বাংলাদেশে নির্মিত সাহিত্যনির্ভর অধিকাংশ ছবিই কুড়িয়েছে প্রশংসা। বিশেষ করে নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বরাবরই চেষ্টা করেছেন দর্শকের সামনে সাহিত্যনির্ভর ছবি হাজির করার। যে বাজারে চলে ভারতীয় কপি-পেস্টের চর্চা, সেখানে সাহিত্য থেকে নিজেদের গল্পকে ছবিতে প্রাণ দেন হাতেগোনা কয়েকজন। সে তালিকায় প্রথমদিকের একজন মোরশেদুল ইসলাম।

সম্প্রতি তার পরিচালিত ‘অনিল বাগচীর একদিন’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। এটি নন্দিত সাহিত্যিক-নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি। উপন্যাস থেকে তুলে রূপালি পর্দায় ‘অনিল’ চরিত্রটিকে পুনরায় প্রাণ দিতে শতভাগ সফল হয়েছেন মোরশেদুল ইসলাম।

অনিল বাগচী চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন আরেফ সৈয়দ

ক. হুমায়ূন আহমেদ তার উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে নির্মাণ করেন আপন দক্ষতায়। তার নির্মিত চরিত্র যে কোনও মানুষের কল্পনাজগতে জ্যন্ত হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। এজন্যই হুমায়ূন আহমেদ অনন্য। এজন্যই তার চরিত্রকে ছবির ফ্রেমে তুলে ধরা অনেকটাই চ্যালেঞ্জের। মোরশেদুল ইসলাম এমন চ্যালেঞ্জ বহুবার নিয়েছেন।

অনিল বাগচী একজন ভীতু যুবক। এই যুবকের গল্পটি কীভাবে রূপালি পর্দায় উপস্থাপিত হয় সেটাই দেখার বিষয় ছিল। গ্রামের ছেলে শহরে এসে এক ইন্সুরেন্স প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। এসময়ই দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এমন দমবন্ধ সময়ে কি করে অনিলের সময় কাটে সেসবই উঠে আসে ছবিতে।

ভাই-বোন অনিল-জ্যোতি

এই উত্তাল সময়ে অনিল শুধু তার বাবার সঙ্গে কাটানো কৈশরের স্মৃতি আওড়ায়। ফেলে আসা ঘটনাগুলোকে কল্পনা জগতে নিয়ে এসে সময় পার করে। অতঙ্ক থেকে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে অনিল। এজন্যই হয়তো বাবা এবং বড় বোনকে নিয়ে সময় কাটানোর স্মৃতি আকড়ে ধরে কিছুটা সাহস জোগানোর চেষ্টা করে যায় অনিল। এসবের মধ্যে একদিন চিঠি আসে। সে জানতে পারে তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। চিঠিটি লিখেছেন রুপেশ্বর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি চিঠিতে এও জানান, তার বোন অতশী প্রধান শিক্ষকের বাসাতেই আছেন। অনিলের মন আর টেকে না। সে রওনা দেয় গ্রামের পথে। সেই পথেই নানান ঘটনার মধ্যে দিয়ে ‘অনিল বাগচীর একদিনে’র সমাপ্তি ঘটে।

খ. মোরশেদুল ইসলাম এই ছবিটি নিয়ে সর্বোচ্চ এক্সপেরিমেন্ট করেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। ক্যামেরার কাজ থেকে শুরু করে সম্পাদনার টেবিলেও ছাড় দেননি। পর্দায় ছবিটি দেখে অন্তত তাই মনে হয়েছে। যেমন, সাধারণ মানুষের কল্পনার জগৎ হয় সাদাকালো আর বাস্তবতা হয় রঙিন। অথচ এই ছবিতে বর্তমান ছিল ধূসর সাদাকালো এবং অতীত কিংবা স্মৃতিগুলো ছিল একদম রঙিন! এই ব্যাখ্যা অনেকটাই স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো ছিল ধূসর। মানুষের মনে কোনও রঙ ছিল না। এই দেশে কোনও রঙ ছিল না। মানুষের মনের সব রঙ উবে গিয়েছিল সেই ক্রান্তিকালে। সেই উবে যাওয়া রঙের ভেতর স্মৃতির পাতাই যেন রঙিন ছিল। এমন এক বাস্তব সত্যকে এডিটিংয়ের মাধ্যমে তুলে আনার বিষয়টি ছিল দুর্দান্ত এবং প্রথাবিরুদ্ধ।

