X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের নাটক: যেখানে ‘ঈদ’ বলে কিছু নেই!

ওয়ালিউল বিশ্বাস
১৩ জুন ২০১৯, ১৪:৪৫আপডেট : ১৪ জুন ২০১৯, ১৪:৫৭

এই ঈদে জুটি হয়ে সর্বাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন তারা চারজন ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের প্রায় ২০টি টিভি চ্যানেল নিয়মিতই তাদের অনুষ্ঠানসূচি সাজায়। এবারের ঈদুল ফিতরেও তিন শতাধিক নাটক ও টেলিছবি প্রচার করেছে বিনোদননির্ভর এ চ্যানেলগুলো। কিন্তু নামে ঈদের নাটক হলেও সেখানে ঈদ বলে কিছুই ছিল না! একই চিত্র মুক্তি পাওয়া তিনটি সিনেমাতেও, যা সত্যিই বিস্ময়কর।

কোনও উৎসব কিংবা বিশেষ দিনকে ঘিরে নির্মিত নাটক-সিনেমায় সেসবের ছাপ থাকবে না, দেশ অথবা বিদেশে এমন নজির খুব কমই আছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশের দুই ঈদের জন্য নির্মিত নাটক-টেলিছবি, গান ও চলচ্চিত্র।

