X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
উঠেছে পঞ্চমীর চাঁদ

ছোট গল্প: মুমু টার্নস ফাইভ

আশনা হাবিব ভাবনা, অভিনেত্রী
১৩ মে ২০১৮, ১১:০৩আপডেট : ১৩ মে ২০১৮, ১৫:৫৩

গত একুশে গ্রন্থ মেলায় প্রকাশ পেয়েছে অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘গুলনেহার’। ভালোই প্রশংসা কুড়িয়েছেন তার সাহিত্যমান দিয়ে। এবার বাংলা ট্রিবিউন এর জন্মদিন উপলক্ষে এন্টারটেইনমেন্ট বিভাগের বিশেষ আয়োজন ‘উঠেছে পঞ্চমীর চাঁদ’-এ তিনি লিখেছেন ছোট গল্প ‘মুমু টার্নস ফাইভ’। 

আশনা হাবিব ভাবনা/ ছবি: সাজ্জাদ হোসেন মালা, বয়স ১৯। দেখতে খুব সুন্দরী।
ওয়েস্টিনের সুইমিংপুলে সাঁতার কাটছে। একপাশ থেকে আরেক পাশে মিনিটের মধ্যেই চলে আসে সে। এরপর ভেসে থাকে অনেকক্ষণ। দূরে তার দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট। একজন ছেলে অন্যজন মেয়ে। এ দুজনই তার দেখাশোনা করে। মা-বাবা দুজনেই থাকেন কুয়েতে। সন্তানের ১৮ বছর হয়ে গেলে আর কুয়েতে থাকতে পারে না। তাই মালা চলে এসেছে ঢাকায়।
যাই হোক, মালা ভেসে আছে পুলে, অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। তাই তারও একই অবস্থা।
মালা বলছে, আই অ্যাম স্যরি মা। আই অ্যাম স্যরি মা। তুমি আমাকে মাফ করে দিবা? আমি জানি, তুমি আমাকে মাফ করে দিবা না।
এবার মালা জোরে চিৎকার করে বলতে থাকে, আই অ্যাম স্যরি মা, আই অ্যাম স্যরি। পুলে তখন যারা ছিল, তারা অবাক। মালার অ্যাসিস্ট্যান্ট দুজন দৌড়ে আসে। বলে, ম্যাম চলুন, ম্যাম চলুন।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ফাতেমা বলে, মালা আপা চলেন, চলেন। বলতে বলতে তাকে পুল থেকে টেনে ধরে তুলে নিয়ে আসে। এই পুরোটা সময় মালা চিৎকার করে কাঁদে আর বলে, আই অ্যাম স্যরি মা, আই অ্যাম স্যরি। মালাকে বাসায় আনা হয়েছে। ফাতেমাকে আরেক অ্যাসিস্ট্যান্ট রাজু বলে, আমি ডাক্তারকে আবার আসতে বলি। তুমি ম্যাডামকে নিয়ে থাকো।
মালা আর ফাতেমা রুমে বসে আছে। মালার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে অঝোরে।
মালা: ফাতেমা আমার ছেলে হতো না মেয়ে? আমার কী মনে হয় জানো? মেয়েই হতো। জানো, আমি শুধু আকাশে তাকালে দেখি একটা নিউবর্ন বেবি হাসছে। বাট আমি দেখতে চাই না ফাতেমা। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। তারপরও দেখি। ফাতেমা আমি মরে যেতে চাই। আমি যদি মরে যাই, তাহলে আমি আমার বাচ্চার কাছে যেতে পারবো। এদিকে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছে রাজু।
