X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১
উঠেছে পঞ্চমীর চাঁদ

‘চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকলাম’

ওয়ালিউল বিশ্বাস
১৩ মে ২০১৮, ০০:০৬আপডেট : ১৩ মে ২০১৮, ১২:৩৫

সারা যাকের। ছবি: তপু রেহমান শুরুটা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধেরও আগে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় নামের দলটিতে জড়ো হয়েছিলেন একঝাঁক তরুণ তুর্কি। এরপর যুদ্ধের বিগ্রহ আর স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে ১৯৭৩ সাল থেকে চালু হলো দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শন-কাল। যা আসলে খোলনলচে বদলে দিলো দেশের মঞ্চ নাটকের প্রদর্শনীর প্রক্রিয়া। এ বছর দেশের ঐতিহ্যবাহী এই দলটি উদযাপন করলো চার পেরিয়ে প্রতিষ্ঠার পাঁচ দশক। সঙ্গে দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনের ৪৫ বছর। দলের বয়সের মতোই শুরুর সে তরুণরা আজ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কাণ্ডারি। অনেক আলোকিত মুখকে সঙ্গে নিয়ে দলটিকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন আলী যাকের-সারা যাকেরের মতো কিংবদন্তি নাট্যজন দম্পতি। এসব নিয়েই বাংলা ট্রিবিউন-এর চার পেরিয়ে ‘উঠেছে পঞ্চমীর চাঁদ’ আয়োজনে কথা বলেছেন নন্দিত অভিনেত্রী সারা যাকের।
বাংলা ট্রিবিউন: নামটা কেন ‘নাগরিক’ হলো, এখান থেকেই আলাপচারিতা শুরু করা যেতে পারে?
সারা যাকের: আধুনিক, মুক্তমনা বা ওপেনমাইন্ড- এই অর্থে এসেছে নামটি। দলটিতে আমার যুক্ত হওয়াটা একটু পরে। ১৯৭২ সালে আমি এই সংগঠনে যুক্ত হই। তবে নাটকের জন্য মঞ্চে উঠি ১৯৭৩ সালে।
বাংলা ট্রিবিউন: পাঁচ দশকের পথচলা; অনেক চড়াই-উতরাই গেছে। কিন্তু নাগরিক এখনও দাপুটে। এতে আপনাদের শক্তিশালী দিক কী ছিল?
সারা যাকের: এটা তো বলা মুশকিল। আমরা অনেক সমমনা মানুষ একসঙ্গে ছিলাম। যারা সবাই পারদর্শী; নাটকে, অভিনয়ে। একসঙ্গে এত ভালো অভিনেতা তো পাওয়াও যায় না। তখন হয়তো বুঝতে পারতাম না। আতাউর রহমান, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, আলী যাকের, যুবরাজ, জামাল উদ্দিন- তাঁরা প্রত্যেকেই এত ভালো অভিনয় করেছেন, যা মাপার মতো নয়।
বাংলা ট্রিবিউন: কিন্তু বর্তমানের প্রজন্ম কি একটু পিছিয়ে পড়ল?
