চলচ্চিত্রের ‘মক্কা’ কানে পা রাখতেই চোখে পড়েছে ফরাসি নারী নির্মাতা আনিয়েস ভারদা শুটিং করছেন! দক্ষিণ ফ্রান্সের উপকূলবর্তী রাস্তাঘাট, সড়ক বিভাজকের গাছ, বাড়ির দেয়াল, হোটেলের লবি, ফ্যাশন হাউসের শোরুম, বাসস্ট্যান্ডসহ সবখানে এখন তার তারুণ্যের ছবি!
কান উৎসবের ৭২তম আসরের অফিসিয়াল পোস্টারের কথা বলছি। এর মাধ্যমে আনিয়েস ভারদার প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন আয়োজকরা। গত মার্চে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাকে এ প্রজন্মের অনেকেই চেনে না। লাইমলাইটে না থাকার পরও মৌলিক চলচ্চিত্র নির্মাণে আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন তিনি।
উৎসবের প্রাণকেন্দ্র পালে দে ফেস্তিভাল ভবনের বহির্ভাগের তিনটি অংশে একটি করে বিশাল আকারের পোস্টার টানানো হয়েছে রবিবার (১২ মে) দুপুরে। এজন্য লেগেছে কয়েক ঘণ্টা। ভবনের একপাশে গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়ের, অন্য পাশে দুবুসি থিয়েটার। আর মাঝে মূল ফটক। পোস্টার তিনটি টানানোর পরই উৎসুক অনেকে মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় এগুলোর ছবি তুললেন।
পোস্টারে দেখা যাচ্ছে, উজ্জ্বল সূর্যকিরণ ছড়িয়ে পড়েছে আনিয়েস ভারদার মুখে। একজন টেকনিশিয়ানের কাঁধে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় চোখ রেখেছেন তিনি। ছবিটি ১৯৫৪ সালের আগস্টে তোলেন ফরাসি অভিনেতা ও মঞ্চ নির্দেশক জ্যঁ ভিয়ার থিয়েটার ন্যাশনাল পপুলেয়ারের একজন আলোকচিত্রী। তখন আনিয়েস ভারদার বয়স ২৬ বছর। পরিচালক হিসেবে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলেন তিনি। দক্ষিণ ফ্রান্সের সেতে ‘শর্ট পয়েন্ট’ নামের ছবিটির শুটিং হয়। সেটে তোলা পুরনো স্থিরচিত্রে আনিয়েস ভারদার আবেগ, আত্মবিশ্বাস ও মজার স্বভাব ফুটে উঠেছে। ৬৫ বছরের বর্ণাঢ্য সৃজনশীল ও নিরীক্ষাধর্মী ক্যারিয়ারে কান উৎসবের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল নিবিড়। অফিসিয়াল সিলেকশনে ১৩ বার স্থান পেয়েছেন তিনি।
২০০৫ সালে বিচারক প্যানেলে ছিলেন গুণী এই নারী নির্মাতা। ২০১৩ সালে ক্যামেরা দ’র বিভাগের জুরি সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। ২০১৫ সালে সম্মানসূচক পাম দ’র পান তিনি। আয়োজকদের কথায়, অফিসিয়াল পোস্টারের মাধ্যমে এবারের আসরে অনুপ্রেরণাদায়ক পথনির্দেশক হিসেবে কানসৈকতে আলো ছড়াবেন আনিয়েস ভারদা। এটি সাজিয়েছেন নারী গ্রাফিক্স ডিজাইনার ফ্লোরে মাকিন।
সাগরপাড়ের শহরটিকে প্রতি বছরের মে মাসে চঞ্চল করে দেয় কান উৎসব। সিনেমার প্রতি এখানকার মানুষের আবেগ-অনুরাগ চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের রাত পোহালেই (১৪ মে) তামাম দুনিয়ার চলচ্চিত্রানুরাগীদের মিলনমেলায় পরিণত হবে সেলুলয়েডের এই তীর্থস্থান। উৎসবের জৌলুস ছড়িয়ে পড়বে সবখানে।
বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদকের ক্যামেরায় উৎসবের প্রাণকেন্দ্র পালে দে ফেস্তিভালের চারপাশ:
বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন এই আয়োজনকে ঘিরে বিভিন্ন দেশের রথী-মহারথীরা হাজির হচ্ছেন কানসৈকতে। সবার অংশগ্রহণে মুখর হয়ে উঠবে দক্ষিণ ফরাসি উপকূলের শহর। সবাইকে স্বাগত জানাতে এখন প্রস্তুত হচ্ছেন আয়োজকরা।
এদিকে ঢাকা থেকে কানে পা রাখতে না রাখতেই আয়োজকরা নতুন তিনটি খবর দিলেন ইমেইলে। এবারের আসরে পালে দে ফেস্তিভাল ভবনের বুনুয়েল থিয়েটারে উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের মিলবে চার বিখ্যাত মানুষের রদেভুঁ অর্থাৎ অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এই আয়োজনে নিজেদের কাজ ও ক্যারিয়ার নিয়ে মাস্টারক্লাসে অংশ নেবেন তারা।
ডেনিশ নির্মাতা নিকোলাস উইন্ডং রেফন আগামী ১৮ মে বিকাল ৪টায় হাজির হবেন। ২০১১ সালে ‘ড্রাইভ’ ছবির জন্য কানে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পান তিনি। এবারের আসরে দেখানো হবে অ্যামাজন প্রযোজিত ‘টু ওল্ড টু ডাই ইয়াং’ সিরিজের দুটি পর্ব।
বর্ষীয়ান ফরাসি অভিনেতা আলা দ্যুলোর মাস্টারক্লাস হবে আগামী ১৯ মে সকাল ১১টায়। ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তাকে দেওয়া হবে সম্মানসূচক পাম দ’র। এরপর দুবুসি মিলনায়তনে তিনি উপস্থাপন করবেন নিজের অভিনীত জোসেফ লসির ‘মিস্টার ক্লেইন’ ছবির পুনরুদ্ধার করা প্রিন্ট। ১৯৬৩ সালে স্বর্ণ পাম জয়ী লুচিনো ভিসকন্তির ‘দ্য লিওপার্ড’ ছবিতে অভিনয় করেন আলা দ্যুলো। তার ধ্রুপদী ছবি ‘দ্য প্রফেসর’ (১৯৭২) কান ক্ল্যাসিকসে ও ‘অ্যানি নাম্বার ক্যান উইন’ (১৯৬৩) আগামী ১৮ মে দেখানো হবে সিনেমা ডি লা প্লাজে।
চীনা অভিনেত্রী জ্যাঙ জিয়ি হাজির হবেন আগামী ২২ মে বিকাল সাড়ে ৪টায়। কুড়ি বছরের ক্যারিয়ারে তার ঝুলিতে আছে জ্যাঙ ইমুর ‘দ্য রেড হোম’ (১৯৯৯), ‘হিরো’ (২০০২) ও কানের আউট অব কম্পিটিশনে থাকা ‘হাউস অব ফ্লাইং ড্যাগারস’ (২০০৪),আউট অব কম্পিটিশনে প্রদর্শিত অ্যাঙ লি’র ‘ক্রাউচিং টাইগার, হিডেন ড্রাগন’ (২০০০), কানের প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত ওঙ কার-ওয়াই পরিচালিত ‘২০৪৬’ (২০০৪) ও ‘দ্য গ্র্যান্ডমাস্টার’ (২০১৩), প্রতিযোগিতা বিভাগে স্থান পাওয়া লু ই’র ‘পারপল বাটারফ্লাই’ (২০০৩), রব মার্শালের ‘মেমোয়ার্স অব অ্যা গেইশা’ (২০০৫), জিন ইমেঙের ‘সোফিস রিভেঞ্জ’ (২০০৯) প্রভৃতি।
২০০৬ সালে কানের মূল প্রতিযোগিতা ও ২০০৯ সালে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সিনেফঁদাসো বিভাগের বিচারক প্যানেলে রাখা হয় তাকে। আগামী ২১ মে রাত সাড়ে ৯টায় সিনেমা ডি লা প্লাজে ‘ক্রাউচিং টাইগার, হিডেন ড্রাগন’ ছবিটি উপস্থাপন করবেন তিনি।