এবারের টেলিভিশন ঈদ আয়োজন থেকে বাংলা ট্রিবিউনের বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানে এমন চিত্রই উঠে এসেছে। ব্যতিক্রম শুধু সকাল আহমেদের পরিচালনায় ৭ পর্বের ধারাবাহিক নাটক ‘ঈদ বোনাস’। টিপু আলম মিলনের গল্প ভাবনায় এটি রচনা করেছেন মীর্জা রাকিব। এতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাকিয়া বারী মম, আনিসুর রহমান মিলন, স্বাগতা, নাসিম, মুনিয়া, তানভির প্রমুখ। বৈশাখী টিভিতে প্রচার হওয়া এই ধারাবাহিকটির পুরোটাই নির্মিত হয়েছে রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে।
এবারের উৎসবে সবচেয়ে বেশি ৪০টি নাটক ও টেলিছবি প্রচার করেছে স্যাটেলাইট চ্যানেল বাংলাভিশন। এরমধ্যে রয়েছে ৭ পর্বের ৫টি ধারাবাহিক, ২৯টি একক নাটক ও ৬টি টেলিছবি।
চ্যানেলটির ‘আরমান ভাই’ সিরিজের একটি পর্বে শুধু ‌‘ঈদ’ শব্দটি একবার এসেছে! ‘সামনে ঈদ, অনেক সালামি দিতে হইব’- এমন একটি বাক্য পাওয়া যায় এর অভিনেতার মুখে। এছাড়া গল্প তো দূরের বিষয়, আর কোথায় ঈদ সংশ্লিষ্ট কিছু পাওয়া যায়নি। অথচ গেল কয়েক বছর ধরে প্রতি ঈদেই জনপ্রিয় এই নাটকটির সিক্যুয়েল নির্মিত ও প্রচারিত হয়ে আসছে।
প্রায় ২০টি চ্যানেলের নাটকের রিভিউ ও বিশ্লেষণ শেষে এমন আরও কয়েকটি নাটকের নাম এসেছে, যেখানে সংলাপে একবার করে ‘ঈদ’ বা ‘রোজা’ শব্দগুলো এসেছে। এরমধ্যে মাবরুর রশীদ বান্নাহ’র ‘লেডি কিলার’-এ রোজা নিয়ে একটি বাক্য আছে। যেখানে তিশা বলছে, রোজায় এতিমদের খাওয়ানোর বিষয়ে। হানিফ সংকেত পরিচালিত ‘ভুল ভাঙ্গাতে ভুল’ শিরোনামের নাটকে ‘সামনে ঈদ আসছে, দাম একটু বাড়বেই’ সংলাপটি রাখা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই ঈদকেন্দ্রিক গল্পে নির্মাণ নয়।
সর্বাধিক নাটক নির্মাণ করা বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান তারেক আখন্দ বলেন, ‘বছরের বড় বড় ও ভালো কাজের জন্য নির্মাতারা যেমন অপেক্ষা করেন, তেমনি তাদের কাজগুলোর জন্য আমরা অপেক্ষা করি। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন আমাদের চ্যানেল দেখেন। তাই সব ধরনের ভালো কাজগুলো নেওয়ার চেষ্টা করি।’
আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ঈদ উৎসব। ধারাবাহিকসহ এবারের ৪০টি নাটকের মধ্যে কি ঈদ-কেন্দ্রিক কোনও গল্প আছে- এমন প্রশ্নে তিনি যোগ করেন, ‘ঈদ-কেন্দ্রিক নাটকের যে ধারণা ছিল, তা কিন্তু এখন আর নেই। গত কয়েক বছরের নাটকগুলো যদি দেখেন, লক্ষ করবেন, এমন কোনও নাটক নেই। এখন ঈদ উৎসবটা হলো বড় প্ল্যাটফর্ম; ভালো কাজ দেখানোর। আমরা সেটাই চেষ্টা করি। নির্মাতারা ভালো বাজেটে ভালো কিছু নাটক তৈরি করেন। আমরাও সেভাবে ঈদের সূচি সাজিয়েছি।’
তবে নির্মাতা ও চ্যানেলগুলো শুধু ভালো গল্প ও বাজেটকেই প্রাধান্য দেননি। এবারের আয়োজনে ঈদ না থাকলেও অন্য উৎসবকে মাথায় রেখেছেন ঠিকই। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে বেশ কিছু নাটক ও গান। এর অন্যতম হিসেবে আলোচিত হয় রেজানুর রহমানের ‘বাইশ গজের ভালোবাসা’ নামের নাটকটি। আর গানের সংখ্যা তো ডজন পেরিয়েছে।
বেশ কিছু চ্যানেলে ঈদের গল্পকেন্দ্রিক নাটক না হলেও ঈদের জন্য নির্মিত নাটকের সিক্যুয়েল প্রচার করে আসছে। এগুলোর মধ্যে আছে ‘আরমান ভাই’, ‘যমজ’, ‘প্যারা’, ‘এক্স’, ‘ব্রেক ফেইল’, ‘মেইড ইন ফরেন’, ‘বউয়ের দোয়া’, ‘অ্যান্টিভাইরাস’ প্রভৃতি।
এবারের ঈদে আরটিভি তাদের ‘যমজ’ নাটকের ১১তম সিক্যুয়েল প্রচার করেছে। ছিল তাদের ‘প্যারা’ নামের নাটকের সিক্যুয়েলও। অথচ এর কোথাও নেই ঈদের বিষয়।
চ্যানেলটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আশিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘দর্শকরা হয়তো কোনও নাটক ভালো লাগল, তারা তখন এ রকমেরই আরও ভালো কাজ দেখার জন্য অপেক্ষা করেন। তাই সেভাবে নির্মাণ হয়। ঈদ বলেই তো শুধু জোর করে হাসালে হবে না, ভালো মেসেজ বা গল্প থাকতে হবে। ঈদের গল্প নিয়ে নাটক না থাকলেও ঈদকে কেন্দ্র করে আমরা ভালো গল্পের নাটক তৈরি করি। বেশ কিছু সিক্যুয়েল আমরা তৈরি করি। যেমন ‘যমজ’। এখানে ভালো মেসেজও রাখা হয়।’’
