X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
উঠেছে পঞ্চমীর চাঁদ

‘সাদা’ কিংবা আমার একাকিত্বের স্মৃতি

মিনার রহমান, সংগীতশিল্পী ও কার্টুনিস্ট
১৩ মে ২০১৮, ০০:০৭আপডেট : ১৩ মে ২০১৮, ১৫:২৫

মিনার রহমান/ ছবি: সাজ্জাদ হোসেন নিজের কথা বলার আগে প্রিয় বাংলা ট্রিবিউন-এর চার পেরিয়ে পাঁচ-এ পা রাখার এই দারুণ দিনে জানাই হৃদয় থেকে শুভেচ্ছা। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমার একটা প্রাণের টান তৈরি হয়েছে। ‘উঠেছে পঞ্চমীর চাঁদ’ নামের বিশেষ এই আয়োজনে নিজের কথাগুলো শেয়ার করতে পেরে ভালো লাগছে।
এবার নিজের প্রসঙ্গে যাই। এই বিশেষ আয়োজনে আমি আমার ছোট্ট জীবনের সেরা একটি গান নিয়ে ফিরে তাকাতে চাই বছর দশেক পেছনে। অনুমান করতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। গানটির শিরোনাম ‘সাদা’।  
যে সময়টাতে আমি ‘সাদা’ গানটি একটু একটু করে তৈরি করছিলাম তখন ব্যক্তিগত জীবনে অদ্ভুত একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। অদ্ভুত বলছি এই কারণে, তখন আমি ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে থাকি যে প্রতিদিন কিছু না কিছু সৃষ্টি করছি। এই যে সৃষ্টিশীলতা, এটা আবিষ্কার করার মধ্যে একটা মজা আছে। প্রথম প্রথম আমি সারা দিনই গুন গুন করতাম। যেসব সুর গুন গুন করতাম ওগুলো শোনা কোনও গান নয়। নিজেই লিখতাম, সুর বানাতাম আর গুন গুন করে গাইতাম। তারপর ধীরে ধীরে আমি গোছানোভাবে গানগুলো বানানো শুরু করলাম। পিয়ানোতে প্রতিটা গানের কর্ডিং করা শুরু করলাম। ওই সময়ের বানানো অনেক গানের মধ্য থেকে ১০টি গান নিয়ে ‘ডানপিটে’ অ্যালবামটি বের করেছিলাম ২০০৮ সালে। সবেমাত্র স্কুল জীবন শেষ হয়েছে তখন। বয়স ১৬ কি ১৭। ‘সাদা’ ওই অ্যালবামের প্রথম গান যা অনেক মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে। এখনও ‘সাদা’ আমার জীবনের অন্যতম জনপ্রিয় গান। সেই সময় মানুষ যেভাবে ‘সাদা’ গানটিকে গ্রহণ করেছে সেটা আমাকে বিস্মিত করেছিল। ‘মিনার’ নামটি মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এই গানটি দিয়েই।
‘সাদা’ আসলে একাকিত্বের গান। সে কারণেই হয়তো সবার হৃদয়ে গানটি স্থান করে নিয়েছে। কারণ, মানুষের জীবনে সবারই দিনশেষে একটা সময় একা হতে হয়। মানুষ একা হতে ভালোবাসে। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ তার জীবনের কিছুটা সময় নিজেকে দিতে চায়। একাকীত্বেরও একটি আলাদা অনুভূতি আছে। ‘সাদা’ একাকীত্বের সেই অনুভূতিটাই হয়তো উপস্থাপন করে।
‘সাদা’ গানটি নিয়ে মিনারের আঁকা ইলাস্ট্রেশন আমি যখন ‘সাদা’ লিখি তার কয়েকমাস আগে আমার বাবা মারা যান। আমি বিশ্বাস করি, আমার জীবনের ক্রিয়েটিভিটির অনেক কিছুই বাবার কাছ থেকে এসেছে। যদিও তিনি একজন ব্যাংকার ছিলেন, পাশাপাশি শিল্প সাহিত্যে তার আগ্রহের কমতি ছিল না। তাঁর আঁকা ছবির দিকে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। আমাকে বই পড়তে প্রচণ্ড উৎসাহ দিতেন তিনি। ছোটবেলায় পড়ার বইয়ের বাইরেও অনেক গল্পের বই আর কমিক তিনি আমাকে কিনে দিয়েছেন। বাবা বেঁচে থাকলে আমি হয়তো অনেক গল্প করতাম তার সঙ্গে। ওই সময় ওই বয়সে আমি খুব একটা গল্প করতে পারিনি। বাবার সাথে খাবার টেবিলে বসে সমাজ কিংবা রাজনীতি নিয়ে গল্প করার অনেক আগেই তিনি চলে গেছেন। একজন সন্তানের সবচেয়ে বড় যে ভরসা, তার নাম ‘বাবা’। কারও বাবা যখন পৃথিবী থেকে চলে যায়, তখন হঠাৎ করে জীবনটা অন্যরকম হয়ে দেখা দেয়। যারা অল্প বয়সেই মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটাকে হারিয়ে ফেলে, তারা হয়তো একা একা জীবনটাকে দেখে। জীবনকে বোঝার চেষ্টা করে। এই যে জীবনকে বোঝার যে যাত্রা, যে অনুভূতি, সেটার একটা প্রভাব আমার ‘সাদা’ গানটিতে পড়েছে।