আগামী ২৪ মে বিকাল ৪টায় মাস্টারক্লাসে আসবেন মার্কিন অভিনেতা-নির্মাতা সিলভেস্টার স্ট্যালোন। ওইদিন সকাল সাড়ে ১০টায় নিজের নতুন ছবি ‘র্যাম্বো ফাইভ-লাস্ট ব্লাড’-এর প্রথম টিজার উপস্থাপন করবেন তিনি। এরপর দেখানো হবে ‘র্যাম্বো: ফার্স্ট ব্লাড’-এর পুনরুদ্ধার করা ফোরকে প্রিন্ট। রকি চরিত্রের মাধ্যমে সিনেমার কিংবদন্তিদের দুনিয়ায় নিজেকে নিয়ে গেছেন স্ট্যালোন। তার প্রথম ছবি ‘প্যারাডাইস ভ্যালি’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। পরিচালক আর চিত্রনাট্যকার হিসেবে সুনাম আছে তার। ধ্রুপদী কিছু ছবিতে পরিপূর্ণ নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অজানা অনেক গল্প করবেন তিনি। ১৯৯৩ সালে কানের স্পেশাল সেশনে ছিল তার ‘ক্লিফহ্যাঙ্গার’। ২০১৪ সালে কান ক্ল্যাসিকসে নির্বাচিত ‘দ্য গো-গো বয়েজ: দ্য ইনসাইড স্টোরি অব ক্যানন ফিল্মস’ প্রামাণ্যচিত্রে দেখা গেছে তাকে।
আরেক ই-মেইলে আয়োজকরা জানান, সোমবার (১৩ মে) বিকাল পৌনে ৩টায় পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের তৃতীয়তলায় সংবাদ সম্মেলন কক্ষে রয়েছে উৎসবের পরিচালক থিয়েরি ফ্রেমোর ‘মিটিং উইথ দ্য প্রেস’। গত আসরেও উৎসব শুরুর আগে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি।
আমেরিকান নির্মাতা জিম জারমাশের ‘দ্য ডেড ডোন্ট ডাই’ ছবির প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে পর্দা উঠবে কানের ৭২তম আসরের। এটিসহ মোট ২১টি ছবি এবার কানের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাম দ’রের জন্য লড়বে। ১২ দিনের এই আয়োজন চলবে ২৫ মে পর্যন্ত। এবারের প্রতিযোগিতা বিভাগের প্রধান বিচারক টানা দু’বার অস্কারের সেরা পরিচালক আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজ ইনারিতু। আগামী ২৫ মে তার নেতৃত্বে ঘোষণা করা হবে স্বর্ণ পাম জয়ী ছবির নাম। গতবারের মতো এবারের আসরের মাস্টার অব সিরিমনিস অর্থাৎ উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের দায়িত্বে থাকছেন ৫১ বছর বয়সী ফরাসি অভিনেতা এদুয়ার্দ বেয়া। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে আরও দু’বার এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
বছরের সবচেয়ে ঝলমলে উৎসব কানে হলিউডের প্রথম সারির তারকারা ঝাঁক বেঁধে আসেন। ইতোমধ্যে চলে এসেছেন পামেলা অ্যান্ডারসন। স্বামী মার্কো পেরেগোকে নিয়ে এসেছেন ‘গার্ডিয়ান্স অব দ্য গ্যালাক্সি’ তারকা জোয়ি স্যালডানা।
এদিকে এবারের আসরের প্রচারণার অংশ হিসেবে সাজানো ট্রেলারে দেখা যাচ্ছে ৭১তম কান উৎসবের উল্লেখযোগ্য মুহূর্তগুলো। লালগালিচায় তারকাদের বাহারি পোশাক ও প্রাণচাঞ্চল্য, ফটোকল, সংবাদ সম্মেলন ও গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে বিভিন্ন ছবির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারের মনে রাখার মতো কিছু ঘটনার একঝলক। এতে কানের শৈল্পিক আবহের পাশাপাশি উঠে এসেছে জৌলুস। সবশেষে বলা হয়েছে, ‘এনজয় সিনেমা’, অর্থাৎ সিনেমা উপভোগ করুন।
ছবি: প্রতিবেদক