অনুসন্ধানে দেখা যায়, টিভি চ্যানেলগুলো নাটক তৈরি করার বাইরে বেশ কিছু এজেন্সির কাছে থেকে তৈরি নাটক কেনে। তখন শুধু গল্প নয়, অনেক ক্ষেত্রেই পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীর ‘ফেসভ্যালু’ প্রাধান্য দেওয়া হয়। আবার নির্মাতারা বড় তারকার পাশাপাশি ইউটিউব ভিউকে মাথায় রাখেন। যেন টিভির পর ইউটিউবে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি হয়। আর ভিডিও শেয়ারিংয়ের এই সাইটে নাটক প্রদর্শনের সুযোগ থাকে সারা বছর। সে কারণে তখন ‘ঈদটা’ গৌণ হয়ে পড়ে। গুরুত্ব পায় অভিনয়শিল্পী ও চটকদার সংলাপ।
আবার নাটকের গল্প লেখাতে থাকে না অভিনয়শিল্পীদের কোনও প্রভাব। অনেকটা তৈরি গল্প তাদের শুনে কাজে নেমে পড়তে হয়।
এবারের ঈদে সর্বাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন তরুণ অভিনেত্রী তানজিন তিশা। তার কাছে আসা কাজের ধরনগুলো প্রসঙ্গে ঈদের আগে জানতে চাওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘ঠিক ধারণা নেই, এবার ঈদে আমার কতগুলো নাটক? ২৫টির মতো হবে। গল্প দেখে নাটককে প্রাধান্য দেই। এর বাইরে তেমন কিছু এবার ভাবার সুযোগ ছিল না। এবারের বেশিরভাগ নাটকই ছিল রোমান্টিক ধরনের।’
বিটিভিতে একসময়ে ঈদের গল্প নিয়ে নাটক নির্মাণ হতো। নওয়াজীশ আলী খান, হুমায়ূন আহমেদ, আমজাদ হোসেনরা নিয়মিতই এ ধরনের নাটক তৈরি করতেন। হানিফ সংকেতের নাটকেও ঈদ থাকতো নিয়মিত।
একক নাটকের পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদের সিক্যুয়েলেও ঈদ এসেছে। আমজাদ হোসেন ‘জব্বর আলী’ নিয়ে প্রতি ঈদে ফিরে আসতেন।
এই ধারাবাহিকতার কেন ছেদ পড়ল? জানতে চাওয়া হয়েছিল এবারের ঈদে ৭টি নাটক প্রচার হওয়া জনপ্রিয় পরিচালক কাজল আরেফিন অমির কাছে। তিনি বললেন, ‘একজন পরিচালকের পক্ষে সব ধরনের নাটক নির্মাণ করা সম্ভব নয়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে আমি এটাই বলবো। আমি যে গল্পগুলো ভালোভাবে ডিল করতে পারবো আমি সেগুলোকে নিয়েই কাজ করি। তবে এটা ঠিক, ঈদের নাটকগুলোতে ঈদ থাকছে না। সামাজিকভাবে এটা আমাদের সবার ব্যর্থতা। এটা আমাদের বেড়ে ওঠার ব্যর্থতা। আমরা ছোটবেলায় এমন গুণীদের কাজ দেখে আসছি। কিন্তু আমরা নিজেরা বোধহয় সেই বিষয়টি ধারণ করতে পারিনি। আমরা যখন একটা গল্প ভাবার চেষ্টা করি, তখন আমরা এ জায়গাটায় ঢুকতে পারিনি। প্রচুর রোমান্টিক নাটক করছি। আমরা ট্রেন্ডের দিকে ছুটছি। কিন্তু আমরা তাদের (পূর্বসূরি) মতো করে ভাবছি না, বা পারছি না। মাসব্যাপী রোজা, ঈদের নানা ইভেন্ট হয়। কিন্তু আমরা গল্প ভাবতে পারছি না। এই ভাবতে না পারাটা আমাদের সবার (দর্শক, শিল্পী, নির্মাতা) ব্যর্থতা। তবে ভাবা উচিত।’
বেশ কয়েক বছর ধরে দর্শকের অভিযোগ, নাটকের গল্প গৎবাঁধা। একই অভিনয় শিল্পীরা প্রায়ই একই ধরনের নাটক নিয়ে হাজির হন। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের নাটকে বুঁদ হয়ে আছেন দর্শকরা।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে দু’একজন দর্শকের সঙ্গে কথা বলা হয়।
মুস্তাফিজুর রহমান নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলেন, ‘এটার অনেকটাই দায় নির্মাতাদের ওপর। পার্শ্ববর্তী দেশের নাটকে দর্শকরা কেন যাবে না? তারা নাটকের গল্প, দর্শক মানসিকতা ও চলমান ইস্যুকে প্রাধান্য দেন। দেখবেন, অনেক পুরনো ধারাবাহিকে হোলি বা পূজার সময় বিশেষ পর্ব ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য থাকে নাটকে ইস্যুটা নিয়ে আসা। দর্শকের মানসিক পরিস্থিতিও নাটকের সঙ্গে একাত্মতা করে দেওয়া হয়। সুতরাং আমাদের দেশের নির্মাণে ভাবনা ও আন্তরিকতার জায়গাটা পরিপূর্ণ হতে হবে।’

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
কানে আবার আমন্ত্রিত ঢাকার ঋতি
কানে আবার আমন্ত্রিত ঢাকার ঋতি
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
মনে হয়নি দেশের বাইরে আছি: যুক্তরাষ্ট্র থেকে পার্থ 
মনে হয়নি দেশের বাইরে আছি: যুক্তরাষ্ট্র থেকে পার্থ 
কাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
সিনেমা সমালোচনাকাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
সম্প্রচারের দুই দশকে...
সম্প্রচারের দুই দশকে...