আমি পাঁচ বোনের একমাত্র ভাই। শৈশব থেকেই এই পাঁচ বোন আমার যাবতীয় আবদার রক্ষা করে আসছে। সত্যি কথা বলতে, আব্বু মারা যাবার পরও আমার মা এবং বোনরা কখনও আব্বুর অভাবটা আমাকে বুঝতে দেয়নি। আমার বোনরাও ততদিনে তাদের পড়াশোনা শেষ করে নিজ নিজ কাজের জায়গায় বেশ ভালো করছে। আসলে মা-বাবা আমার যে পাঁচ বোনকে জন্ম দিয়েছেন, তারা পাঁচজন রত্ন। আমার জীবনে এই পাঁচ রত্নের অবদান এবং তাদের নিজ কর্মক্ষেত্রে সফলতার গল্প লিখতে গেলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। আমার এই পাঁচ বোনের মিউজিক টেস্ট ছিল পাঁচরকম। একেক বোন একেক ধরনের গান শুনত। দেশে এবং দেশের বাইরে প্রচুর শিল্পীর এবং ব্যান্ডের অনেক গান আমি অনেক ছোটবেলাতেই বোনদের কল্যাণে শুনেছি। প্রচুর গল্পের বই এবং কমিক আমার বোনরা কিনে দিয়েছে। আমার দুলাভাইরাও সবসময় পড়ার প্রতি উৎসাহ দিত এবং প্রচুর গল্পের বই কিনে দিত। ছোটবেলায় প্রচুর আঁকতাম। স্কুলজীবনে ছবি এঁকে আর বই পড়ে আমার দিন কেটেছে। আমার মনে হয়, ওই সময়ে চট্টগ্রাম শহরের এমন কোনও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়নি যেখানে আমি অংশ নেইনি এবং পুরস্কার জিতে আসিনি। প্রথম, দ্বিতীয় নয়তো তৃতীয় হতাম সবসময়। কিন্তু কখনওই গানের কোনও প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া হয়নি! আমার স্কুলে প্রিন্সিপালের ঘরের সামনে ‘শিশুশ্রম’ নিয়ে আঁকা একটি পেইন্টিং এখনও ঝোলানো আছে। আমার বোন তানিয়া ইসলাম আমাকে নিয়ে যেত বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায়। সে নিজেও একজন চিত্রশিল্পী। বর্তমানে চট্টগ্রামের খুবই বিখ্যাত একটি মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত আছেন। অনেক শৈশব থেকেই এই বোনের কাছ থেকে প্রচুর ওয়েস্টার্ন মিউজিক শুনেছি। ও প্রচুর ইংরেজি গান শুনত। ছোটবেলায় মিউজিকের প্রতি আমার উৎসাহ দেখে প্রথম কিবোর্ড উপহার দেন মেজো আপু। ওই কিবোর্ড দিয়েই আমার শুরু। ‘সাদা’ আমি ওই কিবোর্ড বাজিয়েই কম্পোজ করেছিলাম। ‘এ মাইনর’ সাদার হোম কর্ড। শুনতে বেশ সহজ মনে হলেও এর কর্ড প্রগ্রেশন অতোটা সহজ না। বাজাতে গেলে বুঝতে পারবেন হয়তো। খুবই চেনা কর্ড, মেজর-মাইনরের বাইরে কিছু নেই, তবে কর্ডগুলোর মধ্যে অনেক ঘোরাফেরা আর ভাঙন আছে।
‘সাদা’ যখন বের হয় তখন আমি ‘উন্মাদ’ পত্রিকায় নিয়মিত কার্টুন আঁকতাম। আমাদের বস বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব। আমি গান লিখতাম স্কেচবুকে! গান লিখে গানের ওপর ভিত্তি করে ছবি এঁকে ফেলতাম ওটার পাশে। বসকে আমার স্কেচবুক দেখিয়েছিলাম। ‘সাদা’ গানটি পড়ে তিনি আমার লেখার প্রশংসা করেছিলেন এবং আরও বেশি বেশি করে লিখতে বলেছিলেন। ‘ডানপিটে’ অ্যালবাম বের হওয়ার অনেক আগেই অ্যালবামের গানগুলো আমি বসকে শুনিয়েছিলাম। তিনি খুব পছন্দ করেছিলেন। ‘ডানপিটে’ বের হওয়ার পর ‘উন্মাদ’-এর অফিসে আমি অ্যালবামের পোস্টার লাগিয়ে এসেছিলাম। বসের রুমের দেয়ালে অনেকদিন সেই পোস্টার লাগানো ছিল। কোটি মানুষের প্রিয় ‘উন্মাদ’-এর অফিসের দেওয়ালে আমার প্রথম একক অ্যালবামের পোস্টার লাগানো! ব্যাপারটা অদ্ভুত ভালো লাগার। ‘উন্মাদ’কে