আইয়ুব আলী চরিত্রে গাজী রাকায়েত এবং অনিল বাগচী আরেফ সৈয়দ

গ. অনিল যখন রুপেশ্বর গ্রামে এক অনিশ্চিত যাত্রা ‍শুরু করে। তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয় আইয়ুব আলীর সঙ্গে। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন গাজী রাকায়েত। এই অভিনেতা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষকে হাসিয়েছেন এবং কাঁদিয়েছেন। ওই ধূসর সময়ে, সময়ের এক ক্রান্তি লগ্নে মানুষ কী করে মানুষকে ভালোবেসে ফেলে, কি করে আপন করে নেয়- সেই চিত্রই উঠে এসেছে এই চরিত্রটির মধ্যদিয়ে।

ঘ. যুদ্ধ মানেই অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ নয়। যুদ্ধের অনেক ধরন থাকে। যুদ্ধকে মেনে নিয়ে জীবন চালিয়ে যাওয়াও একরকম যুদ্ধ। মানুষের বিসর্জন দেওয়াও এক যুদ্ধ। এই যে অনিল তার বাবাকে হারালো। এই হারানোর বেদনার মধ্যেও লুকিয়ে আছে যুদ্ধ। অনিলের কাছে যখন এক বিদেশি সাংবাদিক দেশের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চায় তখন সে পাকিস্তানি মিলিটারিদের সামনেই ইংরেজিতে বলে দেয়, দেশের আসল পরিস্থিতি। দেশ তো ভালো নেই। মিলিটারিরা সবাইকে মেরে ফেলছে। সে এও বলে দেয়, রাস্তায় কোনও শিশুকেও দেখা যাচ্ছে না। তার মানে দেশের অবস্থা ভালো নেই। সাহসের সঙ্গে এই সত্য বলাটাও তো যুদ্ধ। আর সেই নীরব যুদ্ধকেও পরিচালক অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। সঙ্গে দর্শক দেখতে পায় ছবির শুরুতে যে ভীতু অনিল, সেই অনিল ধীরে ধীরে সাহসি হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি তাকে লড়াই করার সাহস জোগাচ্ছে।

অতশী চরিত্রে অনবদ্য জ্যোতিকা জ্যোতি

ঙ. ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরেফ সৈয়দ। এটাই তার প্রথম পূর্ণদের্ঘ্য। তার অভিনয় সন্দেহাতীত দুর্দান্ত। দর্শক অনেকদিন মনে রাখবে তার অভিনয়। হুমায়ূন আহমেদ তার কলমে যে অনিলের গল্প বলেছিলেন, হুবহু তাকেই যেন পর্দায় তুলে এনেছেন মোরশেদুল ইসলাম। একদম সাধারণ ভীতু চরিত্র, নিজের নীরবতার মুহূর্ত, সাহসী হয়ে ওঠা, নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকা- সব দৃশ্যেই আরেফ সৈয়দ চমৎকার অভিনয় করেছেন। বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে আসা এ তরুণ অভিনেতার অভিনয়ই মূলত ‘অনিল বাগচীর একদিন’কে অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে।

চ. প্রধান চরিত্রের বড় বোন অতশী হিসেবে অভিনয় করেছেন জ্যোতিকা জ্যোতি। তার চরিত্রটা অন্যরকম ছিল। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে অনেক সময় এমন নারী চরিত্র থাকে। যার অনেক কিছু বলার থাকে, কিন্তু বলতে পারে না। তার হৃদয়ে তীব্র প্রেম থাকে, কিন্তু সে প্রেম আর উত্তাল হয়ে ওঠে না। মনের ভেতর ‍উত্তাল প্রেমের সমুদ্রকে সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ করানোর সব পদ্ধতি হুমায়ূন আহমেদ তাদের শিখিয়ে দেন। ছবিতে-পর্দায় এতো তো ব্যাখ্যা সম্ভব না। ডায়লগ, এক্সপ্রেশন দিয়ে আবেগ বোঝাতে হয়। হুমায়ূন আহমেদের অসাধারণ তেমন অস্ফুট বক্তব্যকে জ্যোতিকা জ্যোতি নিজ দক্ষতায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন, অবশ্যই সেখানে পরিচালকের মুন্সিয়ানা নিশ্চিত ছিল।

অতিথি শিল্পী মিশা সওদাগর ওরফে কর্নেল এলাহী

ছ. ছবিতে অনেক চরিত্রকে অত্যন্ত দুর্বল মনে হয়েছে। যেমন, অনিল এবং অতশীর বাবার চরিত্রের অভিনয় একদম ‘অভিনয়ই’ মনে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বাস্তব হয়ে ফুটে উঠতে পারেনি। একইসঙ্গে কর্ণেল এলাহী চরিত্রে মিনিট দুই-একের জন্য পর্দায় হাজির হন জনপ্রিয় খলনায়ক মিশা সওদাগর। তিনি অত্যন্ত বাজে উর্দু ভাষায় কথা বলেন ইন্সুরেন্স কোম্পানির মালিকের সঙ্গে। পাকিস্তানি সৈন্যরা নিশ্চয়ই এভাবে উর্দু বলেনি।

জ. ছবিতে গান আছে। দুটি গানই অত্যন্ত বেমানান ছিল। বিশেষ করে অতশীর বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর অনেকটা হুট করেই একটা গান শুরু হয়। এখানে ছন্দের পতন হয়েছে বলে মনে হয়।

বাবা ও বোনের সঙ্গে ছোট্ট অনিল বাগচী

শেষ বিবেচনা:

‘অনিল বাগচীর একদিন’ খুব ধীর গতির ছবি। ধীরে ধীরে গল্পের ভেতর প্রবেশ করেছেন পরিচালক। খুব ঘনঘন অনিল তার স্মৃতিপটে চলে যায়। আবার ফিরে আসে। এই বিষয়টির যথার্থ কারণ দর্শক ধীরে ধীরে উপলব্ধি করবে, হয়তো। তবে মোরশেদুল ইসলামের অধিকাংশ ছবির গতি মন্থর। তার ‘দীপু নাম্বার টু’ এবং ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ছাড়া বাকি সবগুলো ছবির গতি ধীরে ধীরে এগিয়েছে। নাটকীয়তাও পেয়েছে ধীরে ধীরে, মাঝেমধ্যে নাটকও মনে হয়েছে। তবে ‘অনিল বাগচীর একদিন’ ছবিটির গতি কম হলেও হুট করেই নাটক মনে হয়নি একবারও। নিজের সমালোচনার ওই গণ্ডি থেকে এবার সম্ভবত বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। কারণ, সংখ্যার (প্রেক্ষাগৃহ এবং দর্শক) বিচার মূখ্য না করে, দর্শক এবার হলে বসে পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিই দেখছেন।

‘মুক্তিযুদ্ধ’ যেই ছবির বিষয়, সেই ছবিটি দেখার জন্য হলভর্তি দর্শক হওয়ারই কথা। তার ওপর বিজয়ের মাস। অথচ দুর্ভাগ্য! দর্শক সংকটে ভুগছে অনিল বাগচী। এ দায় শুধু নির্মাতাদের নয়, দর্শকেরও। নগরীর শ্যামলী সিনেপ্লেক্সে ১১ ডিসেম্বর মুক্তির প্রথম শো-তে দর্শক সংখ্যা ছিল হতাশাজনক। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে দর্শক হয়তো বেড়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই ধরনের মৌলিক গল্পের ছবি দেখার জন্য দর্শক সংখ্যা বাড়াতে সবাইকেই উদ্যোগী হওয়ার কথা ছিল।

প্রিমিয়ার শো’তে এক ফ্রেমে ছবি সংশ্লিষ্টরা

প্রাপ্ত তথ্য মতে, হুমায়ূন আহমেদকে উৎসর্গ করা বেঙ্গল ক্রিয়েশনস প্রযোজিত ও পরিবেশিত এ ছবিটি প্রথম সপ্তাহে মাত্র ১১টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। বিষয়টি লজ্জার। সরকারি উদ্যোগেই সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর ‘অনিল বাগচীর একদিন’ মুক্তির বিষয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। সময় আছে এখনও। মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ এই ছবিটির মাধ্যমে সারাদেশের স্কুলগুলোতে প্রদর্শন করার উদ্যোগ নিতে পারে সরকার এবং প্রশাসন। মুক্তিযুদ্ধের সেই ধূসর কিংবা বর্ণীল সময়গুলোকে যেদিন এই স্কুল পড়ুয়া শিশুরা অনুধাবন করতে পারবে, সেদিন থেকেই হয়তো বদলে যেতে থাকবে বাংলাদেশ।

/এমএম/