ডাক্তার: এখন আমার আর কোনও কাজ নেই। একটা ১৯ বছরের বাচ্চা মেয়ের অ্যাবোরশন হয়েছে, তার এখন কাউনসিলিং দরকার। অনেক কেয়ার দরকার। এরকম আবোল-তাবল বলবেই। খুব নরমাল। তার মা-বাবাকে জানান বিষয়টা।
রাজু: মা তো জানেনই। না এলে আমরা কী করবো বলেন? এরমধ্যে যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, তখন তো পুলিশ আমাদের ধরবে।
ফাতেমাকে নিয়ে বসে আছে মালা। তার মাথায় তেল লাগিয়ে দিচ্ছে। মালা নিথর চোখে তাকিয়ে আছে ফ্যানের দিকে। ফ্যান ঘুরছে। পাখার চক্করে সে যেন দেখতে পায়,  আবারও একটা ফুটফুটে বাচ্চার মুখ।
এরমধ্যে রাজু ফোন করে মালার মাকে।
মালার মা: আমি আজই আসছি। রাজু তোমরা ওর পাশে থাকো।
রাজু যেন দম ফিরে পায়।
মালার চুলে ততক্ষণে বেণি করে দিয়েছে ফাতেমা। মালাকে দেখতে কেমন যেন শুভ্র লাগছে এখন। তার পরনে একটা ছোট হাফপ্যান্ট আর একটা ট্যাংটপ। পুতুলের মতো দেখাচ্ছে তাকে।
মালা: ফাতেমা তুমি চলে যাও। আমি এখন ঘুমাবো। আমার ঘুম পাচ্ছে।
ফাতেমা: আপা আপনি ঘুমান আমি আছি।
ফাতেমা মালার খাটের একপাশে বসে আছে। মালা শুয়ে পড়ে। চট করে বুঝি ঘুমিয়ে পড়ে।
মালার দিকে তাকিয়ে আছে ফাতেমা। তার খুব মায়া হয় ঘুমন্ত মালার মুখটা দেখে। ফাতেমার চোখ ভিজে যায়। কারণ, ফাতেমা মালাকে মেয়ের মতো আদর করে। সে মালার মায়ের কাছে থাকে ছোটবেলা থেকেই। তবে মালার মায়ের বিয়ের পর ফাতেমা গ্রামে ফিরে যায়। আবার যখন মালার মায়ের পেটে মালা আসে, তখন সে ঢাকায় চলে আসে।
মালাকে ভালোবাসে ফাতেমা। ফাতেমাকে মালার মা মোমেনা এত ভালোবাসতো যে নিজের মেয়ের নাম রাখে ফাতেমার দেওয়া নামটাইÑ মালা। ফাতেমা বলেছিলে, খালাম্মা যদি আপনার মেয়ে হয়, তাহলে একটা নাম রাখতে চাই।
মোমেনা অবাক হয়ে বলেন, তাই! কী নাম রাখতে চাও?
ফাতেমা: মালা। আপনের মেয়ে হইলে আমি নাম রাখবো মালা।
মোমেনা: আচ্ছা রেখো।
পরে ফাতেমার কথামতোই মোমেনা তার মেয়ের নাম মালাই রাখেন।
এই কথাগুলো ঘুমন্ত মালার দিকে তাকিয়ে ফাতেমা ভাবছিল এতক্ষণ। রাজু তখন বাসায় ফিরে ফাতেমাকে আস্বস্ত করে, কালকের মধ্যে মালার মা এসে পড়বেন।
মালা ঘুমিয়ে আছে, আর স্বপ্নে চলে গেছে তার মায়ের কাছে।
মালা প্রেগনেন্ট, পেট ফুলেছে। একটা সুন্দর ফ্রক পরে বসে বসে মাসরুমের স্যুপ খাচ্ছে।
মালা: আচ্ছা আম্মু আমার কি মেয়ে হবে?