সারা যাকের: সব জেনারেশন তো একরকম হবে না। মেলালেও চলবে না। আমাদের পরবর্তীতে বিপাশা এসেছে; হায়াত ভাইয়ের মেয়ে। আফসানা মিমি, পান্থ শাহরিয়ার, রুনা খান, রওনক হাসান, ইরেশ যাকের এসেছে। কিন্তু ওরা শুধু নাগরিকের প্ল্যাটফর্ম নয়, অন্য অনেক মাধ্যমে কাজ করেছে। টিভিতে কাজ করছে, সিনেমা করছে। এখন আমরা পঞ্চাশ দশক সামনে রেখে আবারও উদ্যোগ নিচ্ছি। আগের মতো তো হবে না। আগে অনেক চরিত্র একবারে নিয়ে কাজ করেছি। এখন হয়তো সেটা সম্ভব হবে না।
সারা যাকের। ছবি: তপু রেহমান বাংলা ট্রিবিউন: পাঁচ দশকের পথচলা। অনেক স্মৃতি আপনার মনে জমে আছে। কিন্তু এমন একটা স্মৃতি আমাদের বিশেষ এই আয়োজনে রাখতে চাই, যা আপনার অনুপ্রেরণা।
সারা যাকের: অনুপ্রেরণাদায়ক মনে হয় আমাদের পরবর্তী জেনারেশন যখন মঞ্চে আসতে লাগলো। আমাদের মেয়ে শ্রিয়া (শ্রিয়া সর্বজয়া) এলো। বিপাশা হায়াত করল ‘ঠাট্টা-তামাশা’ নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়। আমাদের সঙ্গে তো তারাও সমান বড় রোলে করছে। এই তো সেদিন, ২০১৫-তে ভারতের ঊষা গাঙ্গুলির সঙ্গে কাজ করলাম। পান্থ শাহরিয়ার নাটক লিখেছে, খোকন (নাসিরুল হক) লাইট ডিজাইন করছে। মানে একাধিক প্রজন্ম একই মঞ্চে এভাবে মিশে যাওয়াটাই আমার কাছে বড় অনুপ্রেরণা।
বাংলা ট্রিবিউন: দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনের ৪৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। শুরুতে কী ভেবে এটা চালু করেছিলেন?
সারা যাকের: দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনের শুরুটা ছিল ১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। স্পষ্ট মনে আছে, ৪৫ বছর আগের সেই দিনটি ছিল রবিবার। দর্শনীর বিনিময়ে প্রথম যে নাটকটি আমরা করেছিলাম, সেটির নাম ‘বাকি ইতিহাস’। মনে আছে, ওই পর্যায়েই একবার আমরা আটটা রোববার ব্রিটিশ কাউন্সিলে হল বুক করে নাটক করেছিলাম। সত্যি সত্যিই তখন ভাবিনি, এই প্রথাটি সবাই গ্রহণ করবে। এটা মাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে।
এরপর সেখানে আর নাটক করতে পারলাম না। আমার ভাইও নাটকে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে আমরা হারাই। তাই তার কাছ থেকেই অনেক আগে জেনেছিলাম মহিলা সমিতিতে নাটক করা যায়। ঠিক হলো আমরা সেখানে নাটক মঞ্চস্থ করবো। যেহেতু তথ্য আমি দিলাম, তাই আমাকে পাঠানো হলো, বিষয়টি দেখার জন্য।
বাংলা ট্রিবিউন: এখন তো প্রতিদিন ঢাকা শহরে দর্শনীর বিনিময়ে কোনও না কোনও নাটক হচ্ছে। কেমন লাগে বিষয়টি?
সারা যাকের: যখন আমরা এটা ভেবেছি, সেটাই আমাদের প্রথম সার্থকতা। কারণ, এর আগে এভাবে কেউ ভাবেনি মঞ্চ নাটক নিয়ে। শুরুর কিছুদিন পর অনেক দল যখন এতে যুক্ত হয়েছে, তখন মনে হয়েছে এটা আমাদের সম্মিলিত ভাবনার ফসল। তবে এখন যেটা নিয়ে প্রায়ই ভাবি, সেটা হলো কেন ক্রমশ মঞ্চ নাটক থেকে দর্শক কমে যাচ্ছে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার শুরুটা হয়েছিল সেই নাটক অর্থাৎ ‘বাকি ইতিহাস’ দিয়ে। কিন্তু এ নাটক আপনার ব্যক্তিগত জীবনে অন্যরকম ইতিহাস তৈরি করেছে। আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন কোন বিষয়টি তুলতে চাইছি!
