের ইঙ্গিত দিলেন তিনি। যদিও সেসবের নাম-পরিচয় আগাম জানাতে বরাবরের মতো কৃপণতা দেখালেন বছরের শেষ রাত্তিরেও!
‘‘বাংলাদেশে এ বছর আমার স্পেশাল দুটি কাজ মুক্তি পাবে। ‘দেবী’ আমার একটা বড় প্রজেক্ট আর ‘পেয়ারার সুবাস’ অনেক পছন্দের কাজ। আর ওদিকে ‘এক যে ছিল রাজা’র বাইরেও অনেক ছবি আছে। কিছু বড় বড় প্রজেক্ট আছে এবার। এ বছর ওদিকের কাজই বেশি। গেল বছর যেমন দেশের কাজেই বেশি ডুবে ছিলাম।’’
মূলত এবারের আলাপটা ছিল বছর শুরু এবং শেষের প্রসঙ্গ মাথায় নিয়ে। পুরনো বছরে কী পেলেন, নতুন বছরে কী করবেন ইত্যাদি প্রাগৈতিহাসিক বিষয়! কিন্তু শুধু সেখানে আর থাকা হলো না। কথায় কথায় যাওয়া হলো অন্য অনেক প্রসঙ্গে।
প্রসঙ্গক্রমেই বছর শুরু ও শেষ প্রসঙ্গে জয়া জানালেন এভাবে, ‘আসলে শেষ বলে কিছু নেই। এটা আমাদের নিজেদেরই বানানো জিনিস। সবই কন্টিনিউয়াস প্রসেস। ভালোবেসে কাজ করছি নিত্যদিন। চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, নেবো। তবে এ বছরে এসে নতুন করে এটুকু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কাজ সংক্রান্ত হতাশাগুলো দূরে রাখার চেষ্টা করবো।’
বছরের শেষ রাতে জয়ার সঙ্গে শেষ আলাপের শেষ জিজ্ঞাসা ছিল- এই যে সারাক্ষণ ওড়াউড়ি, ভ্রমমাণ জীবন। আজ ঢাকা তো কাল কলকাতা। এই যে আজ (১ জানুয়ারি) যাচ্ছেন সৃজিতের ডাকে কাল হয়তো ফিরতে হবে নূরুল আলম আতিকের ডাবিংয়ে। একটু স্থিরতা অর্থাৎ স্থায়ী একটা ঠিকানা- হবে না? জবাব দিতে খুব একটা ভাবলেন না। চটজলদি জানালেন, এবারের সৃজিত সফর একটু দীর্ঘ হবে। টানা এক মাস চলবে শুটিং। ফলে এক মাসের মধ্যে চাইলেও কারও ডাকে ঢাকায় ফেরার সম্ভাবনা নেই তার।
উত্তরের আগে করা প্রশ্নে নিহিত ভাব কতটা টের পেয়েছেন জয়া সেটা প্রশ্নকর্তা নিশ্চিত নন। তবে সেই প্রশ্নের রেশ ধরে জয়ার এবারের যে উত্তর সেখান থেকে পাঠক/ভক্তরা যা ইচ্ছে বুঝে নিন, ‘আগেই বলেছি আমি তো বাউণ্ডুলে, বোহেমিয়ান। ব্যক্তিগত জীবন ও কাজের বেলায় আমি তাই। কাজের জন্য শুধু কলকাতা নয় চীন-জাপানেও ছুটে যাবো। এটা ভাবতে ভালোই লাগে। তবে এটা ঠিক খানিক স্থিরতাও দরকার। ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে উঠেছি। মনস্থির করেছি, এবার নিজেকে একটু সময় দেবো। খুব ইচ্ছে আছে।’
জয়ার ইচ্ছেরা বেঁচে থাক। ছড়াক দুই বাংলায় সমানুপাতিক হারে। প্রত্যাশা বাংলা ট্রিবিউন-এর। হ্যাপি নিউ ইয়ার- জয়া আহসান।
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন/ বাংলা ট্রিবিউন