মা: আমার মনে হয় তোর ছেলে হবে।
মালা: মা, আই ওয়ান্ট এ বেবিগার্ল। ছেলেদের কোনও ভালো ড্রেস নাই, মেয়েদের অনেক সুন্দর সুন্দর ড্রেস।
আম্মু আমার ছবি তোলো তো। দেখি আমাকে কতটুকু বাজে লাগছে।
মালা সুন্দর সুন্দর পোজে ছবি তুলতে থাকে। মালা ঘুমের মধ্যে হাসছে।
পরদিন ভোর
মালার মা এসেছেন। ফাতেমা ও রাজু কিছু বলার আগে মালার ঘরে যান মোমেনা।
মালা পিয়ানো বাজাচ্ছে।
মালাকে জড়িয়ে ধরেন মোমেনা। মালা মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে।
বলে, আম্মু আই কুডনট কিপ মাই বেবি।
মোমেনা: ইউ ডোন্ট হেভ টু আম্মু। যখন সময় আসবে, তখন উই উইল কিপ আওয়ার বেবি। ইউর বেবি উইল মাই বেবি রাইট? ডোন্ট বি সো আপসেট। লাইফ গোজ অন উইদাউট সামওয়ান।
আমি তোমার জন্য কী এনেছি জানো? তোমার প্রিয় বাদাম দেওয়া খেজুর।
মালা কিছুই বলে না।
তোমার জন্য আরও একটা জিনিস আছে। ফ্লোরিডা যাওয়ার টিকিট! তাও তিনটা। তোমার তিন বেস্ট ফ্রেন্ডকে নিয়ে ফ্লোরিডা ঘুরে আসো।
মালা: আম্মু আমি জলি আন্টির সঙ্গে কথা বলতে চাই।
মোমেনা: ওকে। তাহলে রেডি হও। আমি নিয়ে যাবো।
জলি একজন সাইকোলজিস্ট (মানসিক রোগের চিকিৎসক), মোমেনার বান্ধবী।
জলি আন্টির চেম্বারে মালা ও মোমেনা।
জলি: মালা ইউ লুক সো প্রিটি।
মালা: আন্টি আই নিড ইউর হেল্প। আমি ওই সব মেয়ের মতো বয়ফ্রেন্ড চিট করলে মরে যেতে চাই না। বাট আই ওয়ান্ট মাই বেবি ব্যাক।
জলি: মালা তুমি এখনও অনেক ছোট। তোমার বেবি নেওয়ার বয়স হয়নি। তুমি নিজেও এখনও বেবি।
বলতে বলতে মালার ফোনে কল আসে। সে আজ ফোন অন করেছে। কল করেছে মালার বয়ফ্রেন্ড ফয়সাল। যে মালাকে জোর করে প্রেমে ফেলেছে, ভালোবেসেছে। জোর করে অ্যাবোরশনও করিয়েছে।
মালা ফোনটা কেটে দিয়ে ব্লক করে দেয়।
আশনা হাবিব ভাবনা/ ছবি: সাজ্জাদ হোসেন মালা: আম্মু ফয়সাল ফোন করেছিল। আমি বøক করে দিলাম। কারণ ও আমাকে ভালোবাসে না।
মোমেনা চুপ করে আছেন। কিছু করার নেই তার। মেয়েকে সময় দিতে পারেননি তিনি। এসব ভেবে এখন তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। তবে মেয়ের সামনে তিনি শক্ত থাকবেন পাথরের মতো।
জলি: মালা সে তোমাকে ভালোবাসে না, কথাটা ভুল। সে তোমাকে রেসপেক্ট করে না। আর যে ছেলে তোমাকে রেসপেক্ট করে না, সে তোমার জীবনে না থাকাই ভালো। যাই হোক, তোমার কী ইচ্ছে করে বলো তো?
মালা: আমার একা একা কথা বলতে ইচ্ছা করে আমার বেবির সঙ্গে।
জলি: বলবে, কোনও সমস্যা নেই।
মালা: আচ্ছা আন্টি এটা কোনও ডক্টর বলতে পারবে ইট ওয়াজ এ গার্ল অর এ বয়? নয় সপ্তাহ ছিল বেবিটা। তারপরও বোঝা যায় না অ্যাবোরশনের সময়?