সারা যাকের: ১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মঞ্চে আসে বাদল সরকারের গল্পে ‘বাকি ইতিহাস’। নির্দেশনা দিয়েছেন আলী যাকের।
আসলে যেটা হয়েছিল, আমি এসএসসি দিয়ে বসে আছি। সেই সময়টাতে ছেলেমেয়েরা সবাই কিছু একটা করতে চায়। আমিও কিছু একটা করবো ভাবছি। নায়লা আহমেদ জামানরা কিছুদিন আগেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। ও তখন নাগরিকেই কাজ করছে। ও একদিন বললো, আমাদের একটা দল আছে, তুমি আসো। তখন নাগরিক ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটি নিয়ে কাজ করছিলো। সেই নাটকে তামান্না রহমান রাব্বানীর একটি চরিত্র করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সেটি করতে পারেননি। পরে উনার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে আমাকে নেওয়া হলো। নায়লার বাবা হলেন আমার বাবার বন্ধু। আংকেল আমাকে মজা করে বললেন, এই তুই এটা কর। তুই ইংরেজিতে পড়ালেখা করেছিস। এটা করলে বাংলাটা আরও সুন্দর করে বলতে পারবি। আসলে আমি তো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালেখা করেছি, তাই তিনি তখন উৎসাহ দিতে এভাবে বললেন। নায়লাও আর থাকল না। সে ডাক্তারি পড়ত। নানা কারণে থাকতে পারেনি। এরপর থেকে আমি নিয়মিত কাজ করতে থাকলাম নাগরিকে।
বাংলা ট্রিবিউন: এভাবেই বোধহয় আলী যাকেরের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক তৈরি করে দেয়।
সারা যাকের: আসলে তার সঙ্গে যোগাযোগের আর তো কোনও কারণ ছিল না যে আমি আলী যাকেরের সঙ্গে মিট করব কিংবা বিয়ে হবে। নাটকই আমাদের ঘনিষ্ঠতার সুযোগ করে দেয়। নাটকই আমাদের যোগসূত্র।
বাংলা ট্রিবিউন: কর্পোরেট দুনিয়া, নিজের প্রতিষ্ঠান, অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ত আপনি। মঞ্চটাকে আগের মতো মিস করেন?
সারা যাকের: বছর দুয়েক আগে থেকে আমি ডিসাইড করেছি, আমার কর্মস্থলকে বলে রেখেছি, সকাল থেকে বেলা ১২ পর্যন্ত আমার সময়। আমি তখন শুধু আমার জন্য সময় রাখি। মূলত নাটকের জন্য সময় রাখি। নাটকের রিহার্সেল করি। এখনও নতুন একটা নাটকের কাজ করছি।
বাংলা ট্রিবিউন: কোনটা?
সারা যাকের: ওপেন কাপল। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পাঁচ দশক পূর্তি উৎসবে এটি মঞ্চে আসে। এটি মূলত অনুবাদ। ইতালিয়ান নোবেল জয়ী শিল্পী দারিও ফো ও তার স্ত্রী অভিনেত্রী ফ্রাঙ্কা রেম এ নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন। সেখান থেকেই আমরা নাটকটি তৈরি করেছি।
সারা যাকের। ছবি: তপু রেহমান বাংলা ট্রিবিউন: আপনার সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন প্রত্যাশা করে এ বেলায় উঠতে হচ্ছে। কিছু বলে ইতি টেনে দেবেন...।
সারা যাকের: ধন্যবাদ। কিছুদিন আগে আমরা যখন ‘ওপেন কাপল’ নাটকটি মঞ্চে তুলতে ব্যস্ত তখন মনে হলো, এখন আমাকে কারোর গাইডের মধ্যদিয়ে যাওয়া উচিত। মানে আমি চাইছিলাম কেউ একজন আমাকে বলুক, এটা এভাবে না হয়ে ওভাবেও হতে পারে। তখন শ্রিয়াকে (আমার মেয়ে) বলেছিলাম আমাকে গাইড করার জন্য। শ্রিয়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে যা বললো, আমি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে! মনে মনে বললাম, বাপরে বাপ, এই মেয়ের জন্মই হয়েছে বুঝি নাটকের জন্য!
ওই যে শুরুর দিকে জানতে চেয়েছিলেন অনুপ্রেরণার কথা। এমন প্রজন্মই তো আমার আসল অনুপ্রেরণা।

/এমএম/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
অবশেষে মুক্তির বার্তা
অবশেষে মুক্তির বার্তা
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!