আমি সবসময় আমার দ্বিতীয় পরিবার হিসেবে ভাবি। কার্টুনিস্টদের একটা গ্রুপ আমরা একসাথে কাজ করতাম। এখনও সেই মানুষগুলোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক একই রকম আছে। বন্ধুত্ব ঠিক আগের মতোই অটুট। তাদেরই অনেকজন এখন দেশে এবং দেশের বাইরে বেশ সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। ‘উন্মাদ’ আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমাদের বস আহসান হাবীব আমার জীবনে অন্যতম এক বিশাল অনুপ্রেরণার নাম। এখনও ‘উন্মাদ’-এর সঙ্গে নিয়মিত কাজ করার চেষ্টা করি।
বেশ কিছুদিন আগে একটা ইন্টারভিউতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘সাদা’ ২০০৮ সালে রিলিজ হয়েছিল। এখন ২০১৮। প্রায় দশ বছর আগের গান এখনকার ছেলেমেয়েরাও শুনছে। গানটি পুরনো হয়নি, হারিয়ে যায়নি। এই ব্যাপারটাকে আমি কীভাবে দেখি তা জানতে চাওয়া হয়েছিল।
এ বছরের শুরুতে আমি একটি কনসার্টে গান করেছিলাম। ওখানে যারা দর্শক ছিলেন তাদের সর্বনিম্ন বয়সরেখা ছিল ২৫-৩০। ওই কনসার্টের কিছুদিন পরেই দেশের খুব বিখ্যাত একটি স্কুলে গান গাইতে গেলাম। ওখানে সর্বনিম্ন বয়সরেখা ছিল ১২-১৬! দুটো জায়গাতেই আমি ‘সাদা’ গেয়েছি। এবং দুটো জায়গাতেই ‘সাদা’ প্রথম লাইন গাইবার পর আর বাকি লাইনগুলো গাইতে হয়নি। তারাই গেয়ে দিয়েছে! যেই স্কুলজীবনে আমি ‘সাদা’ বানিয়েছিলাম, সেসময় যারা স্কুল-কলেজে পড়ত, তারা এখন বড় হয়েছে, আস্তে আস্তে পড়াশোনা শেষ করে জীবনযুদ্ধে নেমেছে। সে সময়ে তাদের জীবনের অনেক মুহূর্ত হয়তো ‘সাদা’তে ঘিরে ছিল। আর এখন এই সময়ে যারা স্কুল-কলেজে পড়ছে, তারা যখন গলা মিলিয়ে আমার সাথে কনসার্টে ‘সাদা’ গায়, তখন সেই অনুভূতি আমার কাছে অতুলনীয় হয়ে দেখা দেয়। আর দশ বছর খুব একটা বেশি সময় নয়। এর থেকেও অনেক আগের অনেক প্রিয় শিল্পীদের গান আমাদের হৃদয়ে কালজয়ী হয়ে গেঁথে আছে। থাকবে।
কিছু কথা আমার এখনও মনে আছে। সবসময় থাকবে। তাহসান ভাইয়া ‘সাদা’র ডেমো শুনে বলেছিলেন, ‘মিনার, এমন গান আমি অনেকদিন শুনিনি। দেখো, এই গান সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে যাবে।’ তাহসান ভাইয়ার কথা সত্যি হয়েছে। সেটা আমি কনসার্টে ‘সাদা’ গাইলেই বুঝতে পারি। ‘সাদা’ নিয়ে আমার জীবনে আরও অনেক গল্প আছে। প্রথম গান তো। অনেক ভালো লাগার অনুভূতি এই ‘সাদা’কে ঘিরে। ‘সাদা’র প্রতি মানুষের ভালোবাসা আমাকে সবসময় মুগ্ধ করে। এটা আমার প্রথম অ্যালবামের প্রথম গান। আমার মনে আছে, একদিন দুপুরবেলা ফুয়াদ ভাই ফোন দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন গানটি শুনে। ভালো লেগেছিল খুব।
মিনার রহমান/ ছবি: সাজ্জাদ হোসেন হয়তো ‘সাদা’ ঘুরে বেড়াবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আমি জানি না। হয়তো এমনটা নাও হতে পারে। কিন্তু প্রতিটা মানুষের জীবনে একাকীত্ব আসবেই। কেউ এই একাকীত্বকে ভালোবাসবে, কেউ বাসবে না। কেউ একাকীত্বে ক্লান্ত হয়ে যাবে, কেউ খুঁজে পাবে আনন্দ। কিন্তু ক্ষণিকের এই একাকীত্ব সবার জীবনেই আসবে। আসাটা দরকার। তাই তো আমি সেই ছোট্টবেলায় লিখেছিলাম-
সাদা রঙের স্বপ্নগুলো দিলো না-কো ছুটি
তাই তো আমি বসে একা…
ঘাসফুলেদের সাথে আমি একাই কথা বলি
ঘাসফুলগুলো সব ছন্নছাড়া…    

/এমএম/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
ক্যানসারে আক্রান্ত অভিনেতা রুমি, ভর্তি হাসপাতালে
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)