জলি তাকিয়ে থাকে একটা ছোট্ট মায়ের দিকে। জলি বানিয়ে বলে, তোমার বেবিটা মেয়ে ছিল মা।
মালা: সত্যি!
মালা যেন দেখতে পেলো তার ছোট্ট মেয়েটাকে।
মালা: আমি আমার মেয়ের নাম রাখবো। আচ্ছা মা আমার নাম কে রেখেছিলো?
মোমেনা: ফাতেমা রেখেছিল।
মালা: তুমি এই কথা এতদিন বলোনি কেন! আজ কত তারিখ?
মোমেনা: ৫ তারিখ।
মালা: ওকে। তাহলে আজই আমার মেয়ের বার্থ ডে ঠিক করলাম। যেদিন অ্যাবোরশন হয়েছে, সেদিন আমার মন খারাপ ছিল। আর আমি তো আজ জানলাম, আমার মেয়ে ছিল। তাই ওর বার্থ ডে হলো ০৫-০৮-২০১০। আর আমার নাম যখন ফাতেমা রেখেছে, আমার মেয়ের নামও সে-ই রাখবে।
মোমেনা ও জলি দুজনই মালাকে সায় দেয়।
মালা খুশিতে বাড়ি আসে। ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরে।
ফাতেমা জানো, আমার মেয়ে ছিল? তুমি এখন আমার মেয়ের নাম ঠিক করো। আমার নামটা যেমন রেখেছো।
ফাতেমা: কালকে বলি।
মালা: না না এখনই বলতে হবে। বলো বলো।
ফাতেমা: মুমু। মুমু রাখবেন।
মালা: তুমি যা বলবে, তা-ই। মুমু। মালার মেয়ে মুমু।
মালা খুব খুশি। খুশি হলে সে তার শখের লাল রঙের একটা ছাদখোলা গাড়ি চালায়। মালা গান শুনছে আর গাড়ি চালাচ্ছে। ভীষণ খুশি হয়ে সে বারবার আকাশের দিকে তাকায়। সে তার বাচ্চার চেহারা দেখে, তবে এখন আর সেটা দেখে তার মন খারাপ হয় না। মেঘের ভাঁজে বাচ্চাটা মিলিয়ে যায়, মালা খুঁজতে থাকে মুমুকে। আকাশে মুমুকে খুঁজতে গিয়ে ফ্লাইওভার থেকে মালার গাড়িটা নিচে পড়ে যায়। চুরমার হয়ে যায়।
মালা যেন কোথায় ছিল, কোথায় আছে। মালা এখনও খুঁজছে মুমুকে মেঘের দলে।
মালা আর মুমু। মুমুর জন্মদিনের তার কাছে চলে গেলো মালা।
৫ বছর পর...
ফাতেমা প্রায় পাগল। তার ধারণা, মালার গাড়ি অ্যাকসিডেন্টের জন্য সে দায়ী। সে যদি তখনই নামটা না বলতো মালা খুশি হতো না। আর পাগলের মতো গাড়িও চালাতো না। তবে সেই একই দিনে ফাতেমা কেক কাটছে। ফাতেমা একা একা বলছে, মুমুর আজ পাঁচ বছর হলো। কেকের ওপরে লেখা, ‘মুমু টার্নস ফাইভ’।
মালার প্রেম বয়ে বেড়াচ্ছে ফাতেমা। শুধু জীবিত মানুষগুলোকে ভালোবাসতে হবে, এমন তো কথা নেই।
তবে জীবন সুন্দর।

/এমএম/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
১৬ বছর পর জেনস সুমনের ফেরা (ভিডিও)
১৬ বছর পর জেনস সুমনের ফেরা (ভিডিও)
মা হারালেন বেবী নাজনীন
মা হারালেন বেবী নাজনীন
ওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
সিনেমা সমালোচনাওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার